‘ভালবাসা’ পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর কোমল দুরন্ত মানবিক অনুভূতি। এই ভালবাসা গড়ে উঠে পিতা মাতা, ভাই বোন, আত্মীয় স্বজন এবং স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে। স্বামী স্ত্রীর ভালবাসার অকৃত্রিম বন্ধন গড়ে উঠে বিবাহের পর।
যদি কোনো সমাজে পারিবারিক সম্পর্কের বাইরে নারী-পুরুষের অবৈধ সম্পর্কের ভালোবাসা সহজলভ্য হয়ে যায়, তবে সে সমাজে সুখি পরিবার গঠন ও সংরক্ষণ অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং ক্রমান্বয়ে সে সমাজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। তাই সকল আসমানী ধর্মগ্রন্থ ও সভ্য মানুষ ব্যভিচার ও বিবাহপূর্ব ভালোবাসা জঘন্য পাপ বলে গণ্য করেছেন।
১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন দিবস বর্তমানে ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’ নামে ব্যাপক উদ্দীপনার সাথে আমাদের দেশেও পালিত হয়। মূলত দিবসটি ছিল প্রাচীন ইরোপীয় গ্রীক-রোমান পৌত্তলিকদের একটি ধর্মীয় দিবস। ভারতীয় আর্যদের মতই প্রাচীন রোমান পৌত্তলিকগণ মধ্য ফ্রেব্রুয়ারি বা ১লা ফাল্গুন ভূমি ও নারী উর্বরতা, নারীদের বিবাহ ও সন্তান কামনায় প্রাচীন দেবদেবীদের বর লাভ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বিভিন্ন নগ্ন ও অশ্লীল উৎসব পালন করত; যা লুপারকালিয়া উৎসব নামে প্রচলিত ছিল। ইউরোপে খ্রিস্টান ধর্ম রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা লাভের পরেও এ সকল অশ্লীল উৎসব অব্যাহত থাকে।
সংঘাতময় এ পৃথিবীকে মানুষের বসবাসযোগ্য করার জন্য হালাল ভালোবাসার প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠার কতই না প্রয়োজন! কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের’ নামে শুধু যুবক-যুবতীদের জৈবিক ও বিবাহপূর্ব বেহায়াপনার দিকে যে উস্কে দিচ্ছে তা নয় বরং তাদের বয়সের উন্মাদনাকে পুঁজি করে, কতিপয় গোষ্ঠী তাদেরকে অশ্লীলতার পঙ্কিলতার মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থসিদ্ধি হাসিল করতে চায়।
ভালোবাসা দিবসের নামে যা কিছু করা হয় সবই অশ্লীলতা, যা অধিকাংশ সময়ে চূড়ান্ত ব্যভিচারের মধ্যে নিমজ্জিত করে। আর এ ভয়ঙ্কর পাপের জন্য দুনিয়াতে যেমন রয়েছে ভয়াবহ গযব তেমনি আখিরাতেও রয়েছে ভয়ঙ্কর শাস্তি। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন-
لَمْ تَظْهَرِ الْفَاحِشَةُ فِي قَوْمٍ قَطُّ، حَتَّى يُعْلِنُوا بِهَا، إِلَّا فَشَا فِيهِمُ الطَّاعُونُ، وَالْأَوْجَاعُ الَّتِي لَمْ تَكُنْ مَضَتْ فِي أَسْلَافِهِمُ الَّذِينَ مَضَوْا
“যখন কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, তারা প্রকাশ্যে অশ্লীলতায় লিপ্ত হতে থাকে, তখন তাদের মধ্যে এমন সব রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে যা তাদের পুর্বপুরুষদের মধ্যে প্রসারিত ছিল না।” (সহীহুল জামি, খন্ড-২, পৃ. ১৩২১)
ইসলাম শুধু ব্যভিচারকেই নিষিদ্ধ করেনি, বরং ব্যভিচারের নিকটে নিয়ে যায় এমন সকল কর্মকে কঠিনভাবে নিষিদ্ধ করেছে। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
وَ لَا تَقۡرَبُوا الزِّنٰۤی اِنَّہٗ کَانَ فَاحِشَۃً ؕ وَ سَآءَ سَبِیۡلًا ﴿۳۲﴾
“তোমরা নিকটবর্তী হয়ো না ব্যভিচারের, নিশ্চয় তা অশ্লীল এবং নিকৃষ্ট আচরণ।” (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত: ৩২)
ব্যভিচারের পথ রোধের অন্যতম দিক চক্ষু সংযত করা, ননমাহরাম নারী-পুরুষের দিকে বা মনের মধ্যে জৈবিক কামনা সৃষ্টি করার মত কোনো কিছুর দিকে দৃষ্টিপাত না করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
وَ قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنٰتِ یَغۡضُضۡنَ مِنۡ اَبۡصَارِہِنَّ وَ یَحۡفَظۡنَ فُرُوۡجَہُنَّ
