কোরবানি পশুর চামড়ার ন্যায্য দাম না পেয়ে গত বছর লক্ষাধিক পিস চামড়া ধ্বংস করা হয়েছিলো। যার বেশির ভাগ মাটিচাপা দেয়া হয়। কিছু ভাসিয়ে দেয়া হয় নদীতে। চামড়ার মূল্য না থাকায় স্মরণকালের ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়ে দেশের চামড়ার বাজার। দামে ধস নামায় প্রায় হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। পাশাপাশি এই টাকা থেকে বঞ্চিত হয় মাদ্রাসার এতিম ফান্ড। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ৩০০-৪০০ টাকায় কিনেও সেই চামড়া ৫০ টাকা বিক্রি করতে পারেনি। করোনার কারণে চামড়া নিয়ে এবারো সেই সঙ্কট আরো বাড়ার শঙ্কা করছে ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি চামড়া শিল্প রক্ষায় গঠিত টাস্কফোর্সের সভায় এ শঙ্কার কথা জানান তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কোরবানির পশুর চামড়ার সঙ্কট উত্তরণ এবং চামড়া শিল্প রক্ষায় গত বছর অক্টোবরে সরকারের চারটি মন্ত্রণালয় ও বেশ কয়েকটি বিভাগের সমন্বয়ে উচ্চপর্যায়ের একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে টাস্কফোর্সের প্রথম সভায় এবারো কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে বিশৃঙ্খলার শঙ্কা করেন সরকারের তিনজন মন্ত্রী এবং এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা। সভায় একগুচ্ছ প্রস্তাব ও কিছু সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে ছিল ঈদের এক মাস আগে চামড়ার দাম নির্ধারণ করে ব্যাপকভাবে প্রচার, এক মাস আগে ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের জন্য চামড়া কেনার প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড় করা, প্রয়োজনে সরকার বাজার থেকে অবিক্রীত চামড়া কিনে গুদামজাত করা এবং কাঁচাচামড়া রফতানি করা যায় কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া। ঈদের বাকি আছে আর মাত্র ২০ দিন। অথচ সেই সভার একটি সিদ্ধান্তও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। তার মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে অর্থ ছাড়ের ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হলেও কবে নাগাদ সেই টাকা পাওয়া যাবে বা কারা পাবেন তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন ট্যানারি মালিকরা।
সভা সূত্রে জানা গেছে, মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকরা যদি যথাসময়ে চামড়া কিনতে অনাগ্রহী হয় তাহলে বাজারে অতিরিক্ত চামড়া সরকারিভাবে কিনে দুই তিন মাস গুদামজাত করা হবে। এ ছাড়াও সারা দেশে মসজিদের ইমাম, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এতিমখানা ও মাদরাসার প্রধানদের চামড়া নিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া সরকার নির্ধারিত মূল্যে চামড়া বেচাকেনা হয় কি না তা মনিটরিং করতে জেলা প্রশাসক ও ইউএনওদের সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। সরকারের দেয়া ঋণ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে সরকারের আর্থিক বিভাগ। এসব সিদ্ধান্ত কিভাবে বাস্তবায়ন হবে তা এখনো পরিষ্কার করতে পারেনি সরকার।
সভায় চামড়া নিয়ে সার্বিক আলোচনা হলেও ৫টি বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়। এর মধ্যে চামড়া শিল্পের সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা, শিল্পের বিদ্যমান সমস্যা চিহ্নিত করে তা উত্তরণের উপায়, শিল্পের উন্নয়ন, বাজার সম্প্রসারণ ও রফতানি বৃদ্ধির জন্য সুপারিশ, পরিবেশ আইন বিধিমালা অনুসরণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কমপ্লায়েন্স অর্জনের জন্য কর্মপরিকল্পনা এবং নতুন বাজার অনুসন্ধান, বিদ্যমান বাজার শক্তিশালী করে নতুন নতুন উদ্ভাবন, ব্যবসায়িক উদ্যোগের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন।
