টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার কাইলাকুড়ি স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্র নিয়ে বহুল প্রচারিত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে একটি প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছে সম্প্রতি। ‘ইত্যাদি’র উপস্থাপক হানিফ সংকেত সরেজমিন প্রতিবেদন করেছে স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্রটি নিয়ে।
প্রতিবেদনে দেখানো হয়, ক্লিনিকটির প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার এড্রিক বেকার নামক এক পশ্চিমা খ্রিষ্টান নাগরিক। সে নিজ দেশের আরামের জিন্দেগি ছেড়ে নিরেট মানবসেবার জন্য বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত প্রত্যন্ত এই এলাকায় স্থায়ীভাবে চলে এসেছিল। এবং ‘কেবলই’ সুবিধাবঞ্চিত মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আমৃত্যু সে এ ক্লিনিকটি নিয়ে কাইলাকুড়িতেই পড়ে ছিল। এখানেই সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে এবং স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির দাওয়ায় তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে। মানবসেবার কারণে এলাকায় সে ‘ডাক্তার ভাই’ নামে পরিচিত ছিল।
ইত্যাদির ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ডাক্তার ভাই তাঁর মৃত্যুর পূর্বে বাংলাদেশের ডাক্তারদের কাছে আহ্বান জানিয়েছিল, বাংলাদেশি ডাক্তারদের কেউ যেন এই ক্লিনিকটির দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং সুবিধাবঞ্চিত এই উপজাতি এলাকার মানুষগুলোর ফ্রি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে। কিন্তু বাংলাদেশি ডাক্তারদের কেউই তাঁর এই আহ্বানে সাড়া দেননি, কিছুদিন পর ডাক্তার ভাইও মারা যায়।
অবশেষে দুবছর পর তাঁর এই আহ্বানে সাড়া দিয়েছে আমেরিকার খ্রিষ্টান তরুণ এক ডাক্তার দম্পতি। তাঁরা এড্রিকের মানবতাবাদী এই কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে ২০১৮ সালে ছোট ছোট চার শিশু সন্তান নিয়ে আমেরিকার বিলাস বহুল জীবন ছেড়ে প্রত্যন্ত এ গ্রামে চলে এসেছে। এবং ‘নিঃস্বার্থভাবে’ আর্তমানবতার সেবায় নিজেদেরকে উৎসর্গ করছে।
হানিফ সংকেতের এই প্রতিবেদন ইত্যাদিতে প্রচারিত হবার পর এড্রিক বেকার ও তরুণ ডাক্তার দম্পতির মানবতা নিয়ে যেমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা হচ্ছে, তেমনি এই মানবতাবাদের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ধর্মান্তরবাদ নিয়েও হচ্ছে জোর সমালোচনা। একই সঙ্গে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররাও এই প্রতিবেদনে দেশি ডাক্তারদের হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে।
ক্ষুব্ধ বাংলাদেশি ডাক্তারগণ
চিকিৎসা সংক্রান্ত অনলাইন পত্রিকা মেডি ভয়েস ডটকমের সম্পাদকীয়তে আজ (২ ডিসেম্বর) হানিফ সংকেতের ওই প্রতিবেদনের কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। পেশাজীবী নেতা ডা. বাহারুল আলম সেই সম্পাদকীয়তে বলেন, তৎকালীন ভারতবর্ষে পাশ্চাত্যের আধিপত্য ও উপনিবেশিকতা পাকাপোক্ত করার জন্য ব্রিটিশরা দাতব্য বা মিশনারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে সুপরিকল্পিত অপকৌশলের আশ্রয় নেয়। উদ্দেশ্য- একটি সাদা চামড়ার পাশ্চাত্যের ব্রিটিশরা কত দয়ালু ও মহান সেটা প্রমাণ করা! বিপরীতে ভারতীয়রা কত কাঙ্গাল ও করুণা ভিক্ষা চাইতে ভালবাসে! যা প্রকারান্তরে ভারতের উপর ব্রিটিশদের আধিপত্য, শোষণ, নির্যাতনে সহায়ক শক্তি হিসাবে ভূমিকা রেখেছে এবং এখনও ভারতবর্ষে সেই উপনিবেশিকতার প্রভাব বজায় আছে। সেই প্রচারে ভূমিকা রেখেছে হানিফ সংকেত ও তার ইত্যাদি।
তিনি বলেন, হানিফ সংকেত ও তার ইত্যাদির প্রচারে যারা প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তাদের দু’শ বছরের উপনিবেশিকতার ইতিহাস স্মরণে রাখা উচিত। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও দাতব্যের অপকৌশলের আড়ালে আমাদের মনোজগতে ব্রিটিশ শাসন মেনে নেওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি করেছিল। হানিফ সংকেতের ইত্যাদির প্রচার সে অপকৌশলের বিবর্তিত অধ্যায়।
এদিকে মেডি ভয়েসের অপর একটি মতামত কলামে ডা. আবদুর রব নামে একজন বিশেষজ্ঞ মেডিকেল অফিসার বলেছেন, ডা. এড্রিক বেকার বা তাঁর উত্তরসূরি আমেরিকান ডাক্তার দম্পতির এই মানবসেবা আলাদাভাবে বিশেষায়িত করার কিছু ছিল না। কারণ, এ দেশে অসংখ্য ডাক্তার এমন আছেন যারা নিজ এলাকায় নামমাত্র ভিজিটে অথবা একদম ফ্রিতে মানুষকে চিকিৎসা পরামর্শ দিচ্ছেন। ইত্যাদি অনুষ্ঠান সেসব ডাক্তারদের নিয়ে কোনো প্রতিবেদন করার আগ্রহ দেখায় না, আগ্রহ কেবল সাদা চামড়ার লোকজনের লৌকিক মানবসেবায়!
