যত দিন যাচ্ছে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। দেশে আক্রান্তের সংখ্যা কত এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রধান টেড্রোস অ্যাধনম ঘেব্রেইয়েসাস যেখানে বারবার বলছেন, নির্বিচারে পরীক্ষা করতে হবে। আক্রান্তদের আলাদা করে ফেলতে হবে। কিন্তু গত দুই মাসে বিদেশফেরত প্রায় ৭ লাখ মানুষ কোথায় আছে, প্রশাসন জানে না। এদের মধ্যে কতজন আক্রান্ত তারও কোনো হিসাব নেই। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, দেশের মধ্যে এটা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। মফস্সল শহরগুলোতে পরীক্ষাই হচ্ছে না। ফলে কেউ আক্রান্ত হলে সে অবস্থায়ই ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে। খবর:দৈনিক ইত্তেফাক
গতকাল বিকালে নিয়মিত প্রেসব্রিফিংয়ে আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, নতুন করে মঙ্গলবার এক জনের মৃত্যু হয়েছে। আরো ছয় জন আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ৪ এবং আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৯ জনে।
এদিকে মফস্সল শহরে করোনা পরীক্ষার কোনো সুযোগই নেই। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক, নার্সসহ সহকারীরা চরম আতঙ্কে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। অধিকাংশ হাসপাতালে জ্বর নিয়ে গেলে দেখছেনই না চিকিৎসকরা। তারা সরাসরি আইইডিসিআরের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দিচ্ছেন। অথচ আইইডিসিআরের হটলাইটে বারবার চেষ্টা করেও ফোনে ঢোকা যাচ্ছে না। কেউ সরাসরি সেখানে গেলেও ঢুকতে দিচ্ছে না। ফলে মানুষ কীভাবে পরীক্ষা করবে, তারা করোনায় আক্রান্ত কি না, সে উপায় খুঁজে পাচ্ছে না।
এই পরিস্থিতিতে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত ছুটি দেওয়া হলেও স্রোতের মতো মানুষ গ্রামে চলে যাচ্ছেন। এর মধ্যে কার করোনা আছে, আর কার নেই, তা-ও বোঝার সুযোগ নেই। ট্রেনের ওপরে-নিচে শুধু মানুষ আর মানুষ। অন্যদিকে রাজধানীর কাওরান বাজারে রাতেরবেলায় সবজি বিক্রির সময় শত শত ক্রেতা-বিক্রেতা ধাক্কাধাক্কি করে চলাফেরা করছেন। এদের মধ্যে যদি এক জনও আক্রান্ত থাকেন তাহলে শত শত মানুষের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে করোনা মোকাবেলায় চরম সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে।
পরীক্ষা করানোই দুঃসাধ্য : আইইডিসিআর এখন পর্যন্ত ৫ শতাধিক মানুষের পরীক্ষা করেছে। তার মধ্যে আক্রান্ত ধরা পড়েছে ৩৯ জন। আর মারা গেছে ৪ জন। এর বাইরে প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট, জ্বর ও গলা ব্যথা নিয়ে খুলনায় মারা গেছেন দুই জন, সিলেটে এক জন ও কিশোরগঞ্জের ভৈরবে এক জন। তারা করোনায় আক্রান্ত ছিলেন কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ার করে বলেছেন, এখনই যদি নির্বিচারে হাজার হাজার মানুষের পরীক্ষা করে আক্রান্তদের পৃথক না করা যায় তাহলে আমাদের পরিস্থিতি ইতালির চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে।
নোয়াখালীর এক কিশোরকে গতকাল মঙ্গলবার দেখা গেল আইইডিসিআরের সামনে ঘোরাফেরা করতে। জানতে চাইলে ওই কিশোর বললেন, কয়েক দিন আগে সৌদি আরব থেকে তার এক আত্মীয় দেশে এসেছেন। তার সঙ্গে তিনি মেলামেশাও করেছেন। গত দুই দিন হলো তিনি জ্বর, কাশি আর শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। স্থানীয় হাসপাতালে গেলে চিকিৎসকরা আইইডিসিআরের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়েছেন। নিজে এখানে এসেও ভেতরে ঢুকতে পারছেন না। কীভাবে পরীক্ষা করাবেন, তা-ও বুঝতে পারছেন না এই যুবক।
মিরপুরের টোলারবাগের এক বাসিন্দা টেলিফোনে ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমার পরিবারের এক জন জ্বর ও শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। আমি টানা কয়েক ঘণ্টা চেষ্টা করেও আইইডিসিআরের হটলাইনে ঢুকতে পারিনি। একদিন পর টেলিফোন সংযোগ পাওয়ার পর সেখান থেকে এক জন সবকিছু শোনার পর বললেন, যেহেতু পরিবারের কেউ বিদেশ থেকে আসেনি, তাই তাদের এই পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। অথচ হাসপাতালে গেলে ভর্তি করছে না। এই পরিস্থিতিতে আমরা কী করব? সরকারি হাসপাতালেও সাধারণ রোগের চিকিৎসা সেবা মিলছে না।’
সংসদীয় কমিটিতে ক্ষোভ:স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির গতকালের বৈঠকে কমিটির সভাপতি শেখ ফজলুর করিম সেলিম স্বাস্থ্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের উদ্দেশ্যে বলেন, গত চার মাসে আপনারা চিকিৎসকদের সরঞ্জাম ও কিট আনতে পারেননি। তাহলে আপনারা এতদিন করেছেন কী? অযথাই কথা বলে সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছেন। বৈঠকে উপস্থিত অধিকাংশ সংসদ সদস্যই করোনা মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
