ধরুন আপনি কোন শরণার্থী শিবিরে আছেন যেখানে নিরাশা, খাবারের অভাব, অন্যের বোঝা হয়ে থাকার হীনমন্যতা অনুভব করবেন না- তাই কখনো হয়! এছাড়া পরিবার ছেড়ে চলে যাওয়া, মৃত্যু ঝুঁকি, ধর্ষণ বা পাচার হওয়ার ভয় সর্বদা আপনাকে গ্রাস করবে। অথবা কয়েক মাস সমুদ্রের পানিতে ভেসে থেকে এমন কারো কাছে পৌঁছাতে চাইছেন যিনি আপনার স্বামী, কিন্তু তাকে আপনি কোনদিন দেখেনও নি- কেমন হবে আপনার মনের অবস্থা একবার কল্পনা করেন তো! জানি এমন একটা দৃশ্য আপনি কখনো মনে করতে চাইবেন না। কিন্তু এমনসব অনিশ্চিয়তা এবং ভয়ের মধ্যে দিয়ে এক একটি দিন পার করছেন বাংলাদেশের কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে থাকা কয়েক লাখ রোহিঙ্গা নারী। আজ তাদের জীবনে নিজস্ব, পছন্দ বলে নেই কোন শব্দ।
এই সব নারী মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর চালানো নৃশংস অত্যাচার থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে অবস্থান করছেন। কিন্তু সেখানেও তারা যেন এই নির্মম বাঁধন থেকে মুক্ত হতে পারছেন না। সম্প্রতি বার্তা সংস্থা এএফপি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা নারীদের এমনই দুর্দশার গল্প শুনিয়েছেন স্থানীয় রোহিঙ্গা নারীরা।
ক্রমবর্ধমান ও জনাকীর্ণ শরণার্থী শিবিরগুলোতে নারীদের অবস্থার এমন অবনতি হওয়ায় রোহিঙ্গা বাবা-মা তাদের মেয়েদেরকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা মালেশিয়ায় অবস্থান করা পুরুষদের সাথে বিবাহের ব্যবস্থা করছেন। অনেক সময় মোবাইলে বা ভিডিও অ্যাপ ব্যবহার করে এই বিয়ে সম্পন্ন করা হয়। তবে এই বিষয়ে নারীদের খুব কমই কথা বলা জায়গা থাকে।
এই বিবাহের সম্পর্কটাকে বাস্তবে রূপ দিতে মোবাইলে কথা বলার পাশাপাশি স্বামীর কাছে পৌঁছাতে ভয়ঙ্কর সমুদ্র পথে ভ্রমণেরও সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
এ বিষয়ে জান্নাত আরা নামের এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকলেও, তাদের কাছে আমাকে খাওয়ানো জন্য একটি অতিরিক্ত মুখ হিসাবে দেখা হতো। তাই তারা আমাকে কুয়ালালামপুরে বসবাসকারী রোহিঙ্গা নূর আলমের সঙ্গে বিয়ের কথা বলেছিলেন এবং আমাকে তার কাছে পাঠানোর জন্য ভিন্ন উপায় খোঁজা হচ্ছিল। আমি ছাড়াও আরো সাতজন ভাইবোন রয়েছে আমার। আমার পরিবার বেঁচে আছে মাসে দু’বার করে পাওয়া ২৫ কেজি চাল ভাগাভাগি করে।
পরিবারের চাপাচাপিতে পরে ওই ব্যক্তির সঙ্গে জান্নাতের মোবাইলের মাধ্যমে বিয়ে হয়। পরবর্তীতে তাকে তার স্বামীর কাছে যাওয়ার জন্য আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে চাপ আসতে থাকে এবং এ সময় তিনি বেরিয়ে পড়েন স্বামীর খোঁজে। জান্নাত আরাও লাখো রোহিঙ্গাদের একজন, যারা রাষ্ট্রহীন এবং বৈধভাবে বিদেশ ভ্রমণ করতে পারবেন না। তাদেরকে এমন স্বামীর উপর বিশ্বাস রাখতে বাধ্য করা হয়েছে, যাদেরকে তারা চেনে না বা জানেন না। তাদেরকে পৌঁছে দেয়ার জন্য পাচারকারীদের টাকাও দিয়েছিলেন। জান্নাতকে পাঠানোর গোপন পথটা এমন ছিল, প্রথমে তাকে রিকশায় করে বন্দরে নেয়া হয় এবং একটি জরাজীর্ণ একটি ট্রলারে তোলা হয়। কিন্তু মালয়েশিয়া সরকার এই অবৈধ প্রবেশে বাধা দেয়। দীর্ঘ দুটি মাস সমুদ্রে ভেসে এবং বহু মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু দেখার পর যে জায়গা থেকে শুরু করেছিল আবার সেই জায়গায় ফিরে আসেন বলে জানান রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাসকারী ২০ বছর বয়সী জান্নাত।
