ফিরে দেখা শেখ মুজিবের শাসনকাল (পর্ব: ১)

    2
    2533
    ফিরে দেখা শেখ মুজিবের শাসনকাল (পর্ব: ১)

    শেখ মুজিবুর রহমান সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশ শাসন করেছেন। ১৯৭২ সালের ১২ই মার্চ বাহ্যত স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে তার শাসনামলের সূচনা হয় এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবের শাসনামলের সমাপ্তি ঘটে। আমাদের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল সম্পর্কে জানা সময়ের দাবী। তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিরা এই সময়কালকে বাংলাদেশের স্বর্ণযুগ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। অন্যদিকে, শেখ মুজিবরের শাসনামল সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী একটি বয়ান চালু রয়েছে। আর তা হচ্ছে- এই সাড়ে তিন বছরের শাসনামল বাংলার ইতিহাসের এক বিভীষিকাময় কালো অধ্যায়। মুজিবের শাসনামলে বাংলাদেশ ছিল নৈরাজ্য, অভাব-অনটন, গুম-খুন, অধর্মচর্চা ও দুঃশাসনের নরকক্ষেত্র। কতিপয় ক্ষমতাসীন শাসকচক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে সমস্ত জনগণ। তার শাসনকালে রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ বিকল হয়ে পড়ে, কায়েম হয়েছিল চরম কর্তৃত্ববাদী এক দলীয় দুঃশাসন।
    বর্তমান ও আগামীর বাংলাদেশ বুঝতে হলে শেখ মুজিবর রহমান সরকারের কার্যক্রম ও তৎকালীন সময়ে দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে প্রকৃত ও নির্মোহ আলোচনার বিকল্প নেই। আমরা এই সিরিজে চেষ্টা করব প্রচলিত প্রোপাগান্ডার ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত সত্য উদ্ধারের।

    সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা:
    ১৯৭১ সালে ডিসেম্বর মাস, পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় তখন অনেকটাই নিশ্চিত। ঠিক সে সময়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী বাংলাদেশের পক্ষে সরাসরি ময়দানে নামে। সেই মাসেই পাক বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, ভারতের লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। সেদিন স্বাধীনতার দলিলে ভারত ও পাকিস্তানের দুই পক্ষের স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী বা বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধির সাক্ষর নেয়া হয়নি। পাকবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের স্বাক্ষর মজলিসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপ সেনাপ্রধান এয়ার কমোডর এ কে খন্দকারকে কেবল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের একজন সাক্ষী হিসেবে রাখা হয়। এভাবে বাংলাদেশিদের ৯ মাসের ত্যাগের মুক্তিযুদ্ধ হয়ে যায় পাক-ভারত যুদ্ধ ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের বিজয়।

    পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের পর কার্যত বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় ভারত সরকার। মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরে অংশ না নেয়া ভারতে পালিয়ে থাকা মুজিবনগর সরকারের নেতাদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে তাদের হাতে বাহ্যিক ক্ষমতা তুলে দেয় ভারত। এই ভারতীয় দালাল আওয়ামী লীগের রাজনীতিকরা নামে ক্ষমতায় থাকলেও কার্যত দেশ পরিচালনা শুরু করে ভারতীয় বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও দেশপ্রেমিক যোদ্ধাদের কৌশলে ক্ষমতার বাইরে রাখা হয়। সদ্য চেপে বসা ভারতপন্থী আওয়ামী সরকারের নীরবতায় ভারতীয় বাহিনী চালাতে থাকে সমগ্র দেশ জুড়ে ভয়াবহ লুণ্ঠন ও চোরাচালান। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণকৃত ৯৩ হাজার সৈন্যের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম ভারতে পাচার করা হয়। কেবলমাত্র আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদের অস্ত্র ও গোলাবারুদের তৎকালীন বাজার মূল্য ছিল ২৭ হাজার কোটি টাকা। যার সবই ১৫টি জাহাজে করে লুট করে নিয়ে যায় ভারতীয় বাহিনী। অথচ সেই অস্ত্রের পুরোপুরি মালিকানা ছিলো বাংলাদেশের।

    ১৬ ডিসেম্বরের পর ভারতীয়দের লুন্ঠনের বর্ণনা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক জয়নাল আবেদীন তার ‘র এন্ড বাংলাদেশ’ বইয়ে লিখেছেন, “পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের পর ভারতীয় সৈন্যদের ব্যাপক লুটতরাজ দেখতে পেয়ে ভারতের প্রকৃত চেহারা আমার কাছে নগ্নভাবে ফুটে উঠে। ভারতীয় সৈন্যরা যা কিছু দেখতে পেত তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ত এবং সেগুলো ভারতে বহন করে নিয়ে যেতো। লুটতরাজ সহজতর করার জন্য তারা আমাদের শহর, শিল্প স্থাপনা, বন্দর, সেনানিবাস, বাণিজ্যিক কেন্দ্র এমনকি আবাসিক এলাকায় কারফিউ জারি করে। তারা সিলিং ফ্যান থেকে শুরু করে সামরিক সাজসরঞ্জাম, তৈজষপত্র ও পানির ট্যাপ পর্যন্ত উঠিয়ে নিয়ে যায়। লুণ্ঠিত মালামাল ভারতে পরিবহনের জন্য হাজার হাজার সামরিক যান ব্যবহার করা হয়।”

    লেখক আজিজুল করিম ‘হোয়াই সাচ এন্টি-ইন্ডিয়ান ফিলিংস এমং বাংলাদেশী?’ শিরোনামে এক নিবন্ধে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত ভারতীয় মাসিক ‘অনিক’-এর রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, “ভারতীয় সৈন্যদের লুণ্ঠিত মালামালের মূল্য ছিল প্রায় ১শ’ কোটি মার্কিন ডলার।”

    সেই সময়ে ভারতীয় বাহিনী সদ্য স্বাধীন দেশে যে সর্বব্যাপী এবং নজিরবিহীন লুটপাট চালায় তা বিদেশীদেরকেও বিহ্বল করে। গার্ডিয়ানের রিপোর্টে বলা হয়, মিল ফ্যাক্টরির মেশিনাদি যন্ত্রাংশ পর্যন্ত লুটপাট করে ভারতীয় সেনারা। পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও খাদ্যশস্য, পাট, সুতা, যানবাহন, এমনকি সমুদ্রগামী জাহাজ, কারখানার মেশিনপত্র, যন্ত্রাংশ পর্যন্ত লুট করে। এই লুটের সম্পদের পরিমাণ ছিলো সবমিলিয়ে সেইসময়ের হিসাবে ২.২ বিলিয়ন ডলার।

    প্রখ্যাত উপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার পুর্ব পশ্চিম উপন্যাসে লেখেন,
    “ঢাকায় এতসব বিদেশী জিনিস পাওয়া যায়, এসব তো আগে দেখেনি ভারতীয়রা । রেফ্রিজারেটর, টিভি, টু-ইন-ওয়ান, কার্পেট, টিনের খাবার-এইসব ভর্তি হতে লাগলো ভারতীয় সৈন্যদের ট্রাকে। …”
    এই ভারতীয় বাহিনী এতই নির্লজ্জ ছিলো যে এতো কিছু নিয়ে যাবার পরেও ব্রিগেডিয়ার র্যাঙ্কের অফিসার ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফ্রিজ, আসবাবপত্র, ক্রোকারিজ ট্রাকে ভর্তি করে ভারতে পাচার করে। একজনকে ভারতীয় বাহিনী এই লুটের অপরাধে কোর্ট মার্শালও করে তাঁর নাম ব্রিগেডিয়ার মিশ্র। [১]

    ৩১ ডিসেম্বর যশোর দিয়ে বাংলাদেশের সম্পদ ও পাকিস্তানিদের অস্ত্রশস্ত্র ভারতে লুট করে নিয়ে যাওয়ার পথে ভারতীয় বাহিনীর বহরে বাধা দেয়ায় মুক্তিযুদ্ধের ৯নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলকে গ্রেফতার করা হয়।[২]

    একদিকে বাংলাদেশের সম্পদ লুন্ঠন এবং অপরদিকে রাজাকার নিধনের নামে চালাতে থাকে নির্বিচারে আলেম-ওলামা ও ভারতীয় আগ্রাসন বিরোধী জনগণ হত্যা ও বন্দীকরণ। তাদের নির্যাতনের হাত থেকে রেহায় পায়নি দেশপ্রমিক মুক্তিযোদ্ধারাও। আর এসকল অপকর্মে ভারতীয় বাহিনীকে সর্বাত্মক সহায়তা করে মুক্তিমুদ্ধে বিতর্কিত অবস্থান নেয়া মুজিব বাহিনী। যারা বাংলাদেশের উপর ভারতের আধিপত্য, শোষণ ও লুন্ঠন মেনে নিতে পারেনি, তারা ভারতপন্থী তাজউদ্দীন সরকারের বিরাগভাজে পরিণত হন। দেশের মানুষ যখন ভারতের শোষণ ও আওয়ামী লীগের নির্যাতনে নাজেহাল, এমন সময় ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারী শেখ মুজিবকে পাকিস্তান সরকার মুক্তি দেয়। মুক্তি পাওয়ার পর শেখ মুজিব প্রথমে ব্রিটেন এবং পরে ভারত সফর করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ শেষে ১০ জানুয়ারী বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। এরপর ১২ জানুয়ারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন শেখ মুজিব। প্রধানমন্ত্রী হবার পর মন্ত্রিসভা গঠন করেন। মন্ত্রিসভায় সম্মুখ যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাধান্য না দিয়ে ভারতে পালিয়ে থাকা মুজিবনগর সরকারের নেতাদেরকেই কাছে টেনে নেন, তাদের নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করেন।

