রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ তিন মাদককারবারিকে গ্রেপ্তার করার পর মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে থানা থেকেই এক কারবারিকে ছেড়ে দিয়েছে ওই থানার এসআই সন্ত্রাসী মো. মেহেদী হাসান এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে।
শুধু তাই নয়, ওই তিনজনের কাছে তিন হাজার পিস ইয়াবা পাওয়ার পরও নথিপত্রে তিনি উল্লেখ করেছেন এক হাজার পিসের কথা। তদুপরি বেশি দামের সাদা রঙের ইয়াবা জব্দ করা হলেও তিনি উল্লেখ করেছেন কম দামের লাল/গোলাপি রঙের বড়ি নাকি জব্দ করা হয়েছে।
ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার তিনজন হলেন আমির খসরু ওরফে রবিন খান, রোকসানা ওরফে চান্দা ও মো. আবদুস সাত্তার। এর মধ্যে আমির খসরু তালিকাভুক্ত ইয়াবাকারবারি। তাকেই থানা থেকে ছেড়ে দিয়েছেন এসআই মেহেদী। পুলিশের এই কর্মকর্তা এ মামলার বাদী হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজেই এজাহারে প্রকৃত তথ্য গোপন করেছেন। রূপনগরের একটি ভবন থেকে ওই ৩ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হলেও এজাহারে উল্লেখ করেছেন রাস্তা থেকে গ্রেপ্তারের কথা। মামলায় স্থানীয় বাসিন্দাদের কাউকে সাক্ষী করেননি, করেছেন তার নিজের সোর্স ও পথচারীকে।
এদিকে আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, যে ভবনের সামনে থেকে এসআই মেহেদী দুই আসামিকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছেন, সেখানে কোনো ভবনের অস্তিত্বই নেই, আছে খালি মাঠ। এ ছাড়া গত ১৫ নভেম্বর রাতে ওই ৩ মাদককারবারিকে গ্রেপ্তারের পর থানা থেকে আমির খসরুকে ছেড়ে দেওয়া এবং থানায় পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদকালে মাদক সিন্ডিকেটের বিষয়ে ওই আসামির চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রদানসহ আড়াল করা বেশকিছু তথ্য-প্রমাণ রয়েছে এ প্রতিবেদকের কাছে।
গত ১৬ নভেম্বর রূপনগর থানায় দায়েরকৃত মামলার এজাহারে এর বাদী এসআই মেহেদী হাসান উল্লেখ করেন, গত ১৫ নভেম্বর রাত পৌনে দশটার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এসআই মেহেদী জানতে পারেন রূপনগর থানাধীন ইস্টার্ন হাউজিং ডি-ব্লকস্থ ২৩৬ নম্বর বাসার সামনের রাস্তায় কতিপয় মাদককারবারি মাদকদ্রব্য বিক্রি করছে। এর পর পল্লবী জোনের এসি ও রূপনগর থানার ওসির নেতৃত্বে সঙ্গীয় ফোর্সদের নিয়ে রাত সোয়া ১০টার দিকে ২৩৬ নম্বর বাসার সামনে অভিযান চালান মেহেদী।
এ সময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পলিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে মাদক ব্যবসায়ী রোকসানা চান্দা ও আবদুল সাত্তারকে আটক করা হয়। এ সময় উপস্থিত সাক্ষী মো. রফিকুল হক (বাসা-রূপনগরের ইস্টার্ন হাউজিং, এস-১ সড়কের এফ-ব্লকস্থ ৩৫ নম্বর ভবন), মো. রিয়াজুল ইসলাম তপুর উপস্থিতিতে রূপনগর থানার কনস্টেবল লাভলী আক্তারের মাধ্যমে আটকদের তল্লাশি করে প্রায় ৩ লাখ টাকা মূল্যের ১ হাজার পিস লাল গোলাপি রঙের অ্যামফিটামিনযুক্ত ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করা হয়।
এর মধ্যে চান্দার কাছ থেকে ৭০০ পিস ও সাত্তারের কাছ থেকে ৩০০ পিস ইয়াবা পাওয়া যায়। উপস্থিত সাক্ষীদের সামনে জব্দ তালিকা মূলে জব্দ করে আসামি ও আলামত নিজ হেফাজতে নেন এসআই মেহেদী হাসান। জিজ্ঞাসাবাদে দুই আসামি জানায়, তারা দীর্ঘদিন ধরে রূপনগর থানা এলাকা ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১৫ নভেম্বর রাতে এসআই মেহেদী রূপনগর থানাধীন ইস্টার্ন হাউজিং ডি-ব্লকস্থ ২৩৬ নম্বর বাসার সামনের রাস্তা থেকে নয়, মাদক ব্যবসায়ী চান্দা, আমির খসরু ও মো. আবদুল সাত্তারকে ওই এলাকারই একটি ভবন থেকে গ্রেপ্তার করেন তিনি ও তার সহযোগীরা। যে বাসার সামনে তিনি গ্রেপ্তারস্থল দেখিয়েছেন-গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ২৩৬ নম্বর প্লটে কোনো বাড়ি বা ঘর নেই।
এ প্লটের উল্টোপাশের ডি-২৩৭/১ নম্বর ভবনের কেয়ারটেকার জানান, গত ১৫ নভেম্বর রাতে তিনি বাড়ির সামনে কোনো মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে দেখেননি। ইস্টার্ন হাউজিংয়ের সাইট ম্যানেজার একেএম জাহাঙ্গীর কবিরও জানান, ২৩৬ নম্বর প্লটটিতে কখনই কোনো বাড়ি ছিল না। সে রাতে তিনিও মাদককারবারিকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে দেখেননি।
এজহারে বর্ণিত সাক্ষী রফিকুল হকের রূপনগর ইস্টার্ন হাউজিং, এস-১ সড়কের এফ-ব্লকের ৩৫ নম্বর ভবনে খোঁজ নিতে গেলে ভবন মালিক মিলি জানান, রফিকুল হক নামে কাউকে তিনি চেনেন না, এ ভবনে কখনই এ নামে কোনো ভাড়াটিয়া ছিল না। পরে মামলায় বর্ণিত সাক্ষী রফিকুল হকের একটেল মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ আমাকে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে বলেন। আমি কিছু না বুঝেই তাতে সই দিই। ঠিকানা ভুল দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
ঘটনার বিষয়ে জানতে মামলার আরেক সাক্ষী রূপনগর থানা পুলিশের সোর্স তপুর মোবাইল ফোনে গতকাল রবিবার একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তার সেলফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। এসআই মেহেদী সে রাতে বিপুল মাদকসহ আমির খসরু, চান্দা ও আবদুল সাত্তারকে যে গ্রেপ্তার করেছিলেন তার প্রমাণ মিলেছে থানা পুলিশ সূত্র ও মোবাইল ফোনে ধারণকৃত একাধিক ভিডিও ক্লিপে।
ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, থানার একটি সোফায় হাতকড়া পরিয়ে পাশাপাশি বসিয়ে রাখা হয়েছে মাদক ব্যবসায়ী চান্দা ও আমির খসরুকে। ওপর তলার একটি কক্ষে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়েছে আবদুল সাত্তারকে। তিনজনকেই জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন এসআই মেহেদী।