৪১ বছর পর ভারতের গোটা আর্থিক বছরে আবার ফিরছে নেগেটিভ আর্থিক বৃদ্ধিহার। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার পর চলতি আর্থিক বছরে বৃহত্তম অর্থনৈতিক মন্দায় পড়তে চলেছে ভারত। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এই পূর্বাভাসই শুনিয়েছে তাদের সাম্প্রতিক রিপোর্টে। ২০২০-২১ আর্থিক বছরে আর্থিক বৃদ্ধির হার হতে পারে মাইনাস ৯ শতাংশ। শেষবার ভারতের আর্থিক বৃদ্ধিহার নেগেটিভ হয়েছে ১৯৭৯-৮০ আর্থিক বছরে। ওই বছর একদিকে ছিল চরম অনাবৃষ্টি এবং অন্যদিকে ইরানে বিপ্লবের কারণে তেলের আকাশছোঁয়া দাম। এই দুই সঙ্কটের কারণেই ওই বছর আর্থিক বৃদ্ধিহার হয়েছিল মাইনাস ৫.২ শতাংশ। যা ভারতের অর্থনীতিকে চরম সঙ্কটে ফেলেছিল। জনতা সরকারের অবশ্য তারপরই পতন ঘটে।
তবে সেটা ছিল দেশীয় অর্থনীতির আমল। ১৯৯১ সালে উদারীকরণের পর আজ পর্যন্ত কখনো নেগেটিভ জিডিপি গ্রোথের মন্দায় পড়তে হয়নি ভারতকে। করোনা ও লকডাউনের আগেই ভারতের আর্থিক বৃদ্ধিহার ছিল নিম্নগামী। যা সামলাতে নানাবিধ ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তু লাভ হয়নি। ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে আর্থিক বৃদ্ধিহার কমে হয়ে যায় ৪.২ শতাংশ। তার আগের বছর যা ছিল ৬.১ শতাংশ। করোনা ও লকডাউনের পর অর্থনীতি একপ্রকার বিপর্যস্ত। নতুন আর্থিক বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে আর্থিক বৃদ্ধিহার হয়েছে মাইনাস ২৩.৯ শতাংশ। আনলক পর্ব শুরু হলেও এখন পর্যন্ত সামগ্রিক জীবিকা, আর্থিক লেনদেন এবং শিল্প-বাণিজ্য স্বাভাবিক হয়নি। ফলে বিশেষ উন্নতির আশা করছে না কোনো অর্থনৈতিক রেটিং সংস্থা। এসঅ্যান্ডপি অথবা ফ্লিচ—সকলেই মাইনাস ১০ শতাংশের আশপাশে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধিহার থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) রিপোর্ট অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও উদ্বেগজনক। কারণ, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ভারতের প্রত্যেক রাজ্যে নানাবিধ পরিকাঠামো উন্নয়ন ও প্রকল্পে অর্থ দেয়। সুতরাং ভারতের আর্থিক বৃদ্ধিহার যদি উদ্বেগজনকভাবে নেগেটিভ হয়ে যায়, তাহলে আন্তর্জাতিক লগ্নি বিপুল ধাক্কা খাবে। ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি চরমতম আকার নেবে। আর্থিক ঘাটতিও বাড়বে দ্রুত। এই সবকিছুর যোগফল, প্রভাব পড়বে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জাপানের জাইকা ইত্যাদি ঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলোর লগ্নিতেও। জানা গিয়েছে, জাপানের সংস্থার সঙ্গে ইতিমধ্যেই বুলেট ট্রেন প্রকল্প নিয়ে মতান্তর শুরু হয়েছে। এবং মুম্বাই থেকে আমেদাবাদ বুলেট ট্রেন প্রকল্প অন্তত পাঁচ বছর পিছিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক ২০২০ শীর্ষক একটি রিপোর্টে এডিবি বলেছে, লাগাতার ও বিক্ষিপ্ত লকডাউনের ফলে ভারতে অর্থনৈতিক কাজকর্ম যেভাবে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে, সেটা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে। বিপুল ক্ষতি হয়েছে অনেক সেক্টরে। এডিবি রিপোর্টে সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে অনুৎপাদী ঋণের পরিমাণ বিপুল বেড়ে যাওয়ার। অর্থাৎ এই লকডাউন ও অর্থনৈতিক স্তব্ধতার কারণে ব্যাংক ও আর্থিক সংস্থাগুলো থেকে গ্রহণ করা ঋণ পরিশোধ যথেষ্ট ধাক্কা খাবে। সরকার লকডাউনের সময় যেভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে নানাবিধ আর্থিক সহায়তা দিয়েছে, তার অবশ্য প্রশংসা করেছে এডিবি।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, গ্রামীণ জীবিকাকে কিছুটা সহায়তা করেছে ওই প্যাকেজ, কিন্তু অর্থনীতির ঝুঁকি এমন পর্যায়ে গেছে যে, দেশি-বিদেশি লগ্নি প্রবল ধাক্কা খাবে। এডিবি সুপারিশ করেছে কম আয়ের শ্রেণী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের (লো ইনকাম গ্রুপ অ্যান্ড স্মল বিজনেস) বিশেষ সহায়তা আবশ্যক। সব মিলিয়ে আর্থিক গতিপ্রকৃতি দেখে এডিবির ধারণা, মাইনাস ৯ শতাংশের আশেপাশে থাকবে জিডিপি।
ভারতে প্রথম নেগেটিভ জিডিপি গ্রোথ হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। এরপর ১৯৬৬ ও ১৯৭৩ সালেও হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে শেষবার। কিন্তু কখনো এতটা খারাপ অবস্থা আসেনি। ১৯৭৯-৮০ আর্থিক বছরেই সবচেয়ে বেশি মন্দা দেখেছে ভারত, মাইনাস ৫.২ শতাংশ। এবার এডিবি ও অন্য আর্থিক রেটিং সংস্থা মনে করছে, বৃহত্তম আর্থিক বিপর্যয় আসছে—মাইনাস ৯ শতাংশ! নয়া দিগন্ত