
গ্রেফতারের আগে ছয় মন্ত্রীকে ফোন দিয়েছিল টেন্ডার কিং জি কে শামীম। ঘনিষ্ঠ কজন শীর্ষ নেতার সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করে সে। কারও কাছ থেকেই তেমন কোনো সাড়া পায়নি শামীম। শেষমেশ তার হাতের শেষ অস্ত্রটি কাজে লাগায়।
রিমান্ডে থাকা টেন্ডার কিং শামীমের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্যে পুলিশ কর্মকর্তারাও বিব্রত হচ্ছে। কজন মন্ত্রী ও নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় নাম ভাঙিয়ে প্রভাব খাটাত সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে। মন্ত্রীদের বাসায় তার যাতায়াত ছিল নিয়মিত। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনের সঙ্গেও ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তার ক্ষমতার দাপটের কাছে অসহায় ছিল সরকারি কর্মকর্তারা।
সশস্ত্র দেহরক্ষী নিয়ে গাড়িতে হুইসেল বাজিয়ে সরকারি দফতরগুলোতে যখন সে ঢুকত, ছাত্রলীগ-যুবলীগের অনেককেই দেখা যেত তার লট বহরে। রুমে প্রবেশ করতেই কর্মকর্তাদের অনেকেই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যেত। পিডব্লিউডিতে তার প্রবেশ ঘটে স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতার মাধ্যমে। এমনই এক পরিস্থিতিতে সময়ের সব চেয়ে আলোচিত ব্যক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে এই টেন্ডার কিং জি কে শামীম। প্রশ্ন উঠেছে, টেন্ডার কিং-এর গডফাদার কে?
গত শুক্রবার ভোর থেকেই সন্ত্রাসী যুবলীগ নেতা ও প্রভাবশালী ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমের নিকেতনের অফিস ঘিরে রাখে র্যাব। একপর্যায়ে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম নিকেতনে এলে শুরু হয় অভিযান, আর কার্যালয়ে তল্লাশির প্রস্তুতি। র্যাব কর্মকর্তাদের অভিযান ও তল্লাশি করতে বারণ করে জি কে শামীম। এর বদলে এক কর্মকর্তাকে ১০ কোটি টাকা ঘুষ প্রস্তাব করে সে। জব্দ করা হয় নগদ টাকা, এফডিআরসহ মাদক।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে শামীম গণপূর্ত অধিদফতরের ২০ জন সাবেক সরকারি কর্মকর্তার নাম বলেছে, যাদের মাসে ২-৫ লাখ টাকা দিত এই কুখ্যাত সন্ত্রাসী। এর বদলে তারা শামীমকে ঠিকাদারির কাজের টেন্ডার পেতে সাহায্য করত। সূত্র জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শামীম জানায় যে, ঢাকার বাসাবো ও নিকেতনে তার অন্তত পাঁচটি বাড়ি রয়েছে। রাজধানীতে একাধিক ফ্ল্যাট আছে। গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে তার বাড়ি রয়েছে। তার বাসাবো ও নিকেতনের বাড়ি দুটি খুবই অত্যাধুনিক। সেখানে গণপূর্তের যুগ্ম ও অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তার সঙ্গে সব ধরনের ব্যবসায়িক আলাপ ও লেনদেন করত। সেখানে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থাও ছিল।
সূত্র আরও জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এই টেন্ডার কিং সরকারি বড় বড় প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোটি কোটি টাকা ঘুষ দেওয়ার কথা স্বীকার করে। জিজ্ঞাসাবাদে শামীম জানায়, ঠিকাদারির কাজ পাইয়ে দিতে সে দুই কর্মকর্তাকে এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা দিয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদে জি কে শামীম আরও জানায়, প্রতি টেন্ডারে ৮-১০ শতাংশ কমিশন দেওয়া লাগত তার। অনেক সময় নির্দিষ্ট কমিশনের পরও ঘুষ দিতে হতো। পূর্ববর্তী ও ভবিষ্যতের কাজ পেতে এখন পর্যন্ত গণপূর্ত অধিদফতরের সদ্য সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামকে তিনি ঘুষ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা ও গণপূর্তের ঢাকা জোনের আরেক সদ্য সাবেক কর্মকর্তাকেও ঘুষ দিয়েছে ৪০০ কোটি টাকা- এমন দাবি করে এই সন্ত্রাসী।