কক্সবাজারে বৃদ্ধা আক্রান্ত :কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, কক্সবাজারে ওমরাফেরত এক বৃদ্ধার শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। ঢাকায় পাঠানো নমুনার পরীক্ষার রিপোর্টে এ ভাইরাসের উপস্থিতির তথ্য এসেছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (সুপার) ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। আক্রান্ত বৃদ্ধা ভর্তির পর থেকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের বিশেষ কেবিনে রয়েছেন। আক্রান্ত এই নারী (৭৫) গত ১৩ মার্চ ওমরা হজ শেষে সৌদি আরব থেকে ফিরেছেন। তার পরিবারের প্রায় সবাই হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন। হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক-নার্স ও ক্লিনারকে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে।
আখাউড়ায় চিকিৎসককে ঢাকায় প্রেরণ :আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) সংবাদদাতা জানান, আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় নিয়োজিত থাকা এক চিকিৎসককে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। দুই দিন ধরে জ্বর-সর্দি ও গলা ব্যথায় ভোগার পর গতকাল সকালে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়।
সৈয়দপুরে করোনা সন্দেহে একজন হাসপাতালে : স্টাফ রিপোর্টার, রংপুর জানান, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসোলেশন বিভাগের করোনা ইউনিটে এক যুবককে আক্রান্ত সন্দেহে ভর্তি করা হয়েছে। তার বাড়ি সৈয়দপুরের বাশবাড়ি গ্রামে।
পিরোজপুরে প্রয়োজনীয় পিপিই নেই :পিরোজপুর অফিস জানায়, করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংক্রমণ থেকে নিজেদের মুক্ত রেখে চিকিৎসা দেওয়ার কাজে নিয়োজিতদের জন্য পিরোজপুরে পর্যাপ্ত পিপিই নেই। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগে ২০০ পিপিই প্রয়োজন হলেও রয়েছে ৯৯টি। জেলার সিভিল সার্জন ড. হাসনাত ইউসুফ জাকি জানান, যারা স্পর্শকাতর যেমন- কম্পাউন্ডার, ওয়ার্ডবয়, সুইপারের কাজে নিয়োজিত থাকেন, করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিলে মহামারি ঠেকাতে তাদেরও নিয়োজিত করার প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে সবারই পিপিই থাকা জরুরি।
মানিকগঞ্জে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে নার্সরা : মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ডাক্তাররা তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সব উপকরণই ইতিমধ্যে হাতে পেয়েছেন বলে দাবি করলেন মানিকগঞ্জ জেলার সিভিল সার্জন ডা. আনোয়ারুল আমিন আকন্দ। তিনি জানান, বর্তমানে পিপিই এসেছে ৩০০টি, গ্লাভস ৯০০ পিস ও ফেস মাস্ক ২০০টি। ইনডোরে কর্মরত নার্সরাও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন। সদর হাসপাতালের কর্মরত শিশু বিভাগের নার্স দিলরুবা সুলতানা বলেন, ‘এখানে আমাদের সরকারিভাবে কোনো নিরাপত্তা উপকরণ দেওয়া হয়নি।’
কুমিল্লায় চিকিৎসকদের মাঝে শঙ্কা :কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, কুমিল্লায় পিপিই সংকটের কারণে চিকিত্সক ও সংশ্লিষ্ট চিকিত্সা সহকারীদের মাঝে তাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। পিপিই চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত সরবরাহ এখনো পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন কুমিল্লার সিভিল সার্জন ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান।
যশোরে নার্স-ব্রাদারদের মনোবল ভেঙে পড়েছে :যশোর অফিস জানায়, করোনা ভাইরাস আতঙ্কে যশোরের চিকিৎসক-নার্স-ব্রাদারসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবল ভেঙে পড়েছে। আবার প্রয়োজনীয় প্রতিরোধকের অভাবে ইন্টার্ন চিকিত্সকদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. দিলীপ কুমার রায় জানান, মঙ্গলবার রাতের পালা থেকে তাদের গাউনসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী দেওয়া হবে। এখনো পর্যন্ত জেলা থেকে কোনো স্যাম্পল আইইডিসিআরে পাঠানো হয়নি।
নোয়াখালীতে চাহিদার তুলনায় পিপিই এক ভাগও মেলেনি :নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল ও জেলার ৯টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত চিকিত্সক, নার্স ও স্টাফদের সুরক্ষায় পিপিই সরবরাহ অত্যন্ত নগণ্য। জেনারেল হাসপাতাল ও জেলা সিভিল সার্জন দপ্তর থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পিপিই যে চাহিদা পাঠানো হয়েছে তার একভাগও এখনো পাওয়া যায়নি।
আমার মন্তব্য ইতিবাচক
আল ফিরদাউস. কম আমি মন থেকে ভালোবাসি