“মুমিনদেরকে বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের সম্ভ্রম হেফাজত করে। আর মুমিন নারীদেরকে বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের সম্ভ্রম হেফাজত করে।”
(সূরা আন-নূর, আয়াত:৩০-৩১)
এছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন-
وَعَنْ أَبِيْ هُرَيرَةَ رضي الله عنه: أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم، قَالَ: «كُتِبَ عَلَى ابْن آدَمَ نَصِيبُهُ مِنَ الزِّنَا مُدْرِكُ ذَلِكَ لاَ مَحَالَةَ : العَيْنَانِ زِنَاهُمَا النَّظَرُ، وَالأُذُنَانِ زِنَاهُمَا الاسْتِمَاعُ، وَاللِّسَانُ زِنَاهُ الكَلاَمُ، وَاليَدُ زِنَاهَا البَطْشُ، وَالرِّجْلُ زِنَاهَا الخُطَا، وَالقَلْبُ يَهْوَى وَيَتَمَنَّى، وَيُصَدِّقُ ذَلِكَ الفَرْجُ أَوْ يُكَذِّبُهُ» . متفق عَلَيْهِ . هَذَا لفظ مسلمٍ، ورواية البخاري مختصرَةٌ
“চক্ষুদ্বয়ের ব্যভিচার দৃষ্টিপাত, কর্ণদ্বয়ের ব্যভিচার শ্রবণ, জিহ্বার ব্যভিচার কথা বলা, হাতের ব্যভিচার স্পর্শ করা, পায়ের ব্যভিচার পদক্ষেপ, অন্তরের ব্যভিচার কামনা।”
(মুসলিম, আস-সহীহ, খন্ড-৪, পৃ. ২০৭৪)
মানব সমাজে ব্যভিচার রোধ ও পরস্পর বৈধ ভালোবাসার প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। পারিবারিক কাঠামো ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-ভালোবাসার স্থায়িত্ব বৃদ্ধির জন্য সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তবে এ সকল ভালোবাসার বাণী প্রচারের জন্য ‘ভালোবাসা দিবস’-কে বেছে নেওয়া বৈধ নয়।
এ দিবসে যুবক-যুবতীদের আড্ডা, গল্পগুজব, উল্লাস করা বা অনুরূপ যেকোনো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহপূর্ব ভালোবাসার উস্কানি দেওয়া ভয়ঙ্কর পাপ। কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতী ভালোবাসার নামে অবাধে মেলামেশা বা আড্ডার খপ্পরে পড়লে তাদের মধ্যে এ বিষয়ে অদম্য আগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং ক্রমান্বয়ে তারা অশ্লীলতা, ব্যভিচার ও আনুষঙ্গিক সকল পাপ-পঙ্কিলতার মধ্যে ডুবে যায়।
‘ভালবাসা দিবস’কে কেন্দ্র করে সারা পৃথিবী উন্মাতাল হয়ে উঠে। বাজার ছেয়ে যায় নানাবিধ উপহারে। পার্ক ও হোটেল- রেস্তোরাঁগুলো সাজানো হয় নতুন সাজে। পৃথিবীর প্রায় সব বড় শহরেই ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’-কে ঘিরে পড়ে যায় সাজ সাজ রব। পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি আমাদের দেশেও এখন ঐ অপসংস্কৃতির মাতাল ঢেউ লেগেছে।
বর্তমান অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে স্যাটেলাইটের কল্যাণে মুসলিম সমাজ পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুসরণ করছে। নিজেদের স্বকীয়তা-স্বাতন্ত্র্যকে ভুলে গিয়ে, ধর্মীয় অনুশাসনকে উপেক্ষা করে তারা আজকে প্রগতিশীল হওয়ার চেষ্টা করছে।
মুসলিম সমাজে এক সময় নীতি-নৈতিকতার মূল্য ছিল সীমাহীন। লজ্জাশীলতা ও শুদ্ধতা ছিল এ সমাজের অলংকার। কোন অপরিচিত মেয়ের সাথে রাস্তায় বের হবার চেয়ে পিঠে বিশাল ভার বহন করা একটা ছেলের জন্য ছিল অধিকতর সহজ। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে তা চিন্তা করারও অবকাশ ছিল না। অথচ সেই অবস্থা থেকে আজ আমরা কোথায় এসে পৌঁছেছি! এটা হচ্ছে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’-র মত বেলেল্লাপনার কুফল।
কয়েক বছর পূর্বেও বাংলাদেশে এ দিবসটি পালন করা তেমন দেখা যেত না। কিছু ব্যবসায়ীর মদদে এটি প্রথম চালু হয়। মুসলিম বিদ্বেষী মিডিয়া কর্মীরা এর ব্যাপক কভারেজ দেয়।