পারিবারিকভাবে বিবাহ সম্পন্ন করা রোহিঙ্গাদের একটি ঐতিহ্য। কিন্তু বর্তমান সময়ে বাংলাদেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে যৌতুক প্রথা প্রচলিত। স্বল্প আয়ের পরিবারগুলো সেই যৌতুক পরিশোধ করতে হিমশিম খায়। এ জন্য তারা ভার্চ্যুয়াল বিয়ের মধ্য দিয়ে এর সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছে।
মাত্র ১৮ বছর বয়সী সোমুদা বেগমকে বিয়ের জন্য খুব বেশি বয়সী বলে মনে করেন তার আত্মীয়স্বজন। বিয়ের জন্য শরণার্থী শিবিরে কয়েকটা পরিবার থেকে প্রস্তাব এলেও তারা প্রচুর অর্থ যৌতুক দাবি করছিলো। যেটা তার গরিব বাবার পক্ষে দেয়া সম্ভব হয়নি বলে জানান সোমুদা বেগম। তার ভাষায়- তাই পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় আমাকে ভার্চ্যুয়াল বিয়ে দিয়ে মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দেয়াটা ভালো হবে। মোহাম্মদ লেদুর ১১ সন্তানের মধ্যে সোমুদা একজন। বিয়ের আগে সোমুদাকে তার সম্ভাব্য স্বামীর একটি ছবি দেখানো হয়। আর বিয়ে ওই ভিডিওকলের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়, যেখানে মোবাইল স্ক্রিনের এক পাশে একজন ইমাম এবং অপরপাশে তার স্বামী বন্ধুদের নিয়ে উপস্থিত ছিলেন।
সোমুদা বলেন, মা এবং প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আমার অনেক বয়স হয়েছে গেছে এই কথাটি শুনতে শুনতে হতাশায় ভুগতে শুরু করি। যেখানে আমার বলার কিছুই ছিলো না। তাই এই বিয়ের পর থেকে আমি কিছুটা আনন্দ অনুভব করি যে, অবশেষে এই বেষ্টনি থেকে বেরিয়ে নিজের একটি পরিবার শুরু করতে পারবো।
সোমুদার পিতা লেদু ৩০ হাজার টাকায় একটি দালালচক্রের সঙ্গে চুক্তি করেন- যারা তাকে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাবে। এরপর দালাল সোমুদাকে নৌকায় নিয়ে গেল এবং তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নেয়। তবে শেষ পর্যন্ত সোমুদা মালয়েশিয়ায় তার স্বামীর কাছে পৌঁছাতে পারেনি। গন্তব্য থেকে সরে এসে তারা দুই মাস সমুদ্রে ভাসতে থাকে এবং একসময় বাংলাদেশি কোস্টগার্ড বাহিনী তাদের উদ্ধার করে। লেদু বলেন, আমরা ভেবেছি সোমুদার তার স্বামীর সাথে সুখে সংসার করছে। কিন্তু এটা শুধু আমাদের স্বপ্নই ছিলো। এখন ওই দালালরা টাকা ফেরতও দেবে না কোনদিন।
বেসরকারি সংস্থা আরাকান প্রজেক্টের পরিচালক ক্রিস লেওয়া বলেন, বৌদ্ধ প্রধান দেশ মিয়ানমার ২০১৭ সালে প্রায় ১০ লাখ সংখ্যালঘু মুসলিমদের সামরিক নৃশংসতার মাধ্যমে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিলো। এরাই বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে জীবনধারণের কঠিন যুদ্ধে। এই পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের চলাচলে কঠোর বিধিনিষেধ রয়েছে। এই অবস্থা থেকে বের হতে মানবপাচার গোষ্ঠীটি রোহিঙ্গাদের নৌপথে বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে নারীপাচারকে তাদের অন্যতম পন্থা হিসেবে নিয়েছে বলেও জানান ক্রিস লেওয়া।
রোহিঙ্গা নারীদের জীবনে এখন আর পছন্দ অপছন্দ বলে কোন বিকল্প নেই। তাদেরকে তাদের পরিবারের চাপে অল্প বয়সে বিয়ে করতে হচ্ছে, জীবনের মায়া ত্যাগ করে অনিশ্চিত সমুদ্র যাত্রায় নামতে হচ্ছে। শিবিরের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে এবং যৌনকর্মী হিসাবে বিক্রি করা হচ্ছে। এই নারীদের জীবনের নিরাপত্তা নেই। নেই তাদের কোন স্বপ্ন।
😥😥😥😥 আল্লাহ যেন ওদের সমস্যা সমাধান করে তারাতারি।🤲