জ্বর, গলাব্যথা, কাশি, শ্বাসকষ্ট আর তীব্র পেটব্যথা নিয়ে গত ১২ দিন ধরে ভুগছেন রাজধানীর বাসিন্দা আতিকা রোমা। তিনি জানান, এসব উপসর্গ নিয়ে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) যোগাযোগ করা হয়। সেখান থেকে প্রথমে কুর্মিটোলা জেনারেল হাপসাতাল এবং পরে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে যেতে বলা হয়। তবে এরপর বলা হয়, বাইরে বা হাসপাতালে থাকলে ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে, তাই হাসপাতালে থাকার দরকার নেই, আগে রক্ত পরীক্ষা করা হোক।
তখন সিদ্ধান্ত হয় বাসা থেকে পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হবে এবং বাসাতেই শতভাগ আইসোশনে থাকতে হবে। মঙ্গলবার (২৪ মার্চ) বাসা থেকে আইইডিসিআর-এর লোকজন এসে নমুনা নিয়ে যাওয়া কথা ছিল। আতিকা বলেন, এই আসছি, সেই আসছি বলে কোনও খবর নেই। সোম ও মঙ্গলবার একাধিক বার তাদের একই তথ্য দিয়েছি।
রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মুশফিকা ইসলামের অভিজ্ঞতাও প্রায় অভিন্ন। গলাব্যথা দিয়ে শুরু, পরে কাশি ও জ্বরে ভোগা মুশফিকা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত তিন দিন ধরে রাতের বেলায় শ্বাসকষ্ট হয়েছে। কোনোকিছুই খুব তীব্র নয়, কিন্তু যেহেতু সিম্পটমগুলো ওভার ল্যাপিং, সঙ্গে আমার রয়েছে কোমরবিডিটি, তাই আইইডিসিআরে যোগাযোগ করি। সব শুনে তারা স্যাম্পল নিতে হবে জানিয়ে ফোন নম্বর এবং ঠিকানা নেয়। দ্রুততম সময়ে আসবে বলেও জানায় তারা। যেহেতু একদিন পার হয়ে গেছে তাই বুধবার (২৫ মার্চ) আবার কল করলে তারা জানান, লিস্টটা অনেক লম্বা, দুই থেকে তিন দিন সময় লাগতে পারে, অপেক্ষা করতে হবে।’
মুশফিকা বলেন, ‘খুব দ্রুত স্যাম্পল কালেকশন করার সুযোগ নেই জানিয়ে তারা (আইইডিসিআর) আরও জানান, অনেক বেশি মানুষ তাদের কাছে রিপোর্ট করছে, কিন্তু সে তুলনায় তাদের লোকবল কম। ফলে সময় লাগবে।’
আতিকা বা মুশফিকার মতো আরও কয়েকজন বাংলা ট্রিবিউনের কাছে একই ধরনের অভিযোগ করেন। তারা বলেন, তারা সময়মতো আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করতে পারছেন না। এমনকী যোগাযোগ করেও তারা করোনার জন্য পরীক্ষা করাতে পারছেন না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা কেবল আইইডিসিআরে হচ্ছে, এতে করে সঠিক সংখ্যার রোগী পাওয়া যাচ্ছে না। যেখানে হাজার হাজার পরীক্ষা দরকার সেখানে ২৪ ঘণ্টায় ৮২ জনের পরীক্ষা করার বিষয়টি হাস্যকর।
তারা বলছেন, যেখানে বিশ্বজুড়ে প্রথম ১ লাখ রোগী হয়েছে ৬৭ দিনে, পরের ১ লাখ হয়েছে তারও দ্রুততম সময়ে, খুব অল্প সময়ে রোগী সংখ্যা বেড়েছে, আর গত ২৪ ঘণ্টায় ৮২ জনের পরীক্ষা করা হলেও নতুন করে কেউ শনাক্ত হয়নি বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর।
বিষয়টিকে ‘অস্বাভাবিক’ অভিহিত করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা হচ্ছে কেবল সব জায়গায় পরীক্ষার সুযোগ না থাকায়। এভাবে হলে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটা কল্পনাও করা যাচ্ছে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর কথা জানায় আইইডিসিআর। এখন পর্যন্ত ৭৯৪ জনের পরীক্ষা করেছে আইইডিসিআর। এর মধ্যে ৩৯ জন কোভিড-১৯ রোগী হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন।
যদিও বুধবার আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন প্রসঙ্গে বলেন, ‘দুটো ক্ষেত্রে আমরা ইনভেস্টিগেশন করছিলাম, তবে এখন পর্যন্ত সেটার সোর্স অব ইনফেকশন জানা যায়নি। সেক্ষেত্রে এটা লিমিটেড স্কেলে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে থাকতে পারে বলে আমরা মনে করছি।’