ফেব্রুয়ারি মাসে টানা এক সপ্তাহ ধরে যিনাসপ্তাহ পালন করে। শেষ হয় ১৪ই ফেব্রুয়ারি দিয়ে। সেজন্য প্রতিবছরেই ‘কাছে আসার’ সেরা তিন ‘দুর্দান্ত’ গল্পের জন্য সাধারণের কাছে আবেদন ছড়িয়ে দেয় ক্লোজআপ। দেশে প্রচারিত প্রথম আলোর মত দৈনিকে নির্লজ্জের মত বিশাল করে এক ছেলে আর এক মেয়ের অশ্লীল ভঙ্গিমা তুলে ধরে। প্রথম আলো, কালের কণ্ঠের মত সেক্যুলার প্লাটফর্মগুলো বেহায়ার মত অশ্লীলতাগুলোকে একেবারে প্রথম পেজে ছাপিয়ে যায়। এই যে Close up, প্রথম আলোর এতসব জিনার ‘দুর্দান্ত’ গল্পের আয়োজন; Lux, চ্যানেল আই, প্রথম আলোর (আবার!) নারীদের অদেখাকে দেখার আয়োজন করে।
আমার দেহ আমার সিদ্ধান্ত! ‘দুটি স্বাধীন মানুষের মন চাইলেই অবৈধ মেলামিশা করতে পারবে’ এজাতীয় প্রচারণা গুলো আজ ব্যাপকভাবে করা হচ্ছে । এগুলোর মাধ্যমে সমাজের রন্ধে রন্ধে অশ্লীলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
ক্লোজআপের পক্ষ থেকে ৯ ই ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬ ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যিনাকার কাপলদের জন্য ফ্রিতে রাইডের ব্যবস্থা করে দেয়। ক্লোজ আপ কাছে আসার গল্প শোনালেও পরের গল্পগুলো আর শোনায় না।
নারী পুরুষের অবাধ মেলামিশায় অবৈধ গর্ভধারণ হচ্ছে। যিনার মাধ্যমে গর্ভে আসা সন্তানকে মেরে ফেলতে অনেক মেয়েরা অ্যাবরশনের মত অমানবিক পন্থার আশ্রয় গ্রহণ করছে। যে মাধ্যমে গর্ভের সন্তানকে আঘাত করতে করতে হত্যা করা হয়। পরে বিভিন্ন অঙ্গ কেটে কেটে বের করা হয় ।
‘প্রথম আলোতে প্রকাশিত ২০১৪ সালের জরিপ বলছে, দেশে বছরে ১১ লাখ ৯৪ হাজার স্বপ্রণোদিত গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ, দৈনিক গড়ে এ ধরনের গর্ভপাতের সংখ্যা ৩ হাজার ২৭১টি।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গুটম্যাকার ইনস্টিটিউট ২০১৪ সালে এই জরিপ করেছিল।
জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ১ হাজার নারীর মধ্যে ২৯ জন স্বপ্রণোদিত গর্ভপাত করায়।
স্বপ্রণোদিত গর্ভপাতের হার বাড়ছে বলে জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। একই বয়সী নারীদের মধ্যে ২০১০ সালে গর্ভপাতের হার ছিল ১৭। অর্থাৎ, ১ হাজার নারীর মধ্যে ১৭ জন গর্ভপাত করাতেন। যা বর্তমানে বহু গুনে বেড়ে গেছে।’
আর যাদের সন্তান প্রসব হয়ে যায় তারাও সেই অবৈধ সন্তানকে ডাস্টবিনে, ময়লা আবর্জনায় ফেলে আসে। অনেক নবজাতককে পাওয়া যায় রাস্তার পাশে । পাওয়া যায় পলিথিনে মোড়ানো যাকে কুকুর টানছে ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য । ক্লোজ আপ, প্রথম আলো, কালের কণ্ঠের মত সেক্যুলার প্লাটফর্মগুলোর জন্যই সমাজে অবৈধ গর্ভধারণ বেড়ে গেছে। ফলে এত এত শিশুদের খুন করা হচ্ছে। শিশুদের মারার অধিকার এদের কে দিলে? এরাই নিষ্পাপ শিশুদের খুনি । এগুলোর দায়ভার এদেরকেই নিতে হবে ।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
اِنَّ الَّذِیۡنَ یُحِبُّوۡنَ اَنۡ تَشِیۡعَ الۡفَاحِشَۃُ فِی الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ۙ فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ ؕ وَ اللّٰہُ یَعۡلَمُ وَ اَنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۱۹﴾
“নিশ্চয়ই যারা পছন্দ করে যে ঈমানদারদের মধ্যে অশ্লীলতা/ বেহায়াপনা/ ব্যভিচার/ অনৈতিকতা প্রসার লাভ করুক, তাদের জন্যে ইহাকাল ও পরকালে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।” [সূরা আন-নূর, ১৯]
লেখক: উসামা মাহমুদ, প্রতিবেদক, আল-ফিরদাউস নিউজ।
মহান আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা আমাদেরকে বেহায়াপনা,বেলেল্লাপনা,অশ্লীলতা, ব্যভিচার ইত্যাদি অনৈসলামিক ঈমান বিধ্বংসী কাজকর্ম থেকে হিফাযত করুন,আমীন ইয়া রব্বাল ‘আলামীন।