সম্প্রতি অ্যাননটেক্স গ্রুপ ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের দুর্নীতির জন্য সবচেয়ে বেশি আলোচিত সরকারি খাতের জনতা ব্যাংক। বর্তমানে সব ধরনের নেতিবাচক সূচকে সবার শীর্ষে জনতা ব্যাংক। প্রথমবারের মতো গত বছর বড় অঙ্কের লোকসান দিয়েছে ব্যাংকটি। বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করলেও সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে ব্যাংকটির। কয়েক বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকটি একসময় ভালো ছিল; কিন্তু এখন ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। এর জন্য পরিচালনা পর্ষদ এবং শীর্ষ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দায়ী। তারা নিয়ম মেনে যে ঋণ দেয়নি, সেগুলো এখন খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে সংক্রামক ব্যাধির মতো অন্য সংকট তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, শুরুতেই দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল; কিন্তু সেটি করা হয়নি। এখন ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অনিয়মের সঙ্গে যেসব কর্মকর্তা জাড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত না করলে ব্যাংকটির অবস্থা আরও খারাপ হবে।
এ বিষয়ে কথা বলতে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন আহমেদ ও এমডি আব্দুছ ছালাম আজাদকে ফোন দিয়ে পরিচয় দিলে তারা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে এসএমএস এবং কল দিলেও তারা সাড়া দেননি।
বিদায়ী ২০১৯ সালের হিসাব-নিকাশ এখনো চূড়ান্ত হয়নি; কিন্তু বিভিন্ন সূত্র থেকে আর্থিক সূচকগুলোর তথ্য জানা গেছে। ২০১৯ সাল শেষে ব্যাংকটির মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৯ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। ঋণের পরিমাণ ৪৯ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। এই ঋণের মধ্যে খেলাপি ১৪ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা; যা দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আগের বছর খেলাপি ঋণ ছিল ১৭ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা। ব্যাংকটির খেলাপি
ঋণ কমানোর কারণ খেলাপিদের গণছাড়ের আওতায় পুনঃতফসিল সুবিধা দেওয়া। গতবছর খেলাপি ঋণ কমেছে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা; অথচ পুনঃতফসিল করা হয়েছে ৫ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা। ছাড় দেওয়ার সমপরিমাণ খেলাপি ঋণ কমাতে পারেনি ব্যাংকটি। ২০১৮ সালে দেড় হাজার কোটি টাকা পুনঃতফসিল করে ব্যাংকটি। ব্যাপকহারে পুনঃতফসিল করায় ব্যাংকটির সুদ-আয় বেড়ে মুনাফা বাড়ার কথা; কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্ত অনেক ঋণ নতুন করে খেলাপি হয়ে গেছে। ফলে মুনাফার ধারা থেকে বেরিয়ে লোকসানে পড়েছে ব্যাংকটি। গত বছর পরিচালন মুনাফা কমে হয়েছে ৭০৮ কোটি টাকা; আগের বছর যা ছিল ৯৭৮ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন ও কর পরিশোধের পর ব্যাংকটির নিট লোকসান হয়েছে ২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। আগের বছর ব্যাংকটির নিট মুনাফা ছিল ২৫ কোটি টাকা। এর আগের তিন বছর মুনাফা করেছে ব্যাংকটি।
খেলাপি ঋণ বেশি থাকায় ব্যাংকটির প্রভিশনের প্রয়োজনীয়তা বাড়ে; কিন্তু আয় কমে যাওয়ায় প্রয়োজনমাফিক প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি ব্যাংকটি। ২০১৯ সাল শেষে প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৬১ কোটি টাকা। গত চার বছরে সবসময় প্রভিশন উদ্বৃত্ত ছিল। প্রভিশন ঘাটতি থাকার অর্থ হচ্ছে জনগণের জমানো অর্থ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
নিয়ম মেনে ঋণ বিতরণ না করায় ঋণ শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে জনতা ব্যাংকের। ফলে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বাড়ছে। ব্যাংকের আর্থিকভাবে শক্তিশালী করতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। সেটিও করতে ব্যর্থ হয়েছে জনতা ব্যাংক। গত ৫ বছরে ২০১৯ সালের আগে ব্যাংকটির মূলধন উদ্বৃত্ত ছিল; কিন্তু গত বছর শেষে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে ৫০ কোটি, ২০১৭ সালে ১৫ কোটি, ২০১৬ সালে ২৭৮ কোটি ও ২০১৫ সালে ব্যাংকটির মূলধন উদ্বৃত্ত ছিল ৫৬ কোটি টাকা।
ব্যাংক সূত্র জানায়, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে বছর দুয়েক আগেও আর্থিক সূচকে ভালো অবস্থানে ছিল জনতা ব্যাংক; কিন্তু ব্যাংকটির শীর্ষ পদস্থরা নিয়ম ভেঙে উদারহাতে অ্যাননটেক্স গ্রুপ ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দিয়েছে। অ্যাননটেক্স গ্রুপের কর্ণধার ইউনুস বাদল ২২টি প্রতিষ্ঠানের নামে ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে ৭টি প্রতিষ্ঠানের ঋণকে বিশেষ সুবিধাও দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ক্রিসেন্ট গ্রুপের দুই ভাই এমএ কাদের ও জাজ মাল্টিমিডিয়ার আবদুল আজিজ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে হাতিয়ে নিয়েছেন ৫ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণের টাকা আদায় হচ্ছে না। এর আগে বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির মূল অকুস্থল ছিল জনতা ব্যাংক। এসব কেলেঙ্কারির সঙ্গে জনতা ব্যাংকের বর্তমান এমডি আব্দুস ছালাম আজাদ সরাসরি জড়িত বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে; কিন্তু অদৃশ্য কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আব্দুছ ছালাম আজাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে গড়িমসি করছে। ২০১৭ সালে তিনি ব্যাংকটির এমডি হিসেবে নিয়োগ পান। এর আগে এই ব্যাংকের ডিএমডি ছিলেন আব্দুছ ছালাম আজাদ। দুর্নীতির জন্য শাখা ব্যবস্থাপক পর্যায় থেকেই আলোচিত এই কর্মকর্তা।
ব্যাংকটির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৮ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়। ২০১৭ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা, পরের বছর যা হয় ১৭ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৫ সালে ৪ হাজার ৩১৮ কোটি ও ২০১৬ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ৫ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা।