বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনার পর গঠিত প্রায় ৯০ ভাগ তদন্ত কমিটির সুপারিশ আলোর মুখ দেখে না। ফলে প্রতিবেদনগুলোতে যে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয় তার বাস্তবায়ন হয় না। নেয়া হয় না কারও বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। এতে অবস্থারও তেমন উন্নতি হয়নি।
অসাবধানতার কারণে ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা, ঝরছে প্রাণ। বাকি ১০ শতাংশ রিপোর্ট প্রকাশ্যে এলেও দায়ীদের ৮ ভাগকে সাময়িক বরখাস্তের মতো সাজা দেয়া হয়। আর ২ শতাংশকে করা হয় বরখাস্ত। তবে এ ২ ভাগ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিরীহ কর্মচারী।
কিন্তু উপরের দিকে কারও বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। অনেক সময় তদন্ত রিপোর্টগুলোই অসৎ ঊর্ধ্বতনদের আত্মরক্ষা এবং অবৈধ অর্থ আয়ের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায় বলে অভিযোগ উঠেছে।
সূত্র জানায়, গত ১ যুগে ট্রেন দুর্ঘটনায় ৩৭৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন প্রায় ৯ শতাধিক। এসব দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা ট্রেনযাত্রী (সঙ্গে টিকিট থাকতে হবে) ছিলেন কিনা- তা নিয়ে শুরুতেই চলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
পরিচয় মিললে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়া হয় ১০ হাজার টাকা। স্বজনদের এ টাকা পেতে দুই অঞ্চলে দৌড়ঝাঁপে খরচ হয় ৬-৭ হাজার টাকা। রেলের ভুলে যাদের প্রাণ যাচ্ছে- তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে পরিবার হাতে পাচ্ছে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা।
ফলে অনেকেই এ টাকা নিতে আগ্রহ দেখান না। অভিযোগ উঠেছে, না নেয়া ক্ষতিপূরণের টাকা রেলের অসাধু কর্মকর্তারা অনেক সময় ভাগবাটোয়ারা করে নেয়।
রেলের সূত্র জানায়, গত ১ যুগে লাইনচ্যুতসহ ছোট-বড় মিলে প্রায় সাড়ে আট হাজার দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি ঘটনায় কোথাও একটি বা সর্বোচ্চ তিনটি পর্যন্ত তদন্ত কমিটি হয়েছে। সব মিলে কমিটি হয়েছে নয় হাজার।
সব কমিটিই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কিন্তু ৯০ ভাগ রিপোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। রিপোর্টগুলো অন্ধকারে ফেলে রাখা হয়েছে।
সুপারিশগুলোর বড় অংশে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াসহ রেলের উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায়ীদের মধ্যে সামান্য কয়েকজনকে সাময়িক বরখাস্ত করে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে।
ঘটনার কয়েক মাস পরই এদের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এর বাইরে আর তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই।
রেলের একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, তদন্ত রিপোর্ট ঘিরেও অবৈধ বাণিজ্যের নজির আছে। কমিটি যাদের দায়ী করে তাদের অনেকেই ঊর্ধ্বতন অসাধু কর্মকর্তার কাছে ছুটে যান নিজেকে রক্ষার জন্য।
সঙ্গে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। যা দুর্নীতিবাজ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার হাতে তুলে দিয়ে শাস্তি কমিয়ে আনেন। ফলে বড় দুর্ঘটনা ঘটলেও দায়ী ব্যক্তিকে নাম মাত্র সাজা দিয়ে পরিস্থিতি ধামাচাপা দেয়ার অনেক নজির আছে বলে তারা জানান।
তদন্ত কমিটি গঠনের ক্ষেত্রেও আছে নানা ধরনের অভিযোগ। নিজস্ব লোকজন দিয়েই অধিকাংশ সময় কমিটি গঠন করা হয়। যাতে ঊর্ধ্বতনকে বাদ দিয়ে অন্যদের কাঁধে দায় চাপানো হয়। বাস্তবেও এমন ঘটনা দেখা গেছে।
ঘটনার জন্য প্রকৃতপক্ষে দায়ী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে অধস্তনকে।
২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় মুখোমুখি দুই ট্রেনের সংঘর্ষে ১৯ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন দেড় শতাধিক যাত্রী- যাদের অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন।
একই বছর ২৪ জুন সিলেটে আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনায় ৬ জন নিহত এবং ১৫ জন আহত হন। ওই দুই দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী শুধু ট্রেনচালক ও সহকারী চালকসহ ৫ কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ওই দুই দুর্ঘটনায় পূর্বাঞ্চল রেলের ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলীসহ রেলপথ ও মেকানিক্যাল দফতরের প্রকৌশলী-কর্মকর্তারাও দায়ী। কিন্তু রিপোর্টে তাদের সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি।
তবে সিলেট-কুলাউড়া রেলব্রিজে ট্রেন দুর্ঘটনায় পূর্বাঞ্চল রেলের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী ও মেকানিক্যাল প্রধান প্রকৌশলীকে দায়ী করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এদিকে ২০১৪-১৫ এবং ২০১৯ সালের সংঘটিত লাইনচ্যুতসহ ছোট-বড় প্রায় ২৩শ’ দুর্ঘটনার মধ্যে মাত্র ২২টিতে ৩১ জনের বিরুদ্ধে শাস্তির বিবরণ পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে ১৪ জনকে শুধু তিরস্কার করা হয়েছে। সতর্ক ৪ জন এবং বরখাস্ত করা হয়েছে ৪ জনকে। ৫ জনের বিরুদ্ধে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।
দায়ী করা হয়নি ৪ জনকে। তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী দুর্ঘটনাগুলোতে প্রায় ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এত প্রাণ গেলেও সব দোষীর শাস্তি নিশ্চিত করা হয়নি।
যাদের শাস্তি দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে ট্রেন চালক, সিগন্যালম্যান, ওয়েম্যান, গার্ড এবং চতুর্থ শ্রেণির কিছু কর্মচারীর নাম রয়েছে।
একাধিক ট্রেনচালক জানান, ইচ্ছে করলেই কোনো ট্রেনচালক, গার্ড, মাঠপর্যায়ে থাকা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটাতে পারেন না।
রেলপথ, লেভেলক্রসিং, রেলব্রিজ চরম জরাজীর্ণ- এসবের দায়িত্বে যেসব কর্মকর্তা রয়েছেন- তারাই এমন দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।
২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় মহানগর গোধূলি এবং চট্টলা এক্সপ্রেসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৫ জন নিহত এবং অর্ধশতাধিক যাত্রী আহত হন।
ওই দুর্ঘটনায় রেলওয়ের পক্ষ থেকে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। রিপোর্ট অনুযায়ী একজন চালককে বরখাস্ত করা হয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাউকে দায়ী করা হয়নি।
কিন্তু সেই দুর্ঘটনার কারণ এবং প্রকৃতপক্ষে দায়ীকে তা অনুসন্ধান করেন বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের একাধিক শিক্ষক।
অনুসন্ধান রিপোর্ট রেল বিভাগে জমাও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু রিপোর্টে যেসব কারণ, প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল, তার কোনোটাই বাস্তবায়ন হয়নি।
অবসরপ্রাপ্ত রেলওয়ের এক মহাপরিচালক যুগান্তরকে জানান, রেলে যেসব দুর্ঘটনা হচ্ছে তার কারণগুলোর মধ্যে জরাজীর্ণ রেলপথ এবং আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া রেল ইঞ্জিন ও কোচ এবং বৈধ-অবৈধ লেভেলক্রসিং অন্যতম।
এছাড়া দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ রেলপথ, ইঞ্জিন, কোচ ও লেভেলক্রসিং মেরামতে চরম দুর্নীতি হয়। এসব রক্ষণাবেক্ষণে রেলে একটি চক্র গড়ে উঠেছে।
নামমাত্র যন্ত্রাংশ লাগিয়ে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট অসৎ কর্মকর্তারা।
ইতোমধ্যে রেলের একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালকসহ প্রায় ৪০ জন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটি তাদের সুপারিশসহ রিপোর্ট পেশ করেছে। কিন্তু দায়ীদের বিরুদ্ধে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।