বিগত কয়েক দশকে ভারতের কৌশলগত অবস্থান নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। সাধারণভাবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সাথে লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকলেও, বর্তমানে ভারত চিন্তিত চীনের সামরিক বাহিনীর বিপুল গতিতে বিস্ময়কর আধুনিকায়নে।
দুর্বল অক্ষম বিমান বাহিনী, গত শতকের সামরিক কলাকৌশলেই আবদ্ধ থাকা সেনাবাহিনী এবং কাগজে-কলমে উন্নত কিন্তু চীনা নৌবাহিনীর তুলনায় যোজন দূরে পিছিয়ে থাকা নৌবাহিনী নিয়ে ভারত শেষ পর্যন্ত তার ঘাটতি উপলব্ধি করছে।
গত বছরে লাদাখে দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষের পর ভারত এই ঘাটতিগুলো শনাক্ত ও নিজস্ব সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়।
উত্তরে কারাকোরাম পর্বতমালা ও দক্ষিণে জংস্কর পর্বতমালার মাঝে ভারত নিয়ন্ত্রিত লাদাখের অবস্থান। এর পশ্চিমে পাকিস্তানের সাথে এবং পূর্বে চীনের সাথে ভারতের সীমান্ত রয়েছে। শুষ্ক ও রূক্ষ ভূখণ্ড হওয়ার পরেও বহু শতাব্দীর প্রাচীন রেশম সড়কের অংশ ছিল এই অঞ্চল। প্রাচীন বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য এই ভূমির দখল নিতে লড়াই করেছে ইরানি, তিব্বতি ও রুশসহ বিভিন্ন সাম্রাজ্য।
ভারত, চীন ও পাকিস্তান, তিনপক্ষেরই গুরুত্বপূর্ণ এই ভূখণ্ডে রয়েছে বাণিজ্যিক ও কৌশলগত স্বার্থ। লাদাখের সাথে আবার রয়েছে ভারত দখলকৃত কাশ্মির ভূখণ্ডের সীমান্ত। একসময় একত্রে স্বায়ত্বশাসনের অধীনে থাকলেও ২০১৯ সালে ভারতীয় সংবিধানের পরিবর্তন করে অঞ্চলটির স্বায়ত্বশাসন কেড়ে নেয়া হয়। সাথে সাথে জম্মু ও কাশ্মিরের থেকে লাদাখকে বিচ্ছিন্ন করে দুই ভূখণ্ডকে আলাদাভাবে সরাসরি কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে নিয়ে আসা হয়।
ভারতের সাথে প্রতিবেশী দুই দেশের সংঘর্ষের অন্যতম কেন্দ্র লাদাখ ভূখণ্ড। চীনের সাথে ভারতের সাম্প্রতিক উত্তেজনায় লাদাখ পরিণত হয়েছে সংঘর্ষের কেন্দ্রভূমি হিসেবে।
গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে যেকোনো সংঘর্ষে ভারত বিভিন্ন দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও তার রয়েছে বিপুলতর ঘাটতি।
দুর্বল বিমান বাহিনী
আমলাতন্ত্র, সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ ব্যবস্থাপনা, সংকুচিত হয়ে আসা প্রতিরক্ষা বাজেটে ভাগ নিয়ে বাহিনীগুলোর বিতর্ক এবং সরকারের পাকিস্তান ও চীনকে কেন্দ্র করে বারবার কৌশলের পরিবর্তনের ফলে সামরিক বাহিনী দ্বিধাগ্রস্ত।
প্রতিরক্ষা বাজেটের বেশিরভাগ অংশ ঐতিহ্যগতভাবেই সেনাবাহিনীর হাতে যাওয়ায় ভারতীয় বিমান বাহিনী বিভিন্ন দিক থেকেই প্রচণ্ড দুর্বলতা ও অক্ষমতায় মারাত্মকভাবে ভুগছে। পূর্ণ শক্তি নিয়ে ভারতীয় বিমান বাহিনী ৪২ স্কোয়াড্রন বিমান পরিচালনা করতে পারলেও বর্তমানে কার্যকর আছে ৩১টি স্কোয়াড্রন।
পুরনো মিগ-২১ বিমান নিয়েই এখনো চলছে ভারতের বিমান বাহিনীর কার্যক্রম । ২০১৯ সালে কাশ্মিরে উত্তেজনার মধ্যে পাকিস্তানি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান সহজেই ভারতীয় মিগ-২১ কে ধ্বংস করে। ওই সময় বিমানটির ভারতীয় পাইলটকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানি টেলিভিশনে দেখানো হয়। এই ঘটনা ভারতকে চরম লজ্জার মুখে ফেলে দেয়।
