
এমন কোনো কাজ নেই যা করত না সকাল, রাফিদ, অমিতসহ বুয়েট ছাত্রলীগের অন্য নেতাকর্মীরা। আবরারকে পিটিয়ে মারার পর একের পর এক তাদের কুকীর্তির তথ্য বেরিয়ে আসে। র্যাগিংয়ের নামে জুনিয়রদের নির্যাতন, সহপাঠীদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার, মেসের বাজারের টাকা আত্মসাৎ এবং ছাত্রদের মেরে হল থেকে বের করে দিতো তারা। এমনকি সাধারণ শিক্ষার্থীদের মূল্যবান জিনিসপত্রও কেড়ে নিতো সকাল, রাফিদ, অমিতরা।
আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আব্দুল মুবিন ইবনে হাফিজ প্রত্যয় পুলিশের কাছে এসব কথা বলেছেন। তার জবানবন্দিতে বুয়েট ছাত্রলীগের সদস্যদের নানা অপকর্মের কথা উঠে এসেছে।
প্রত্যয় ২০১১ নম্বর কক্ষের শিক্ষার্থী, যে কক্ষে আবরারকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়।
প্রত্যয় পুলিশকে বলেন, পড়ার জন্য সোহরাওয়ার্দী হলের ৪০০১ নম্বর রুমে বন্ধু কমল দেবনাথের কাছে যেতাম। প্রতিদিনই সকাল ৯টা মধ্যে রুম ছাড়তাম। এরপর শুধু দু’বেলা খাবারের জন্য রুমে যেতাম। পড়া শেষে রুমে ফিরতে রাত ৩-৪টা বেজে যেত। আবরার মারা যাওয়ার আগে ২০১১ নম্বর রুমে একজন ছাত্রকে র্যাগ দেয়া হয়। ওই সময়ে আমি রুমে ছিলাম না। পরে রুমে ফিরেও ধারণা করতে পারিনি, এরকম কিছু ঘটেছে। কেননা, এর আগে আমার উপস্থিতিতে রুমে এরকম কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেনি।
তিনি বলেন, র্যাগ সংক্রান্ত বিষয়ে এর আগে এটুকু জেনেছিলাম, অমিত সাহা ১৭তম ব্যাচের সাখাওয়াত অভির হাত ভেঙে দিয়েছে। সোহরাওয়ার্দী হলে যাওয়ার পর এবং রাতে রুমে ফেরার কারণে আমার সাথে ২০১১ নম্বর কক্ষে বাকি যারা থাকত তাদের কার্যকলাপ খুব একটা লক্ষ করা হয়নি বা ওদের সাথে তেমন একটা কথাও হতো না। এর মাঝে ৫ বা ৬ তারিখ শেরেবাংলা হলের এক ব্যাচমেটের কাছ থেকে জানতে পারি, ৪ তারিখ রাতে হলের ১৬তম ব্যাচের একজন ছাত্রকে মেরে হল থেকে বের করে দিয়েছে এবং ওর প্রায় দেড় লাখ টাকার কম্পিউটার কেড়ে নিয়েছে। আবরার মারা যাওয়ার পর জানতে পারি, ওই ঘটনার সাথে ছাত্রলীগের সকাল (উপ-সমাজসেবা সম্পাদক), রাফিদ (উপ-দপ্তর সম্পাদক), অমিত (আইনবিষয়ক উপ-সম্পাদক) প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
বুয়েটের ওই শিক্ষার্থী বলেন, ঘটনার (আবরার হত্যা) দিন সকালে অন্যান্য দিনের মতো কমলের রুমে যাই। এর মাঝে দুপুরে একবার খেতে আসি। বিকেল ৫টায় ফিরে একটু রেস্ট নিয়ে ৬টার দিকে জিগাতলায় টিউশনিতে যাই। রাত ৯টার দিকে হলে ফিরে ডাইনিংয়ে খেয়ে কমলের রুমে চলে যাই। রাত ৩টার দিকে পড়া শেষ করি। ৩টা ২০ মিনিটের দিকে বন্ধু তাজওয়াত ফোন দিয়ে জানায়, হলে একটা ঘটনা ঘটেছে এবং আমাকে দ্রুত ওর রুমে যেতে বলে। আমার নিজের রুমে যেন না যাই। ফিরে এসে দেখি, ১৭তম ব্যাচের কিছু ছেলে কান্নাকাটি করছে। সিঁড়ির মুখে স্ট্রেচারে একটি ছেলে। দেখেই বুঝেছিলাম, ছেলেটি মৃত। এ সময় স্ট্রেচারের কাছে ছিল পাঞ্জাবি ও টুপিপরা লোক, মেহেদী হাসান রাসেল এবং অনিক সরকার। আর কাউকে ওভাবে চোখে পড়েনি। এরপর ২০০৭ এ গিয়ে জানতে পারি, ছেলেটাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে ২০১১ নম্বর রুমে। প্রথমে ঘটনার গভীরতা বুঝে উঠতে পারিনি। তাজোয়ারকে নিয়ে আমার রুমে যাই। এসময় রুমে ক্রিকেট স্ট্যাম্প আর কিছু সিগারেটের ফিল্টার দেখি। আবরার যে বমি করেছিল তারও কোনো ছাপ আমরা দেখিনি। এরপর আবার সোহরাওয়ার্দী হলে চলে আসি।
তিনি বলেন, ‘ভোর সাড়ে ৪টার দিকে আমরা ১০-১২ জন ক্যাম্পাসে জড়ো হই। সকাল ৭টার দিকে দেখি শেরেবাংলা হলের ১৭তম ব্যাচের ছাত্ররা ফেসবুকে আবরারের মৃত্যুর ঘটনা জানিয়ে সবখানে পোস্ট করছে। এটা দেখার পর শেরেবাংলা হলে যাই, ওদের সাথে দাঁড়ানোর জন্য। এর মাঝে হলে কিছু পুলিশ, কিছু সাংবাদিক চলে এসেছিল। আমরা সবাই হল অফিসে গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে চাই এবং সেটার ব্যাকআপ রাখার জন্য হল অফিসে জানাই। সবাই ভাবছিল, অপরাধীরা ফুটেজ নষ্ট করবে। এর মাঝে আশপাশের হল থেকে এবং যারা হলে থাকে না, এরকম অনেকেই হলে চলে আসে। এ সময় হলের নিচে সকাল, ফুয়াদ, মুন্নাকে ঘোরাফেরা করতে দেখি এবং ক্যান্টিনে চা-সিগারেট খেতে দেখি। অনিকও হলে ছিল। ওর রুমের আশপাশে ওকে দেখা যায়। জিয়ন অনেককে ফোন করে জানতে চাচ্ছিল, তাকে ফুটেজে দেখা গেছে কি না। আমরা জানতে পারি আবরারকে অনিক ও সকাল সবচেয়ে বেশি মেরেছে। আর রবিন আবরারকে হাসপাতালে নিতে বাধা দিয়েছে। সময় গড়ানোর সাথে সাথে শেরেবাংলা হলে শিক্ষার্থী বাড়তে থাকে। সবাই কমবেশি হল অফিসের সামনে ছিল। মূলত ১৭তম ব্যাচ সিসিটিভি ফুটেজ নেয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল।’
সূত্র: রাইজিংবিডি ডট কম