করোনাভীতির প্রভাব ভয়াবহভাবে পড়েছে চিকিৎসা ক্ষেত্রে। স্বাভাবিক সময়ে যেসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক রোগীতে ঠাসা থাকত সেগুলো এখন রোগীশূন্য। চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ডাক্তার ও নার্সরা আতঙ্কিত দিনযাপন করছেন। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) অভাবে অনেক চিকিৎসক চিকিৎসা দিচ্ছেন না। করোনা ছাড়া বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, চিকিৎসাসেবা না পেয়ে তারাও হাসপাতাল ছাড়ছেন।
এ ছাড়া করোনা আতঙ্কে জটিল রোগী ছাড়া হাসপাতালে যাচ্ছেন না কেউই। অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ করে দিয়েছেন। হাসপাতালে দায়িত্ব পালনরত অনেক চিকিৎসক রোগী দেখতে ভয় পাচ্ছেন। এ অবস্থায় দেশে চিকিৎসাসেবায় বেহালদশা বিরাজ করছে।
খবর; আমাদের সময়
জানা গেছে, দেশের সরকারি ও বেসরকারি সব হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়া রোগীর সংখ্যা কমেছে। আগে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আউটডোরে প্রতিদিন সাড়ে তিন হাজার রোগী যেত। এখন ২০০ থেকে ২৫০ রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে যাচ্ছেন। একই অবস্থা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতালসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে।
রাজধানীর সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক কমেছে। অনেকে হাসপাতালে গিয়ে করোনায় সংক্রমিত হতে পারেন এমন ভয়ে যাচ্ছেন না। আবার অনেকে চিকিৎসা পাবেন না এমন ভেবে হাসপাতালে যাচ্ছেন না। সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে যারা যাচ্ছেন তারাও সঠিক চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। করোনা ভাইরাসের লক্ষণ-উপসর্গের সঙ্গে মিল থাকলে বিশেষ করে সর্দি, জ্বর, হাঁচি, কাশি, গলাব্যথায় আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাসেবা পেতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়–য়া বলেন, করোনার সংক্রমণ রোধে হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম কিছুটা সীমিত করা হয়েছে। আমাদের বৈকালিক বিশেষজ্ঞ চেম্বার সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা ছাড়া জরুরি চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম চালু রয়েছে। করোনার পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্দি, জ্বর, হাঁচি, কাশির রোগী অর্থাৎ যাদের মধ্যে করোনার উপসর্গ আছে তাদের জন্য আলাদা সেন্টার চালু করা হয়েছে। আজ বুধবার থেকে করেনা ভাইরাস শনাক্তে পিসিআর টেস্ট শুরু করা হবে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের হাসপাতালে সকাল ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত বহির্বিভাগের দেখা হয়। এখানে গতকাল মঙ্গলবার ২২৩ জন রোগী এসেছেন। আগে প্রতিদিন প্রায় ৩৫০০ রোগী আসতেন। রোগীর সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। সর্দি, জ্বর, হাঁচি, কাশির রোগী সাধারণত মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকরা দেখে থাকেন। ওই বিভাগে প্রতিদিন রোগী মাত্র ১৫-২০ জন। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে মানুষ হাসপাতালে আসতে চায় না।
করোনা ভাইরাসের লক্ষণ-উপসর্গ হচ্ছে সর্দি, জ্বর, হাঁচি, কাশি, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট। মৌসুম ফ্লুর কারণেও মানুষের সর্দি, জ্বর, হাঁচি, কাশি ও গলাব্যথা হয়ে থাকে। মৌসুম ফ্লু-এর রোগব্যাধিতে মানুষ আগের তুলনায় একটু বেশি হচ্ছে। মৌসুম ফ্লু’র সঙ্গে করোনা ভাইরাসের লক্ষণ-উপসর্গে মিল থাকায় অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। ফলে আক্রান্তদের অনেকে ভয়ে ছুটছেন হাসপাতাল কিংবা বিশেষজ্ঞ চিকিৎকের প্রাইভেট চেম্বারে। কিন্তু প্রতিদিন যে পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন তারা সবাই সেবা পাচ্ছেন না। চিকিৎসাসেবা পেতে অনেকেই নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
ভুক্তভোগীরদের অভিযোগ, করোনা সংক্রমণের ভয়ে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর নেই বলে অনেক চিকিৎসক রোগী দেখছেন না। সর্দি, জ্বর, হাঁচি, কাশি থাকা রোগীদের বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারও বন্ধ রয়েছে।
এদিকে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে ভোগান্তি, সংক্রমণের ভয় ও প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ থাকায় মানুষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হটলাইনে ফোন করে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। আবার সরকারি-বেসরকারি অনেকে হাসপাতাল ইতোমধ্যে টেলিমেডিসিন সেবা চালু করেছে। মানুষ বাধ্য হয়ে টেলিমেডিসিন সেবায় ঝুঁঁকছেন। তবে করোনার সংক্রমণের আতঙ্কে যারা ভুগছেন তারা পরীক্ষার জন্য আইইডিসিআরের হটলাইনে অনেক চেষ্টা করেও সংযুক্ত হতে পারছেন না। আর যারা পারছেন তাদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজনের পরীক্ষা করে বাকিদের বাড়িতে আলাদা থাকার পরামর্শ দিয়ে দায়িত্ব সারছে আইইডিসিআর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, হাসপাতাল বা প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসা না পেয়ে অথবা চিকিৎসা পাবেন এমন চিন্তা থেকে ফোন করে চিকিৎসাসেবা নেওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আক্রান্তরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠনের ফোনে কল করে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে স্বাস্থ্য বাতায়ন নম্বরে ১৬২৬৩ নম্বরে ফোন করে ৬৭৭১৯ জন, ৩৩৩ নম্বরে ১৪৭১ জন, আইইডিসিআরের নম্বরে ২৫০৯ জনসহ মোট ৭১৬৯৯ জন ফোনে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ৭৬৬৬০ জন ফোনে চিকিৎসা নিয়েছেন।
মগবাজারের এক বাসিন্দা জানান, তিনি রাজধানীর ধানমন্ডির পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের এক শিশু বিশেষজ্ঞ তার সন্তানকে নিয়মিত দেখেন। কিন্তু হঠাৎ করে ওই চিকিৎকের চেম্বার বন্ধ। উপায়ন্তর না দেখে তিনি রাজধানীর আরও কয়েকটি জায়গায় চেষ্টা করেও বিশেষজ্ঞের খোঁজ পাননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথম সারির বেশ কয়েকজন শিশু বিশেষজ্ঞ রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় প্রাইভেট চেম্বারে বসেন। করোনার সংক্রমণের পর থেকে কিছুদিন ধরে তাদের চেম্বার বন্ধ। ফলে অনেক পিতা-মাতার শিশুসন্তান অসুস্থ হলে বেশ সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। এ চিত্র শুধু ধানমন্ডি এলাকায় নয়, রাজধানী ও রাজধানীর বাইরের জেলায়গুলোয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা তাদের প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ রেখেছেন।