এছাড়াও ভারতীয় বিমান বাহিনী আরো বিভিন্ন দিক থেকে এখনো পিছিয়ে আছে।
পুরনো যুদ্ধকৌশলে আবদ্ধ সেনাবাহিনী
নিজস্ব প্রযুক্তিতে ট্যাঙ্ক তৈরির প্রকল্প ‘অর্জন’ চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তিন দশকের আমলাতান্ত্রিক জটিলতাপূর্ণ ও ব্যয়বহুল প্রকল্পের যে ফলাফল এসেছে, তাতে ব্যবহারের অনুপযোগী ও যান্ত্রিক ত্রুটিযুক্ত এই ট্যাঙ্কগুলো সেনাবাহিনীকে সুবিধা দেয়ার বদলে বদলে তা বোঝায় পরিণত হয়েছে।
ট্যাঙ্ক মোতায়েনের পুরনো কৌশলে যুদ্ধে অভ্যস্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর নীতি নির্ধারকরা বর্তমানে যুদ্ধের কৌশল উপলব্ধি করতে যথেষ্ট বিলম্ব করেছেন। মাত্র কিছুদিন আগে আন্তঃবাহিনীর যৌথ অভিযানের কৌশল তারা রপ্ত করেছেন এবং বিশেষ বাহিনী ও দুরপাল্লার নিঁখুত নিশানার অস্ত্রের ওপর তারা জোর দিয়েছেন।
তবে ভারতীয় সেনাবাহিনী এখনো এই কৌশলকে আত্মস্থ করতে পারেনি।
ভারত এখনো তাদের সেনাবাহিনীর কোল্ড স্টার্ট নীতিমালার আকস্মিক আক্রমণের কৌশল মাথায় রেখেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সাজিয়ে রেখেছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই কৌশলের আওতায় যেকোনো হামলার মোকাবেলায় সাঁজোয়া যানের বিশাল বহর নিয়ে দেশটির মাঝে ঢুকে পড়ে সম্পূর্ণ দুই ভাগ করে ফেলার পরিকল্পনা রাখা হয়েছে। কিন্তু চীনের ক্ষেত্রে এই কৌশল হবে সম্পূর্ণ অকার্যকর।
কেননা চীনের সাথে পাহাড়ি সীমান্তে ট্যাঙ্কের গতি সমান থাকবে না। তাছাড়া চীনের পাহাড়ি অঞ্চলে লড়াইয়ে প্রশিক্ষিত এবং নিঁখুত নিশানার অস্ত্র ও ভ্রাম্যমাণ কামানধারী সেনাবাহিনীর সাথে সাথে উন্নততর বিমান বাহিনীর মোকাবেলা করে বেশি দূর এগুতে পারবে না ভারতীয় ট্যাঙ্ক।
রাশিয়ার সাথে ২০১৮ সালে পাঁচ দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলারের পাঁচ স্কোয়াড্রন এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা মিসাইল ব্যবস্থা পাওয়ার চুক্তি স্বাক্ষরের পর ইসরাইলের কাছ থেকে ড্রোন প্রযুক্তি নিয়েছে ভারত। ইতোমধ্যে ৯০টি ইসরাইলি হ্যারোন ড্রোন ভারতের সেনাবাহিনীর হাতে এসেছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এমকিউ-৯ রিপার আর্মার্ড ড্রোন পাওয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
পাহাড়চূড়ায় সামরিক সরবরাহ
বছরের পর বছর চীন ও ভারত সীমান্তের দুই পাশে যোগাযোগের জন্য সড়ক ও সেতুর উন্নতি করছে, যাতে জরুরি প্রয়োজনের সেনাবাহিনীর কাছে সরবরাহ সম্ভব হয়। এই ক্ষেত্রে চীন ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে। সীমান্ত পর্যন্ত উচ্চ গতির রেল সংযোগ জরুরি যেকোনো মুহূর্তে বিপুল গোলাবারুদ ও অন্য সরবরাহ নিয়ে আসতে পারে। পাশাপাশি মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (মাইনাস ২২ ডিগ্রি ফরেনহাইট) তাপমাত্রায় মানিয়ে নিতে সেনাবাহিনীর জন্য উষ্ণ তাপমাত্রার স্থাপনা তৈরি করেছে চীন।
