মাস কয়েক আগেও গম-গম করত বেঙ্গালুরু ও সংলগ্ন বেলান্দুর, থুবুরাহল্লি, হারালুর, সরজাপুর এলাকা। কিন্তু, ক্রমশ এলাকাগুলো যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হচ্ছে। অবৈধ বাংলাদেশিদের ধরপাকড় শুরু হতেই ভয়ে বেঙ্গালুরু ছাড়ছে অনেকে। আর তাতেই এই হাল।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্টে প্রকাশ, বেলান্দুরে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশি বাসিন্দার কথায়, ‘সরগরম ছিল এই কলোনি। কিন্তু এখন দেখলে কাঁদতে ইচ্ছে করে। প্রায় সকলেই এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছে।’ তাঁর কথায় বাংলাদেশে ফিরতে প্রায় হাজার পনের টাকার প্রয়োজন। সেই অর্থ জোগাড় হলে তিনিও ভারত ছাড়বেন। বিগত ১৩ বছর ধরে বেঙ্গালুরুতে আবর্জনা পরিস্কারের কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। দুই মেয়ের কলেজের পড়ার অর্থ বাংলাদেশে পাঠান এই কাজ করেই। দেশে ফিরতে হলে ভবিষ্যত যে সুখকর নয়, তা জেনেও সীমান্ত পারের চেষ্টায় ওই ব্যক্তি। বেসরকারি পরিসংখ্যানে জানা গিয়েছে, বেঙ্গালুরু শহরে ২০০ থেকে ২৫০ বাংলাদেশি পরিবার ছিল। বেশিরভাগই বাড়ির কাজ বা আবর্জনা তোলার কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পুলিশ ধরপাকড় জোরদার করতেই বেশির ভাগই চলে গিয়েছে। রয়েছে ১৫-১৬ পরিবার।
থুবুরাহল্লি, হারালুর, সরজাপুরের অবৈধ উপায়ে ভারতে ঢুকে পড়া বাংলাদেশিরা সন্তানদের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন, বাড়ির সামগ্রী ও যানবাহন জলের দরে বিক্রি করে দিয়েছেন ইতিমধ্যেই। এদের অনেকেই বলছেন, বেঙ্গালুরু পুলিশের হাতে ধরা পড়লে হেনস্তার শেষ থাকবে না। এর থেকে সীমান্ত পার করতে গিয়ে বিজিবির হাতে ধরা পড়লে তাও রক্ষে। প্রমাণের সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশি নাগরিকত্বের। তাদের কথায়, বেশিরভাগই দেশে ফিরে যাচ্ছেন। অল্প সংখ্যক কিছু বাংলাদেশি দিল্লি, তামিলনাড়ুসহ অবিজেপি শাসিত রাজ্যেগুলোতে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। অনেকের আবার আর্জি তাদের ২ বছরের জন্য কাজের ভিসা দেওয়া হোক। তাহলে কমবে অনুপ্রবেশের হার।
সম্প্রতি, বেঙ্গালুরু পুলিশ শহর থেকে অবৈধ বাংলাদেশিদের ধরতে কড়া পদক্ষেপ করেছে। প্রায়ই চলছে ধরপাকড়। আর এতেই বিপদ বেড়েছে কাজের সন্ধানে এদেশে ঢুকে পড়া বাংলাদেশিদের। শহরে বসবাসকারী ২৮ বছরের এক যুবকের কথায়, ‘সম্প্রতি ৬০ জন ধরা পড়েছে। ভয়ে আমি গাড়ি চালান ছেড়ে দিয়েছি। আমি চাই না পুলিশ আমাকে ধরুক। একবার ধরলে পুরো পরিবারর শেষ হয়ে যাবে।’
যুবকের স্ত্রী বাংলাদেশের বাগেরহাটের বাসিন্দার দাবি, ‘ভারতে ধরা পড়লে অবস্থা শেষ হয়ে যাবে।’ চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। প্রশ্ন, ‘খাটলেও আমাদের দেশে অর্থ মেলে না। ফিরে তো যাব। কিন্তু করব কী? পেট চলবে কীভাবে জানি না।’
দিন কয়েক আগেই ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরতে গিয়ে সীমান্তে আটক হন ২০০০ বাংলাদেশি। এই ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম সারির সংবাদ মাধ্যমগুলে এই খবর প্রকাশ করে। বেশ কয়েকজনের পরিবার ভারতে আসেন ১৯৭১ সালে। উদ্বাস্তু হিসাবে রয়েছেন তারা। ভয়ে তাদেরও কম নয়। উদ্বাস্তু পরিবারের সন্তান বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা ২৬ বছর বয়সী যুবক তাই অপেক্ষা করছে। শেষ পর্যন্ত কী হয় তা দেখতে চাইছে সে। কিন্তু এই পরিস্থিতি হাতে গোনা মাত্র।
ধরপাকড় বেড়েছে বেঙ্গালুরুতে। কর্নাটক সরকারও জানিয়েছে এনআরসি হবে রাজ্যে। ৩৫টি আটক কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে। আর এতেই ভীতি বেড়েছে। আগেভাগেই বাংলাদেশ চলে যাচ্ছেন এদেশে অবৈধ উপায়ে ঢুকে পড়া ওপারা বাংলার বাসিন্দারা। ধরপাকড়ের গুঁতোয় বাংলা, আসাম, ত্রিপুরার বহু ভারতীয় বাঙালিও আতঙ্কে রয়েছেন।
বেঙ্গালুরু ও সংলগ্ন যেসব এলাকায় বেশি বাংলাদেশিদের বাস সেখানে সপ্তাহ কয়েক আগেই পৌঁছেছিল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। প্রথমে বাড়ির মহিলা ও শিশুদের কথা বলতেই দেওয়া হচ্ছিল না। নেকেই আবার নিজেদের নাম বদল করে হিন্দু বলে দাবি করেন। যেমন একজন নিজেকে সুমন বলে দাবি করেন। পরে জানান তিনি বাংলাদেশি। অবিলম্বে ভারত ছাড়বেন।
ধস নেমেছে বর্জ্য় নিষ্কাশন কারখানাগুলোতেও। কারখানা মালিক বলছিলেন, ‘আমার কাছে ৮০ জন বাংলাদেশি কাজ করত। এখন রয়েছে মাত্রা ২০ জন। এদের অনেকেই চলে যাবে। ফলে খুব সমস্যা হচ্ছে।’ নির্মাণ শিল্পেও বহু বাংলাদেশি কাজ করেন। সেখানেও কাজের চেয়ে চাহিদা শ্রমিকের কম থাকায় মজুরি বেশি পড়ছে। বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। বেঙ্গালুরুর মানবাধিকার কর্মী কলিমুল্লার জানান, ‘এত বছর এদেশে ঢুকে পড়া বাংলাদেশিদের কিছু বলা হল না। এরা শহর পরিষ্কার রাখার কাজ করছে। এরা চলে যাচ্ছে। ফলে শহর ফের নোংরা হতে পারে।’