ভারতের তামিলনাডুতে একজন প্রৌঢ় দোকানদার ও তার ছেলেকে পুলিশ হেফাজতে অকথ্য যৌন নির্যাতন করে পিটিয়ে মারার ঘটনায় সারা দেশ জুড়ে নিন্দার ঝড় বইছে।
৬২ বছর বয়সী পি জেয়রাজ ও তার ছেলে জে বেনিক্সের একমাত্র অপরাধ ছিল তারা করোনাভাইরাস লকডাউনে নির্ধারিত সময়ের পরেও নিজেদের মোবাইল ফোনের দোকান খুলে রেখেছিলেন।
তামিলনাডুর তুতিকোরিন শহরের কাছে সাথানকুলামের বাজারে একটি ছোটখাটো মোবাইল ফোনের দোকান চালাতেন পি জেয়রাজ।
লকডাউনের সময় পুলিশের বাড়াবাড়ি নিয়ে তার কোনও মন্তব্য স্থানীয় এক অটোচালক পুলিশের কানে পৌঁছে দিয়েছিলো – পরদিন ১৯ জুন সন্ধ্যায় পুলিশ এসে তাকে দোকান থেকে তুলে নিয়ে যায়।
অভিযোগ করা হয়, তিনি সন্ধ্যাবেলা নির্ধারিত সময়ের পরও নাকি দোকান খুলে রেখেছিলেন।
যেভাবে চালানো হয় অত্যাচার ও মারধর:
বাবাকে আটক করার খবর পেয়ে তার ছেলে জে বেনিক্স (৩২) থানায় ছুটে গেলে দেখতে পান, সেখানে তাকে প্রচন্ড মারধর করা হচ্ছে।
তিনি বাধা দিতে গেলে তাকেও পুলিশ লকআপে ঢুকিয়ে নেয় – এবং পরবর্তী কয়েক ঘন্টা ধরে দুজনের ওপর চলে পাশবিক অত্যাচার ও নির্যাতন। ঠিক চারদিন পর জেয়রাজ ও বেনিক্সের লাশ পায় তার পরিবার।
জেরাজের মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, “ওরা যেভাবে বাবা ও ভাইকে মেরেছে তা বর্ণনা করা যায় না। ১৯ তারিখ সারা রাত থানার বাইরে দাঁড়িয়ে আমরা ওদের আর্তনাদ শুনেছি।”
“২০ তারিখ সকালে পুলিশ যখন ওদের হাসপাতালে নিয়ে যায়, বাবার ভেস্তি (লুঙ্গি) আর ভাইয়ের প্যান্ট তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। পুলিশ আমাদের বলে, গাঢ় রঙের লুঙ্গি দিতে।”
“সে দিনই জেল হেফাজতে নিয়ে তাদের ওপর আবার অত্যাচার শুরু হয়।”
পি জেয়রাজের শ্যালক জোসেফ পরে জানিয়েছেন, পুলিশ যখন ২০ তারিখ তাদের আদালতে নিয়ে যায় তখন ম্যাজিস্ট্রেট দোতলা থেকেই হাত নেড়ে তাদের জেল হেফাজত মঞ্জুর করেছিলেন – পুলিশ ভেতরে পর্যন্ত ঢোকেনি।
পরের প্রায় ৭২ ঘন্টা পরিবার আর তাদের কোনও খোঁজ পায়নি। ২৩ জুন জেয়রাজ ও বেনিক্সের লাশ পাওয়ার পর দেখা যায়, তাদের দুজনেরই যৌনাঙ্গ থেকে প্রবল রক্তক্ষরণ ও সারা শরীরে ব্যাপক মারধরের চিহ্ন স্পষ্ট।
অভিযুক্ত পুলিশ কর্মীদের শাস্তির দাবি
পুলিশের হেফাজতে এই নির্মম হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে রাজ্যে প্রতিবাদ শুরু হয় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, যার রেশ এখন দিল্লি-সহ সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে।
তামিলনাডুতে বিরোধী দল ডিএমকের সিনিয়র এমপি কানিমোরি বলেন, “এটা আসলে একটা খুন – পুলিশের হাতে ঠান্ডা মাথায় খুন। সেভাবেই এর তদন্ত করতে হবে। এই চরম অত্যাচারের জন্য অভিযুক্ত পুলিশ কর্মীদের সাসপেন্ড করাই যথেষ্ঠ নয়, তাদের প্রত্যেককে গ্রেপ্তারও করতে হবে।”
“ঠিক সময়ে দোকান বন্ধ করা হয়নি, এই অপরাধে কারও বিরুদ্ধে বড়জোর এফআইআর হতে পারে – কিন্তু কীভাবে পুলিশ তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে সারা রাত লক-আপে নির্যাতন করে?”, প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
পুলিশি নির্যাতনের সংস্কৃতি কবে বন্ধ হবে?
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সিনিয়র গবেষক জয়শ্রী বাজোড়িয়া বলেন, “আসলে পুলিশে সংস্কারের প্রক্রিয়া ভারতে বহুদিন ধরেই বন্ধ হয়ে গেছে। জেয়রাজ ও বেনিক্সের মৃত্যুকেও কিছুতেই একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যাবে না।”
“জোর করে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য এদেশের পুলিশ আখছার নির্যাতনের আশ্রয় নেয়, গ্রেপ্তারির যে সব নিয়মকানুন আছে তার কোনও ধার ধারে না।”
“আমরা শুধু আশা করতে পারি, জেয়রাজ-বেনিক্সের মৃত্যুতে যে ধরনের তুমুল ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে তাতে পুলিশের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে সরকার হয়তো এবার কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেবে।”
নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের যে সনদ আছে, ভারত তাতে স্বাক্ষর করলেও আজ পর্যন্ত নিজের দেশে তা র্যাটিফাই বা অনুমোদন পর্যন্ত করেনি।
বিবিসি