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার সাত্তার জানান, তিনি হাউজিংয়ে চাকরি করেন। মূলত ইয়াবা সেবন ও বিক্রির উদ্দেশে কিনতে ডিলার চান্দার কাছে এসেছিলেন তিনি। হাউজিংয়ের কিছু চাকরিজীবী ও ঢাকা উদ্যানের মাঠে ইয়াবা সেবীরাই তারই খদ্দের। ইয়াবা কিনেই নদীর পাড় ও ছনখেতে ইয়াবা সেবন করে তার ক্রেতারা। আপনার কাছে কয়’শ মাল (ইয়াবা) পাওয়া গেছে জানতে চাইলে সাত্তার এসআইকে বলেন-‘৫০০ পিস’। এসআইও তখন বলেন, আপনার কাছ থেকে দুই প্যাকেটে ২০০ পিস করে এবং এক প্যাকেটে ১০০ পিস পেলাম; মালডা (ইয়াবা) সাদা, ভালো কোয়ালিটির মাল।’ অথচ মামলায় সাত্তারের কাছ থেকে জব্দ দেখানো হয়েছে ৩০০ পিস লাল গোলাপি রঙের ইয়াবা।
এরও আগে থানায় এনে আমির খসরুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন মেহেদী। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার রসুলপুর গ্রামের ছেলে খসরুর বাবার নাম মৃত আরশাদ খান। তার নামে মিরপুরের রূপনগর থানাতেই রয়েছে আগের একটি মাদক মামলা (এফআইআর নম্বর-১১/২৯; তারিখ ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)। এ ছাড়া পল্লবী থানায় রয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলা (এফআইআর নম্বর-১১/১৩১; তারিখ ৬মার্চ ২০১৯)।
জিজ্ঞাসাবাদে এসআই মেহেদীকে খসরু জানান, এ ইয়াবা সিন্ডিকেটের মূল ডিলার হলেন গ্রেপ্তার রোকসানা চান্দার ছেলে রাজু। আজকের এই ২ হাজার পিস মাল (ইয়াবা) কার, কোত্থেকে আসছে-এমন প্রশ্নে খসরু বলেন, এই মাল রাজুর। তার সঙ্গেই ব্যবসা করেন খসরু। ইয়াবা সাপ্লাইয়ের যোগাযোগ রক্ষা করেন রাজুর মা চান্দা খালা। দেখভাল করেন রাজুর বোন মীম। ২৫ দিন আগে কক্সবাজার থেকে মিরপুরের কাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা প্রিয়া ও শিপন নামে দুই ক্যারিয়ারের মাধ্যমে এগুলোসহ সাদা রঙের দামি ৩ হাজার পিস ইয়াবা আনায় রাজু।
এসআই মেহেদী বলেন, যে বাসায় মালগুলা পাইলাম বাসাটা কার? উত্তরে খসরু বলেন মীমের। অথচ মামলার এজাহারে এসআই মেহেদী দুজনকে আটকের স্থান দেখান ইস্টার্ন হাউজিং ডি-ব্লকস্থ ‘অদৃশ্য’ ২৩৬ নম্বর বাসার সামনের রাস্তা। মাদক ব্যবসায়ী চান্দার কাছ থেকেও সহস্রাধিক ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে বলেও সূত্র জানিয়েছে।
অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে এসআই মেহেদী বলেন, ওই রাতে ৩ মাদক ব্যবসায়ীকে ধরে একজনকে ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। দুজনকেই ধরেছি। এদের মধ্যে এক নারীর কাছে ৭০০ পিস ও এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৩০০ পিস লাল গোলাপী রঙের ইয়াবা উদ্ধার করি। মামলায় যে বাসার সামনের রাস্তা থেকে আসামিদের গ্রেপ্তারস্থল ও সাক্ষীদের ঠিকানার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, খোঁজ নিয়ে তার সব কিছু ভুয়া দেখা গেছে জানালে এসআই মেহেদী বলেন-হয়তো ভুলেই এমনটা হয়েছে।
সর্বশেষ, গতকাল সন্ধ্যায় রূপনগর থানায় এ প্রতিবেদক ফোন করে এসআই মেহেদী হাসান সম্পর্কে জানতে চাইলে ওপ্রান্ত থেকে ডিউটি অফিসার পরিচয়দানকারী জানান, তিনি (মেহেদী) এখন আর রূপনগর থানায় নেই। পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) হেডকোয়ার্টার্সে সংযুক্ত করা হয়েছে।