অপরদিকে পাহাড়ি এলাকার ভূমিগত গঠনের কারণে সড়ক তৈরি করতে গিয়ে লাদাখে বিপত্তির মুখে পড়েছে ভারত। পাশাপাশি খাবার পানির অপ্রতুলতাও সমস্যা হিসেবে কাজ করছে ভারতীয় সৈন্যদের জন্য। হেলিকপ্টারে করে কিছু সরবরাহ চালু থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম।
অপ্রয়োজনীয় বোঝা তলিয়ে যাওয়া নৌবাহিনী
ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য বিমানবাহী নৌবহর পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ২০১২ সালে প্রতিরক্ষা বাজেটের ১৮ ভাগ বরাদ্দ থেকে ২০২০ সালে এসে এই বরাদ্দ দাঁড়িয়েছে ১৩ ভাগে।
বর্তমানে ভারতের হাতে সোভিয়েত আমলের পুরনো একটি বিমানবাহী রণতরী ’আইএনএস বিক্রমাদিত্য’ রয়েছে। দ্বিতীয় বিমানবাহী রণতরী ‘আইএনএস বিক্রন্তকে’ পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হচ্ছে এবং ২০২২ সালে শুরুতে তা নৌবাহিনীর সাথে যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে।
দুই বিমানবাহী নৌযানেই খরচের সীমা ইতোমধ্যেই মাত্রা ছাড়িয়েছে এবং তৃতীয় বিমানবাহী রণতরী ‘আইএনএস বিশাল’ শুধুই কল্পনার জগতে রয়েছে। এরমধ্যেই ভারতে বিমানবাহী নৌযানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে যেখানে সীমিত শক্তির সংঘাতে ছোট নৌযান, ড্রোন ও হাইপারসোনিক মিসাইল ব্যবহার হবে, সেখানে বিমানবাহী রণতরী অপ্রয়োজনীয় বোঝায় পরিণত হয়েছে।
চীন সমুদ্রসীমা রক্ষায় নৌযান তৈরির বিশাল প্রকল্প চালু করেছে এবং ভারতীয় নৌবাহিনীর তুলনায় উন্নত নৌযান তৈরি করছে। নিজস্ব দুইটি বিমানবাহী রণতরী সংগ্রহের পাশাপাশি চীনা নৌবাহিনী মনোযোগ দিয়েছে ছোট, দ্রুতগতিসম্পন্ন, ভারী অস্ত্রবাহী ও নিজস্ব নেটওয়ার্কে যুক্ত নৌযান তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছে, যা ভবিষ্যতের যুদ্ধকৌশলে বেশি কাজে আসবে।
ভারত মহাসাগর নিয়ন্ত্রণের লড়াই
চীনা বাণিজ্যের মূল পথটিই চলে গেছে দক্ষিণ চীন সাগর হয়ে আন্দামান সাগর ও সংকীর্ণ মালাক্কা প্রণালীর ভেতর দিয়ে। গুরুত্বপূর্ণ এই পথটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সবধরনের প্রচেষ্টাই নিয়েছে চীন।
ভারত মহাসাগরে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে বিপুল অবকাঠামো ও বন্দর প্রকল্প হাতে নিয়েছে চীন। মালদ্বীপে ভারত সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় থাকায় সেখানে কোনো প্রভাব বিস্তারে ব্যর্থ হয় চীনা সরকার। মিয়ানমারেও চীন তার জন্য স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। দেশটির বন্দর উন্নয়নে চীনের অবদান মিয়ানমারে চীনের জাহাজের অবাধ যাতায়াত ও প্রয়োজনে আশ্রয় নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
ভারতও নিজের জন্য মালাক্কা প্রণালীর কাছে নিজস্ব আশ্রয় ঘাঁটির জাল বিস্তার করেছে। পাশাপাশি জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিলে চীনের প্রভাব বিরোধী চারদেশের একটি জোট গঠন করেছে। গত বছরের নভেম্বরে চারদেশ একত্রে পূর্ব ভারত মহাসাগরে নৌ মহড়া করেছে।
চীনের মোকাবেলায় ভারত তার দুর্বলতা উপলব্ধি করছে। তবে এই দুর্বলতা ও ঘাটতি পূরণ করতে পারবে কি না, তা জানার জন্য সময়ের অপেক্ষা করতে হবে।
সূত্র : আলজাজিরা।