লাদাখের গালওয়ান উপত্যকা সীমান্তে চীনের হাতে পর্যুদস্ত ভারত। সেখানে দেশটির ২৩ সেনা নিহত হয়েছে। ১০ জনকে ধরে নিয়ে গিয়ে পরে ছেড়ে দিয়েছে চীন। বিহার রাজ্যের নেপাল সীমান্তে ভারতের নির্মাণাধীন নদীভাঙন রোধে বাঁধ প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে নেপাল। এমনকি ভারতের নিয়ন্ত্রণাধীন ওই এলাকা নিজেদের দাবি করে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করেছে নেপাল। যা মোদী সরকারের যোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। ডং চ্যানেলের পানি দিয়ে আসাম রাজ্যের বাকসা জেলার ২৬টি গ্রামের কৃষক চাষাবাদ করেন। যুগের পর যুগ ধরে চলা ডংয়ের সেই পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে ভুটান। ছোট-বড় সব প্রতিবেশির সীমান্তে যখন ভারত মার খাচ্ছে; তখন সব ঝাঁঝ যেন মেটাচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্তে। সীমান্তে একের পর এক হত্যাকান্ড চালিয়েই যাচ্ছে ভারতের সীমান্ত রক্ষী (বিএসএফ)। গতকালও লালমনিরহাটের পাটগ্রামে সীমান্তে একজন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ। সীমান্ত হত্যা নিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র গতকালও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, এটা দিল্লির প্রতি নতজানু রাজনীতির প্রতিদান। সরকারের ভারত তোষণনীতির কারণে সীমান্ত হত্যা হচ্ছে। নেপাল, ভুটানের মতো দেশের সঙ্গে ভারত পেরে উঠছে না। অথচ সীমান্তে বাংলাদেশিদের একের পর এক হত্যা করেছে। রাজনৈতিক কারণেই সরকার ও বিরোধী দলগুলো ভারতের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় না। এ দায় সীমান্তে জীবন দিয়ে দিতে হচ্ছে নাগরিকদের।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার শমসেরনগর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে গতকাল মিজানুর রহমান মিজান (২৫) নামে এক বাংলাদেশি যুবক নিহত হন। নিহত মিজান পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নের মুংলিবাড়ী গ্রামের ভুট্টু মিয়ার ছেলে। উপজেলার জগতবেড় ইউনিয়নের শমসেরনগর সীমান্ত দিয়ে গরু নিয়ে ফেরার পথে বিএসএফ ১৪০ ব্যাটালিয়নের চুয়াংগারখাতা ক্যাম্পের টহলরত সদস্যরা তাকে গুলি করে। গুলিবিদ্ধ গুরুতর আহত মিজানকে সঙ্গীরা উদ্ধার করে পাটগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে সেখানে সে মারা যায়। রংপুর ৬১ বিজিবি ব্যাটালিয়নের শমসেরনগর কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার সুলতান হোসেন জানান, বিএসএফের গুলিতে মিজানের মৃত্যু হয়েছে।
কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের চিরদিনের শত্রুতা। সম্পর্কটা সাপে-নেউলে। দুই দেশের সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীর হাতে একজন পাকিস্তানী নিহত হলে পরের দিনই পাকিস্তান সীমান্ত রক্ষীরা দুই জন ভারতীয়কে হত্যা করে বদল নেয়।
আগে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চীনের সৈন্যদের হাতে ভারতের একজন সিনিয়র সেনা অফিসারসহ ২৩ জন সেনা সদস্যকে প্রাণ দিতে হয়। ১০ জন ভারতীয় সেনা সদস্যকে চীনের সেনারা ধরে নিয়ে যায়। এ ঘটনার পর ভারত সীমান্তে সৈন্য বৃদ্ধিসহ যুদ্ধের হম্বিতম্বি করলেও শেষমেষ সমঝোতা করতে বাধ্য হন। দীর্ঘদিন নেপাল প্রতিবেশি ভারতের আগ্রাসী নীতির শিকার হয়েছে। এখন নেপাল কঠোরভাবে ভারতকে চোখ রাঙাচ্ছে। ভারতীয় পণ্য বর্জন এবং ভারতের চ্যানেল নিষিদ্ধ করেছে। বিহার সীমান্তে নেপাল ভারতের ভূমি নিজেদের দাবি করে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করেছে। নেপালের এই নতুন মানচিত্র নিয়ে নিজ দেশের বিরোধী দলের কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে গেছে মোদী সরকার।
হিন্দুত্ববাদী ভারত প্রতিবেশি সব দেশের সীমান্তে যখন বিপদে; তখন একমাত্র বাংলাদেশের সীমান্তে দাদাগিরি দেখাচ্ছে। দুই দেশ সীমান্ত হত্যা জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের ঘোষণা দিলেও বিএসএফ একের পর এক বাংলাদেশিকে হত্যা করছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরুতেই সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহতের সংখ্যা ১৯ জনে পৌঁছেছে। তাদের মতে, ২০১৩ সালে মোট ২৭ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ। ২০১৪ সালে হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জন বাংলাদেশিকে। আহত হয়েছেন ৬৮ জন। ২০১৫ সালে বিএসএফ হত্যা করেছে ৪৫, ২০১৭ সালে ২৪, ২০১৮ সালে নিহত হয়েছেন ১৪ জন ও ২০১৯ সালে সীমান্তে ৪৩ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। তাদের মধ্যে গুলিতে ৩৭ এবং নির্যাতনে ছয়জন। অপহৃত হয়েছেন ৩৪ জন।
মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর তথ্যানুযায়ী ২০০০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে গত ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এক হাজার ৬৪ জন বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে বিএসএফ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুসারে ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পযন্ত ছয় বছরে বিএসএফ গুলি ও শারীরিক নির্যাতনে হত্যা করেছে ৪২ বাংলাদেশিকে। অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সীমান্তে ৩১২ বার হামলা চালানো হয়। এতে ১২৪ বাংলাদেশি নিহত হন। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে ১৩০টি হামলায় ১৩, ১৯৯৭ সালে ৩৯টি ঘটনায় ১১, ১৯৯৮ সালে ৫৬টি ঘটনায় ২৩, ১৯৯৯ সালে ৪৩টি ঘটনায় ৩৩, ২০০০ সালে ৪২টি ঘটনায় ৩৯ জন নিহত হন। ভারত প্রতিনিয়তই সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে।