বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়া কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে। হাসপাতাল থেকে সুরক্ষাসামগ্রী চুরি হয়ে যাচ্ছে, আর তা পাওয়া যাচ্ছে খোলাবাজারে। দক্ষিণ আফ্রিকায় অর্থ ও লোকবলের অভাবে নার্সদের ক্লিনারের কাজ করতে হচ্ছে আর চিকিৎসকেরা করছেন লন্ড্রির কাজ। নিম্নমানের পরীক্ষার কিট কেনার দায়ে জিম্বাবুয়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর চাকরি চলে গেছে। নতুন রোগী ভর্তি করলে আয় বেশি, এ জন্য পুরোনো রোগীদের রোগমুক্তির সনদ দিয়ে বিদায় করে দেওয়ার অভিযোগে একটি হাসপাতালের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে গ্রিস পুলিশ।
গত মার্চে লন্ডন পুলিশ কোভিড-১৯ শনাক্তের জাল কিট তৈরির অভিযোগে ফ্রাঙ্ক লুডলো নামের ৫৯ বছরের এক ব্যক্তিকে আটক করে। পাশের দেশ ভারতের অমৃতসরে ইএমসি নামের এক বেসরকারি হাসপাতাল স্বাস্থ্যবান ও সুস্থদের করোনা ‘পজিটিভ’ বানিয়ে ভর্তি করে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেছে।
সব মিলিয়ে কোভিড-১৯-এর সময়ে অনেক দেশই দুর্নীতি নিয়ে কমবেশি সংকটে আছে। সরকারি কিছু কর্মচারী, বেশ কিছু ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মী, বেসরকারি খাতের অনেক উদ্যোক্তা এসব দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বেশি অভিযোগ বেশি দরে পণ্য কেনাকাটার। কিন্তু দুর্নীতির ক্ষেত্রে অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছে বাংলাদেশ। সুরক্ষা পণ্য কেনাকাটায় দুর্নীতি, কাজ দেওয়ায় অনিয়ম এবং অসহায় ও দুস্থদের ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি তো আছেই। তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে ভুয়া পরীক্ষার কেলেঙ্কারি। নতুন ধরনের এই দুর্নীতির কারণে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে ‘বিগ বিজনেস ইন বাংলাদেশ: সেলিং ফেক করোনাভাইরাস সার্টিফিকেট’।
বাংলাদেশ কী হয়েছে
বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের একটি। টিআইএর তালিকায় ১৯৮টি দেশের মধ্যে ১৪৬তম। সুতরাং রোগের মহামারির এই সময়ে বাংলাদেশে যে দুর্নীতি ঘটবে না, তা নিশ্চয়ই কেউ আশা করেননি। তবে মহাদুর্গতির এ সময়ে তা নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা থাকবে, সে আকাঙ্ক্ষা অনেকের ছিলো।
নগদ আড়াই হাজার টাকা দেওয়ার কর্মসূচি সফল করতে পারেনি সরকার। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণেই এই হাল। অনেক অবস্থাপন্নদের নাম এই তালিকায় ঢোকানো হয়েছে। নগদ সহায়তা এবং ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম-দুর্নীতির জন্য এখন পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের ১০২ জন জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্ত হওয়াদের বেশির ভাগই কোনো না কোনোভাবে সরকারি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সুরক্ষাসামগ্রী কেনা ও সরবরাহ নিয়েও ঘটেছে দুর্নীতি। নিম্নমানের সুরক্ষা পোশাক (পিপিই) ও মাস্ক কিনে তা সরবরাহ করা হয়েছে। এসব কেনাও হয়েছে অস্বাভাবিক বেশি দামে। করোনার শুরুতেই অর্থ মন্ত্রণালয় জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। পরে সংকট মোকাবিলায় জরুরি স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কিনতে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে সরকার। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ১১৭ কোটি টাকা এবং এডিবির প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। এই দুই প্রকল্পের কেনাকাটা নিয়েই উঠেছে দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ। স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনাকাটার বাইরে সফটওয়্যার কেনা, ওয়েবসাইট উন্নয়ন, অডিও-ভিডিও ফিল্ম নির্মাণ, সেমিনার সম্মেলন করা, ভ্রমণ ব্যয় এবং পরামর্শক খাতে বিপুল অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনা নিয়েও উঠেছে অনিয়মের অভিযোগ।
তবে বাংলাদেশে করোনাকালের দুর্নীতির সব উদাহরণকে ছাপিয়ে গেছে জেকেজি ও রিজেন্ট হাসপাতালের জালিয়াতির ঘটনা। করোনার নমুনা সংগ্রহ করে ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগে এই দুই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের আটক করেছে সরকার। করোনার নমুনা সংগ্রহ করে তা ফেলে দিয়ে, ভুয়া ফলাফল দেওয়ার ঘটনা সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত বিরল।
বাংলাদেশে শুরু থেকেই টেস্ট করা হয়েছে খুবই কম। সমালোচনার মুখে টেস্টের সংখ্যা বাড়লেও ফল পেতে দীর্ঘ সময় এখনো অপেক্ষা করতে হয়। টেস্টের জন্য ধরতে হয় দীর্ঘ লাইন। এখন তো টেস্টের জন্য অর্থ নেওয়া শুরু করেছে সরকার। ফলে শুরু থেকেই করোনা টেস্ট নিয়ে যে আস্থার অভাব ছিল, তা আরও বেড়েছে। এর মধ্যেই আবার জেকেজি ও রিজেন্ট হাসপাতালের ভুয়া টেস্টের তথ্য। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে ক্ষমতাবানদের যোগসাজশের বিষয়টি এর মাধ্যমে আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে। আবার এই দুই প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেওয়া ও চুক্তি স্বাক্ষর নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরস্পরের দোষ দিচ্ছে। সুশাসন ও জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই বলেই এমনটা ঘটছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। এ ছাড়া, চুক্তি সই করার আগে পড়ে দেখেন না বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যও ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
এমনিতেই দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে করোনার এই সময়ে স্বাস্থ্য খাতের করুণ বা কুৎসিত চেহারাটি প্রকাশ পেয়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অভিনব সব দুর্নীতি। করোনাকালে দুর্নীতি প্রতিরোধে আগাম সতর্ক ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশ যা করেছে, তা হচ্ছে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ। কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি ছাড়া প্রতিরোধে কার্যকর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ছিলো না। ঘটনা ঘটার পর ব্যবস্থা নেওয়াটাই এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, সুশাসনের সংকট, সংস্কার না করা—সবকিছুরই ফলাফল হচ্ছে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা।
সামনের দিনগুলোতে আরও অনেক অর্থ খরচ হবে। অনেক অর্থ আসবে বাংলাদেশে। ফলে দুর্নীতিরও নতুন নতুন সুযোগ ঘটবে। কোন পথে তা সামাল দেওয়া হবে, সেটাই হবে পর্যবেক্ষণের বিষয়। প্রথম আলো