মঙ্গলবার (২৪ মার্চ) কোভিড-১৯ নিয়ে আয়োজিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি বিশেষ বৈঠকে উপস্থিত একাধিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক নাম গোপন রাখার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানের হাতে নমুনা পরীক্ষা করার ‘ক্ষমতা’ থাকায় তারা বিব্রত। তাই সরকার এখন এই প্রতিষ্ঠানের বাইরেও পরীক্ষা করার ভেবেছে এবং সে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রথম থেকে যদি এটা করা হতো তাহলে আরও পরীক্ষা করা সম্ভব হতো এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতো বলে মনে করেন তারা।
তবে মঙ্গলবারের বৈঠকে আইসিডিডিআরবি’র কথা বলা হলেও আইইডিসিআর থেকে বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে সেটা বলা হয়নি। আর এসব পরীক্ষাগুলো কে বা কারা সমন্বয় করবে সেটাও পরিষ্কার না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টেস্টের বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ডেফিনেশনের কথা বলে আইইডিসিআর। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডেফিনেশন তো আরও রয়েছে, ওরা (আইইডিসিআর) যে ডেফিনেশন দিচ্ছে সেটা দিয়ে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বোঝা যাবে না।
জানতে চাইলে চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী আতিক আহসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গতবছর ডেঙ্গুর সময় থেকেই আইইডিসিআরের ভূমিকা হতাশাজনক মনে হয়েছে, এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আইইডিসিআরের দায়িত্ব ছিল সরকারকে বোঝানো, সেখানে তারাই বিষয়টি বুঝতে পেরেছে বলেও মনে করি না আমি। রাজনীতিবিদরা পাবলিক হেলথ বা আউটব্রেক বোঝেন না, তাদের বুঝবার কথাও নয়। তাদের বোঝানোর কথা আইইডিসিআরের, কিন্তু সেটা তারা করেনি, তারা ফেইল করেছে। এটা আইইডিসিআরের ব্যর্থতা।’
আইইডিসিআর বোঝেনি কী হতে যাচ্ছে এবং এ জন্য কী করা দরকার মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘পরীক্ষা ব্যবস্থা এখন ছড়িয়ে দিতে হবে। নয়তো সঠিক রোগী পাওয়া যাবে না। শুরু থেকেই যে সবার সাহায্য নেওয়া দরকার ছিল সেটা তারা হয় বুঝতে পারেনি, নয়তো বুঝতে চায়নি। আর প্রতিষ্ঠানটি সেটি এখনও বুঝতে পারছে কিনা, সে নিয়েও আমি নিশ্চিত নই।’
‘টেস্ট যদি করা হয়, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাহলে রোগীর সংখ্যা ওই জায়গায় পৌঁছাবে, কিন্তু টেস্টই যদি না করা হয় তাহলে সে রোগীর সংখ্যা দশ গুণ বাড়বে। আর এটা যত দিন যাবে ততই দ্বিগুণ হারে বাড়বে’, বলেন আতিক।
করোনার টেস্ট ঠিকমতো না করতে পারলে করোনা নিয়ে কারো কথা বলাই উচিত নয় বলে মন্তব্য করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘টেস্ট না করে তারা (আইইডিসিআর) কী করে বলেন রোগী সংখ্যার কথা? আইইডিসিআরে যেসব ফোন কল যায়, তার মধ্যে থেকে নমুনা শুনে বিশ্লেষণ করে টেস্ট করে, কিন্তু যারা কল করেন না তাদের কী করবে না?’
তিনি বলেন, ‘কোয়ারেন্টিন অ্যাভয়েড করে যারা ছড়িয়ে পড়েছে তাদের নিয়ে কী করা হচ্ছে, সেটাও বুঝতে পারছি না। তাই কেবলমাত্র একটি প্রতিষ্ঠানের হাতে টেস্টের ব্যবস্থা না রেখে যারা বিদেশ থেকে এসেছে এবং তাদের সংস্পর্শে সাসপেক্টেড যারা রয়েছে, তাদের টেস্ট করতে হবে।’
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়া থেকে বৈশ্বিক মহামারিতে রূপ নেওয়া পর্যন্ত আইইডিসিআর একটানা মিথ্যাচার করে আসছে। কর্তৃত্ব ধরে রাখতে গিয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কোভিড-১৯-এর পরীক্ষা করার ব্যবস্থা থাকার পরও সেসব জায়গায় পিসিআর করতে দিচ্ছে না।’
কোভিড-১৯ প্যানডেমিকের এই পর্যায়ে (লেভেল-৩) সবচেয়ে জরুরি কাজ টেস্টিং মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র সাসপেক্টেড সবার টেস্ট করতে বাধ্য, আর আইডিসিআর ব্যর্থ হবে সেটাই স্বাভাবিক। তাই যত দ্রুত সম্ভব সারাদেশে কমপক্ষে ১৫-২০টি ল্যাবে পিসিআর মেশিন বসিয়ে প্রতিটি সাসপেক্টেড কেইস টেস্ট করতে হবে।’