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সদ্য বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ জেরার মুখে অনেকের নাম ফাঁস করেছে। যুবলীগ আওয়ামী লীগ থেকে শুরু পুলিশ কর্মকর্তাদের নামও বলতে শুরু করেছে। পুলিশকে কী পরিমাণ টাকা দেওয়া হতো, তার হিসাবও দিয়েছেন ক্যাসিনো কিং খালেদ। সূত্র জানিয়েছে, খালেদ বলেছে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি সম্রাটই ক্যাসিনোর আসল রূপকার। তাঁর হাত ধরেই ঢাকার মতিঝিল থানার বিভিন্ন এলাকার স্পোর্টস ক্লাবগুলোয় ‘হাউজি’ আসরকে ক্যাসিনোতে উন্নীত করা হয়। এ কাজে সম্রাটের সহযোগী হিসেবে পরিচিতি পান খালেদ। তার দেওয়া তথ্য মতে, এসব ক্লাবের ক্যাসিনোতে খেলা এবং সেগুলো পরিচালনায় যুক্ত হয় আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতাও। খালেদের এই স্বীকারোক্তিতে বিব্রতবোধ করছে জিজ্ঞাসাবাদকারী গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তাকে জিজ্ঞাসাবাদকারী সূত্র বলেছে, এখন পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে খালেদের তথ্যে ফেঁসে যেতে পারেন পুলিশ সদর দফতর ও মহানগর সদর দফতরের সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে অনেক শীর্ষ কর্তা; মহানগরের মতিঝিল, রমনা, তেজগাঁও, মিরপুর, গুলশান ও উত্তরা বিভাগের অনেক পুলিশ কর্মকর্তাও। জিজ্ঞাসাবাদকারী সূত্র বলছে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকেই ক্যাসিনো কারবারের ‘গডফাদার’ দাবি করেছেন খালেদ। এর বাইরে যুবলীগের শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতাসহ ঢাকা সিটি করপোরেশনের অনেকের নাম বলেছে খালেদ। অপরদিকে আন্ডারওয়ার্ল্ড কিং খ্যাত শফিকুল আলম ফিরোজ ওরফে কালা ফিরোজকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, কালা ফিরোজ দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডের নেপথ্য কারিগর। তার মূল ব্যবসা ছিল বিদেশে লোক পাঠানো। মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশেই রয়েছে
তার অফিস। রাজধানীর সেভেন স্টার গ্রুপের নেপথ্য গডফাদার এই কালা ফিরোজ। সুইডেন আসলামের শেল্টারদাতা কালা ফিরোজের নির্দেশে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে খুন-খারাবিসহ বড় ধরনের ঘটনাও ঘটে। তবে সে থেকে যেত ধরাছোঁয়ার বাইরে।
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। ২০০৬ সালের ঘটনা। ওই সময়ে রাজধানীর পরীবাগে আলোচিত ‘দি তুর্কি অ্যাসোসিয়েটস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে চাঁদা না পেয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়েছিল রমজান আলী মাস্টার নামে এক ব্যক্তিকে। সূত্র জানায়, আর এই হামলায় জড়িত অভিযোগে সরাসরি নাম উল্লেখ করে যে কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছিল তাদের অন্যতম ছিল শফিকুল আলম ফিরোজ ওরফে কালা ফিরোজ। যে রাজধানীর কলাবাগান স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি ও কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। গত শুক্রবার বিকালে কলাবাগান স্পোর্টিং ক্লাবে অবৈধ জুয়া বা ক্যাসিনো পরিচালনার দায়ে র্যাব কালা ফিরোজকে গ্রেফতার করে। অবশ্য কৃষক লীগ থেকে ফিরোজকে বহিষ্কারও করা হয়। জানা গেছে, এই শফিকুল আলম ফিরোজ এক যুগ আগেও সন্ত্রাসী কালা ফিরোজ নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে পরিচিত ছিল। সময়ের পালাবদলে অপরাধ জগতের এই মানুষ খোলস পাল্টে হয়ে যায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। এ ছাড়াও সে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার সিনিয়র সহসভাপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নেতৃত্বও দেয়। এখানেই শেষ নয়, এমন একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুর-৫ (শাহরাস্তি-হাজীগঞ্জ) আসনের নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনের জন্য ব্যাপক চেষ্টা-তদবির চালায়।