তিনি ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, সাদা চামড়ার লোকজন নামমাত্র চিকিৎসা সেবা দিয়ে ইত্যাদির কাছে তাঁরা হয়ে যায় হিরো, আর আমরা কালো চামড়ার লোকজন প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে প্রতিদিন হাজারও রোগীকে নামমাত্র ফি’র বিনিময়ে চিকিৎসাপরামর্শ দিয়ে ‘কসাই’ই থেকে যাই।
ডা. আবদুর রব বলেন, পাইকগাছায় যে জায়গায় আমি বসি সেটা একটা ডায়াবেটিক সেন্টার। বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির একটা অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান। এখানে প্রতি শুক্রবার বিএমএ’র কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক ডা. শহীদুল্লাহ বিনামূল্যে যে পরিমান ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী দেখেন এবং প্রতি ইউনিয়নে ফ্রি ক্যাম্পের নামে যে পরিমান রোগী ওষুধসহ ফ্রি দেখেন, ডা. বেকার তার ভগ্নাংশ পরিমাণ রোগীও চোখে দেখেনি। কই, জনাব হানিফ সাহেব ডা. শহীদুল্লাহকে নিয়ে তো ইত্যাদিতে প্রচার করেনি? নাকি প্রচারের জন্য সাদা চামড়ার হতে হবে, খ্রিষ্টান মিশনারির লোক হতে হবে, সারা জীবন বিয়ে না করে থাকতে হবে আর সুদূর আমেরিকা থেকে ক্যাথলিক ধর্মীয় আবেগে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে মানব সেবা করতে হবে?
মানবতাবাদী ডাক্তার নাকি ধর্মান্তরবাদী মিশনারি?
ডা. এড্রিক বেকার কি উপজাতি অধ্যুষিত এই অঞ্চলে কেবলই মানবতার তাগিদে জীবন পার করেছিল, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে, জানতে চেয়ে ফাতেহ টুয়েন্টি ফোর থেকে কথা বলা হয়েছিল মধুপুরের স্থানীয় কয়েকজনের সাথে।
তাঁদের কেউই নামপ্রকাশ করে মিডিয়ায় এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি। নাম-পরিচয় গোপন করার শর্তে প্রত্যেকেই জানিয়েছেন মধুপুরের শোলাকুড়ি ইউনিয়নে মূলত উপজাতিদের বসবাস। এখানে বেশ অনেক বছর ধরে খ্রিষ্টান মিশনারিরা সেবার আড়ালে ধর্মান্তকরণের কাজ করে আসছে। একসময় যেখানে একজন খ্রিষ্টানও ছিল না, সেখানে উপজাতিদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ এখন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছে। ওই এলাকায় খ্রিষ্টান মিশনারিরা বেশ কয়েকটি স্কুল ও ক্লিনিক স্থাপন করেছে। এগুলো মিশনারিদের অর্থায়ন ও সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। ডাক্তার বেকারের কালিয়াকুড়ি হাসপাতাল এগুলোরই একটি। সে মূলত খ্রিষ্টান মিশনারিদেরই লোক। উপজাতিদের মধ্যে খ্রিষ্টবাদ প্রচারের লক্ষ্যেই সে এ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছে। এবং সেবার আড়ালে মানুষকে এখান থেকে মূলত খ্রিষ্টধর্মের প্রতিই আকৃষ্ট করা হয়।
তাঁরা বলেন, ডাক্তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর যে ডাক্তার দম্পতি এখানে এসেছে, তাঁরাও খ্রিষ্টান মিশনারির লোক। ক্যাথলিক খ্রিশ্চিয়ান মিশনের তত্ত্বাবধানেই তাঁরা এখানে এসেছে। এবং তাঁদের যাবতীয় ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা মিশনারিই করে থাকে।
একই কথা বলছেন ডা. আবদুর রবও। তিনি বলেন, ডা. বেকারের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালটি একটি মিশনারি হাসপাতাল। এটা বিদেশি ডোনেশনে চলে। কিছু স্থানীয় দানও আছে। যারা এখানে কাজ করছে একেবারে ফ্রি নয়, মিশন থেকে টাকা পায়। ক্যাথলিক খ্রিশ্চিয়ান মিশন। এই মিশনের উদ্দেশ্য কী, (খ্রিষ্টবাদের প্রচার এবং মানুষকে ধর্মান্তরিত করা) তা কারও অজানা থাকার কথা না।
ডা. রব বলেন, বাংলাদেশের কিছু ডাক্তার এখানে একই সিস্টেমে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছিল। স্বয়ং ডা. বেকার অপারগতা দেখিয়ে বলেছিল, দেশি ডাক্তার এলে মিশনের ফান্ডিংয়ে সমস্যা হবে। এইখানে কে কাজ করবে সেটা মিশনের ঠিক করে দেয়। এর পরেও গণস্বাস্থ্য মেডিকেলের দুই জন ডাক্তার প্রতি সপ্তাহে ফ্রি চিকিৎসা দেন সেখানে। ইত্যাদির রিপোর্টে অত্যন্ত চতুরতার সাথে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে সেটি এবং আমার মতো গ্রামে পড়ে থাকা ডাক্তারদেরকে স্রেফ অপমান করা হয়েছে।