সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকার রায়হান আহমদ (৩২), মায়ের গর্ভে থাকতেই বাবাকে হারান। তার বাবা রফিকুল ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে স্বামীর ভাইকে বিয়ে করেন রায়হানের মা। নতুন ভাই বোনদের সঙ্গে কোনো বিবাদ নেই রায়হানের। যুক্তরাষ্ট্রে থাকা এক বোনের মাধ্যমে এ মাসেই যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার কথা ছিল তার। দেড় বছর আগে বিয়ে করে ২ মাস আগে ছেলে সন্তানের বাবা হন। শনিবার রাতে সন্তানকে আদর করে বেরিয়েছিলেন ঘর থেকে। সেই রাতে আর ঘরে ফিরতে পারেননি তিনি। ভোররাত সাড়ে ৪টায় একটি নম্বর থেকে কল করে রায়হান জানান, টাকার জন্য বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে তাকে মারধর করা হচ্ছে। কিন্তু টাকা নিয়ে গিয়েও রায়হানকে ফিরে পায়নি পরিবারের সদস্যরা।
পরদিন বিকেল ৩টায় তার মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। হাত-পা ভেঙে ফেলা, নখ উপড়ে ফেলা রায়হানের লাশ দেশে ক্ষোভে ফেটে পড়ে এলাকাবাসী। তারা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ জানায়। রায়হানের পরিবারের দাবি, টাকার জন্য আটকে রেখে নির্মম অত্যাচার করে রায়হানকে মেরে ফেলেছে সিলেট মহানগর পুলিশ (এসএমপি) বন্দরবাজার ফাঁড়ির সদস্যরা। এ ঘটনায় রোববার দিবাগত রাতে নিহত রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী বাদী হয়ে কোতোয়ালী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় তার স্বামীকে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে আটকে রেখে ১০ হাজার টাকা দাবি ও দাবিকৃত টাকা না পেয়ে নির্যাতন করে মেরে ফেলার অভিযোগ করেন তিনি।
এদিকে ঘটনার দুদিনেও নিহতের পরিবারের অভিযোগের বিপরীতে কোনো যুক্তি প্রমাণ হাজির করতে পারেনি পুলিশ। শুরুতে কাষ্টঘর এলাকায় গণপিটুনিতে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে দাবি করলেও সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। পুলিশ এখন বলছে, রায়হানের মৃত্যুর সঠিক কারণ তদন্ত করা হচ্ছে।
মরদেহ দাফনের আগে স্বজনরা নিহত রায়হানের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন ক্যামেরাবন্দী করে রাখেন। এতে দেখা যায়, তার হাতের দুটি নখ উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। পায়ের হাঁটুর নিচে আঘাত করে পা ভেঙে ফেলা হয়েছে। এছাড়া হাত ও পায়ের বিভিন্ন অংশে লাঠির আঘাতের চিহ্নও রয়েছে।
মিথ্যাচারেই ধরা পড়ল পুলিশ
রায়হানের মৃত্যুর পর একের পর এক মিথ্যাচারে নিজেরাই ফেঁসে যায় পুলিশ। প্রথমে দাবি করা হয়, সিলেট নগরীর মাদক জোন হিসেবে পরিচিত কাষ্টঘর এলাকায় শনিবার রাতে ছিনতাই করতে গিয়ে গণপিটুনির শিকার হন রায়হান। পরে বলা হয়, রায়হান নিজেও ছিনতাইকারী, ভাগবাটোয়ারা নিয়ে অন্য গ্রুপ তাকে নির্যাতন করলে পুলিশ মুমুর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে। কিন্তু দুটি ঘটনাই মিথ্যা প্রমাণিত হয় সিসি ক্যামেরায় ফুটেজ পর্যবেক্ষণে।
হরিজন সম্প্রদায়ের বসবাসের এলাকা কাষ্টঘরে অনেক বনেদি পরিবারও বসবাস করেন। পুরো এলাকাই সিসি ক্যামেরা দ্বারা বেষ্টিত। এসব ক্যামেরা মনিটর করা হয় ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজারুল ইসলাম মুনিমের কার্যালয় থেকে। শনিবার রাত ২টা থেকে রোববার সকাল ৭টা পর্যন্ত সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েনি এমন কোনো দৃশ্য।
নগরীর ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম মুনিম বলেন, ‘পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী গণপিটুনির যে স্থান ও সময়ের কথা বলা হয়েছে ওই স্থানে থাকা দুটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুজেটের চিত্র আমরা দেখেছি। সেদিন রাত ১০টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত এই ফুজেটে গণপিটুনির কোনো ঘটনা দেখা যায়নি। এছাড়া আমি স্থানীয় অনেকের সাথে কথা বলেছি, কেউই গণপিটুনির বিষয়টি জানেন না।‘
পুলিশের মস্তিষ্কপ্রসূত এই নাটক আরও একবার মার খায় আহতকে দ্রুত হাসপাতালের পাঠানোর প্রশ্নে এসে। পুলিশের দাবি মোতাবেক ভোর সাড়ে ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে উদ্ধার বা আটক করা হয় রায়হানকে। সাড়ে ৪টায় রায়হান ফাঁড়ি থেকে কল দিয়ে টাকা নিয়ে এসে তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কথা জানায় তার পরিবারকে। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে জানা যায় সকাল সাড়ে ৬টার দিকে হাসপাতালে নেওয়া হয় রায়হানকে। ৮টার দিকে মারা যান তিনি। সাড়ে ৪টা থেকে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত কোথায় রাখা হয়েছিল রায়হানকে? সরাসরি হাসপাতালে নেওয়া হলো না কেন? এর কোনো জবাব নেই পুলিশের কাছে।
ফাঁড়িতে ধরে এনে টাকার জন্য নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার পর থেকে রোববার রাত পর্যন্ত পুলিশ দাবি করছিল রায়হানকে ফাঁড়িতে আনাই হয়নি। তবে সোমবার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ আলোচনায় আসলে এ ব্যাপারে আর কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না তারা। আমাদের সময়