    মুক্তিযোদ্ধা ও দেশ প্রেমিক জনগণের মধ্যে শেখ মুজিবের পদক্ষেপ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। শেখ মুজিব বুঝতে পারেন ভারতীয় আগ্রাসন বিরোধী মুক্তিযোদ্ধারা দেশপ্রেমিক জনতাকে সাথে নিয়ে শোষক ভারতীয় বাহিনী ও তার সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। তাই তড়িঘড়ি করে ১৯৭২ সালের ৩১ শে জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দেন। শেখ মুজিব মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রসমর্পণ করতে বললেও তার অনুগত লোকদের অস্ত্রসমর্পণ করতে নিষেধ করেন, তাদের কেউ কেউ কেবল লোক দেখানোর জন্য অস্ত্রসমর্পণ করে।

    এ বিষয়ে ভয়ঙ্কর তথ্য দিয়েছেন মাসুদুল হক তার রচিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং সিআইএ’ গ্রন্থে। ঐ গ্রন্থের ১০৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, ‘১৯৭২ সালে একদিকে তিনি (মুজিব) সকল মুক্তিযোদ্ধাকে অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেন, অপরদিকে আব্দুর রাজ্জাক ও সিরাজুল আলম খানকে অস্ত্র জমা দিতে বারণ করলেন। শেখ মুজিবের ওই নিষেধ সম্পর্কে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সিরাজুল আলম খান আর আমাকে ডেকেই বঙ্গবন্ধু (শেখ মুজিব) বলেছিলেন, সব অস্ত্র জমা দিও না। যেগুলো রাখার দরকার সেগুলো রেখে দাও। কারণ, সমাজ বিপ্লব করতে হবে। প্রতি বিপ্লবীদের উৎখাত করতে হবে, সমাজতন্ত্রের দিকে এগুতে হবে। এটা আমাদের পরিষ্কারভাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন।[৩]

    শেখ মুজিবের দুরভিসন্ধির প্রকাশ ঘটে ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী রক্ষী বাহিনী নামক ঘাতক বাহিনী গঠনের মধ্য দিয়ে। রক্ষীবাহিনী নামে আধা সামরিক বাহিনী গঠনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী দুর্বৃত্তায়ন পরবর্তী ধাপে পদার্পণ করে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশজুড়ে নৈরাজ্য কায়েম করা মুজিব বাহিনী ও কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে এই আধাসামরিক বাহিনীটি গঠন করা হয়। রক্ষীবাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র ও চোরাচালানের মালামাল উদ্ধার এবং মজুতদার-কালোবাজারীদের কার্যকলাপ প্রতিহত করার নামে গঠন করা হলেও এদের মূল কাজ ছিলো ভিন্নমত দমন। এই বাহিনী মুজিবের হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের পাশাপাশি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, গুম, অপহরণ, চোরাচালান এবং ধর্ষণের সাথে জড়িয়ে পড়ে। তারা বিভিন্ন গ্রামের উপর ঝটিকা আক্রমণ করে গণলুণ্ঠন চালাত। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে লুটপাট এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগও ছিল। মুজিব সরকারের অপকর্মের পথে কাউকে বাধা মনে করলেই তাকে হত্যা করত রক্ষীবাহিনী।
    চলবে ইনশা আল্লাহ…

    লেখক: রাফিদ ইয়াজভান


    তথ্যসূত্র:
    ১। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর লুটপাট!!- https://tinyurl.com/yyhqeot9
    ২। অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা, মেজর এম এ জলিল; পৃ:০৮
    ৩।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এবং সিআইএ’- মাকসুদুল হক;পৃ:১০৬

    মন্তব্য করুন

    দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
    দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

    পূর্ববর্তী নিবন্ধউইঘুর মুসলিমদের উপর নির্যাতনের তদন্ত করতে চায় না আন্তর্জাতিক আদালত
    পরবর্তী নিবন্ধঋণের বোঝা সইতে না পেরে পত্রিকায় কিডনি বিক্রির বিজ্ঞাপন কাশ্মীরি যুবকের