মালিতে ক্রুসেডার ফ্রান্সের হয়ে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহের কাজে এসেছিলেন মহিলা এনজিও কর্মকর্তা সোফি পেট্রোনিন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি সেখান থেকে ফিরলেন হিজাব পরিহিতা মুসলিম নারী মারিয়াম হয়ে।
ঘটনার শুরু ২০০১ সালে; মালিতে দখলদার ক্রুসেডার ফ্রান্সের বিরুদ্ধে মুসলিমরা প্রতিরোধ গড়তে শুরু করেছেন মাত্র। আল-কায়েদাও তখন সে প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশ নিতে থাকে এবং ধীরে ধীরে জনসাধারণের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। এমন পরিস্থিতিতে ফ্রান্সের জন্য আবশ্যক হয়ে পড়ে মালির সার্বিক অবস্থা সার্বক্ষণিক পর্যালোচনা করা। তাই তারা মালিতে বিচক্ষণ গোয়েন্দা প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেয়। এই কাজের জন্য প্রয়োজন এমন লোকদের, যারা কোনো বাধা ছাড়াই সবসময় সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছাতে পারে।
তাই এই কাজের জন্য ফ্রান্স বাছাই করে বিভিন্ন এনজিও কর্মীদের। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই কাজের জন্য নিযুক্ত করা হয় ফরাসী মহিলা ও শিশু বিষয়ক এনজিও কর্মী সোফি পেট্রোনিনকেও। ১৯৯১ সালেও একবার তিনি মালিতে এনজিও কর্মী হিসাবে কাজ করেছিলেন। তাই এখানকার সকল স্থান ও মানুষের সাথে তার পরিচিতিটা পুরোনো। ২০০১ সালেও তিনি এনজিও কর্মী হয়ে এসেছেন মালিতে, তবে এবার অন্য একটি কাজের দায়িত্বও আছে তার। আর তা হচ্ছে মালির সার্বিক অবস্থা এবং এখানকার আন্দোলনকারীদের ব্যাপারে ফ্রান্সকে তথ্য দেওয়া। আর এ দায়িত্ব পালনার্থেই মালিতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তার কার্যক্রম চলতে থাকে।
সর্বশেষ ২০১৬ সালে মালিতে আল-কায়েদা নিয়ন্ত্রিত গাঁও রাজ্যে, সেই একই লক্ষ্যে এনজিও কর্মী হিসেবে প্রবেশ করেন ৭১ বছর বয়সী বৃদ্ধ মহিলা সোফি পেট্রোনিন ও তার সহযোগীরা। কয়েকমাস এখানে কাজ করার পর আল-কায়েদার নিকট তার কার্যক্রমে সন্দেহ তৈরি হয়। যার ফলে আল-কায়েদা তখন তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে এবং কয়েক মাসের মধ্যেই তাদের সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হয়। যার ফলে ঐ বছরের ২৪ ডিসেম্বর গাঁও রাজ্য থেকে মুজাহিদগণ তাকে ও আরও কিছু এনজিও কর্মীকে বন্দী করেন। তাদের মাঝে অনেকেই নিরপরাধ প্রমাণিত হলে মুজাহিদগণ তাদেরকে মুক্তি দেন, কিন্তু সোফির বিষয়ে উপযুক্ত প্রমাণ ও সাক্ষ্য থাকায় মুজাহিদগণ তাকে বন্দী করে রাখেন।
এরপর ২০১৮ সালের ১৩ জুন আল-কায়েদার অফিসিয়াল প্রচার মাধ্যম আয-যাল্লাকা মিডিয়া সোফির একটি ভিডিও সাক্ষাতকার প্রকাশ করে। এই ভিডিও প্রকাশের পর পরিবার থেকে তার মুক্তি নিশ্চিত করতে ফ্রান্স সরকারকে বারবার বার্তা দেওয়া হয়।
সর্বশেষ চলতি বছর (২০২০ ঈসায়ী) ফ্রান্স এবং ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের কয়েকজন বন্দীকে মুক্ত করতে মালিয়ান সরকারকে চাপ দিতে থাকে। মালিয়ান সরকার তখন বাধ্য হয়ে আল-কায়েদার সাথে বন্দী বিনিময় চুক্তি করতে রাজি হয়। দীর্ঘদিন যাবত এই চুক্তি নিয়ে চলে উভয় বাহিনীর মাঝে অনেক আলোচনা। মালী সরকার চেয়েছিল চুক্তি অনুযায়ী যেন তাদের ২০ জন বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়, কিন্তু আল-কায়েদা এতে রাজি হয়নি। সর্বশেষ ৪ ইউরোপিয়ান নাগরিককে মুক্তি দিতে রাজি হয় আল-কায়েদা।
তবে এর বিনিময়ে মুক্তিপণ এবং মুজাহিদদের তালিকাভুক্ত বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে। এরপর মুক্তিপণ ও কতজন মুজাহিদকে মুক্তি দেবে এ নিয়ে চলে দীর্ঘদিন আলোচনা। আলোচনা শেষে উভয় পক্ষ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে, কুফফার বাহিনী তাদের ৪ বন্দী মুক্তির বিনিময়ে ২০৬ মুজাহিদকে মুক্তি এবং ১০ মিলিয়ন ইউরো মুক্তিপণ আদায় করবে।