সভায় শিল্পমন্ত্রী নুরুল মাজিদ মাহমুদ হুমায়ুন বলেন, চামড়া শিল্পের বিদ্যমান সমস্যা নিরসনে তিনটি মন্ত্রণালয় সমন্বয় করে কাজ করছে। গত বছরের মতো এবারো চামড়া সঙ্কট যাতে তৈরি না হয় সেজন্য আমরা কাজ করছি। চলতি বছর চামড়া যেন নষ্ট না হয় সে জন্য জেলাপর্যায়ে চামড়া সংগ্রহ করে বিভিন্ন গুদামে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, কাঁচাচামড়া সংগ্রহে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করা হবে। চামড়া শিল্প সম্প্রসারণের জন্য রাজশাহী ও চট্টগ্রামে শিল্পনগরী গড়ে তোলা হচ্ছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্শি বলেন, প্রান্তিক চামড়া ব্যবসায়ীরা যাতে চামড়া কিনতে পারে সেজন্য ট্যানারি মালিকদের সমন্বয়ে গত বছর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু দামে ধস নামে। তিনি বলেন, ট্যানারি সাভারে স্থানান্তরের ফলে মালিকরা হাজারীবাগের জায়গা বন্ধক রেখে ব্যাংক লোন পাচ্ছেন না। যত দিন ট্যানারি মালিকদের আর্থিক সমস্যার সমাধান না হয় তত দিন কোরবানির চামড়া নিয়ে একটি বিকল্প সমাধান বের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোরবানির সময় সরকারকে চামড়া কিনতে হবে অথবা কাঁচাচামড়া রফতানি করা যায় কি না সে বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।
পরিবেশ মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বাণিজ্য মন্ত্রীর সাথে একমত পোষণ করে বলেন, বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বিশ্বব্যাপী। সে হিসেবে চামড়া শিল্পের আরো উন্নয়ন দরকার। কিন্তু বর্তমানে মানুষ কেন চামড়া কিনতে অনিচ্ছুক সে বিষয়টি খতিয়ে দেখে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম বলেন, টাস্কফোর্সের প্রথম সভায় যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছিলো তা বাস্তবায়ন হলে সঙ্কট কাটানো সম্ভব ছিলো। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো সাড়া মেলেনি। তিনি বলেন, ট্যানারি সাভারে যাওয়ায় অনেক কারখানা এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। এতে আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে রফতানি। বিদেশী ক্রেতাদের চাহিদামতো চামড়া দিতে না পারায় তারাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
কোরবানির চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, তৃণমূল পর্যায়ে চামড়ার মূল্য নিশ্চিত করা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয়ের ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটিকে সংশ্লিষ্টদের সাথে সভা করে সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। শিল্প, বাণিজ্য, পরিবেশ মন্ত্রী ছাড়াও টাস্কফোর্সের সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান, পররাষ্ট্র, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, ট্যানারি মালিক, লেদার খাতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা সভায় উপস্থিত ছিলেন।
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, সারা বছর দেশে প্রায় ২ কোটি ৩১ লাখ গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া জবাই হয়। এর অর্ধেকই হয় কোরবানির ঈদে। গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া মিলিয়ে দেশে কোরবানি হয়েছে প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ পশু। নয়া দিগন্ত
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) ডেপুটি সেক্রেটারি মিজানুর রহমান বলেন, গত বছরের চেয়ে এবার আরো ভয়াবহ সঙ্কট হবে। কারণ টাস্কফোর্সের সভায় যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছিল সেগুলোর একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। সঙ্কটের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই ট্যানারিগুলো সাভারে নিয়ে যাওয়া, মালিকদের জমির দলিল না দেয়া, জমি ও কারখানার টাকা পরিশোধ করে মালিকদের নগদ টাকার সঙ্কট। তিনি বলেন, সাভারে যাওয়ার পরই ট্যানারি মালিকরা ঋণখেলাপি হতে শুরু করে। এ শিল্পকে বাঁচাতে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।