অতঃপর এই চুক্তি অনুযায়ী গত ৮ অক্টোবর বৃহস্পতিবার, আল-কায়েদা শাখা জামা’আত নুসরাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন (JNIM) তাদের কারাগারে বন্দী ৪ ইউরোপীয় নাগরিককে মুক্তি দিয়েছেন। মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দীদের মধ্যে ছিলেন ৭৪ বছর বয়সী ফরাসী এনজিও মহিলা কর্মী সোফি পেট্রোনিনও। বিপরীতে কুফফার বাহিনী তাদের কারাগারে থাকা ২০৬ জন কারাবন্দী মুজাহিদকে মুক্তি দেয়।
অতঃপর অন্যান্য বন্দীদের মতো ৭৪ বছর বয়সী সোফি দীর্ঘ ৪ বছর মুজাহিদদের নিরাপত্তায় থাকার পর শুক্রবার বিমানযোগে ফ্রান্সের বিমানবন্দরে পৌঁছেন। তাকে অভিনন্দন জানাতে তার পরিবারের পাশাপাশি ইসলামবিদ্বেষী ফরাসী প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্রোও বিমান বন্দর আসে, ঐদিন মুক্তি পাওয়া সোফির আগমন উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজনও করে প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্রো।
বিমান মাটিতে অবতরণ করার কিছুক্ষণ পরেই বিমান থেকে বের হয়ে আসেন হিজাব পরিহিতা ৭৪ বছরের একজন বৃদ্ধা মহিলা, যার জন্য বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছে দেশটির প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্রো। আর সেই মহিলাটি হচ্ছেন সোফি পেট্রোনিন।
সোফি পেট্রোনিন বিমান থেকে নেমে আসলে প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্রো তাকে অভ্যর্থনা জানাতে ছুটে যান এবং সোফি নাম ধরে তাকে অভ্যর্থনা জানান।
কিন্তু বিপত্তি বাধে তখনই, যখন সদ্য মুক্তি পাওয়া মহিলাটি বলে ওঠলেন, “মালির জন্য আমি মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা ও বরকত কামনা করি, কারণ আমি এখন একজন মুসলিমা। তুমি আমাকে ডাকছো সোফি নামে, অথচ তোমার সামনে যিনি আছেন এখন তার নাম মারিয়াম,”
‘সোফি’ বা মারিয়ামের মুখে তাওহীদের এই স্পষ্ট স্বীকারোক্তিটি ছিল ইসলামবিদ্বেষী ফরাসি ক্রুসেডার ও দেশটির প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্রোর গালে এমন চপেটাঘাত যার জন্য তারা একেবারেই অপ্রস্তুত ছিল। আর তাই বিমানবন্দরে মুক্ত সোফির আগমন উপলক্ষে দেয়া অনুষ্ঠানটি না সেরেই কেটে পড়ে প্রেসিডেন্ট ম্যঁক্রো।
এই ম্যাঁক্রোই কিছুদিন পূর্বে বলেছিল, “বিশ্বজুড়ে ইসলাম সঙ্কটের মধ্যে আছে, এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও এই ধর্মটি সঙ্কটে।”
কিন্তু মুজাহিদগণের হাতে বন্দী থাকাবস্থায় একজন ফরাসী মহিলা ইসলামের সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করে ইসলামগ্রহণ করেছেন। তার এই ইসলাম গ্রহণের ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, অবক্ষয়ের শেষ প্রান্তে থাকা পশ্চিমা বিশ্ব ব্যবস্থা আসলে সংকটে, আর বিশ্বজুড়ে ইসলামী শক্তির উত্থান ঘটছে।
লক্ষণীয় যে, মুজাহিদগণের থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত নওমুসলিমা বলছেন, জামাআত নুসরাতুল ইসলামকে সন্ত্রাসী বলা উচিত না, বরং তারা সশস্ত্র বিদ্রোহী দল। অর্থাৎ মুজাহিদগণকে যে পশ্চিমারা সন্ত্রাসী বলে অভিহিত করে, তিনি এর প্রতিবাদ করেছেন।
এর আগেও মুজাহিদগণের হাতে বন্দী থাকাবস্থায় ইসলামের সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করে ইসলামগ্রহণ করার ঘটনা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে। ইভেন রিডলি নামে একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক তালিবান মুজাহিদগণের বন্দীত্ব থেকে মুক্তিলাভের পরই ইসলামগ্রহণের ঘোষণা দেন; এরপর কিছুদিন পূর্বে সোমালিয়ার আল-কায়েদা শাখা হারাকাতুশ শাবাব আল-মুজাহিদিনের কাছে বন্দী থাকাবস্থায় ইসলামগ্রহণ করেছেন সিলভিয়া রোমানো নামে একজন ইতালিয়ান তরুণী।
লেখক: ত্বহা আলী আদনান, প্রতিবেদক: আল ফিরদাউস নিউজ