১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণ করেন শেখ মুজিব। ক্ষমতা পেয়েই মুজিব তার নিকট আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজনদের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পেয়ে তাদের অনেকেই জড়িয়ে পড়ে চোরাচালান ও মজুতদারির মতো অপরাধে। মুজিবের ছত্রছায়ায় তারা এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেন যে আইনও তাদের নাগাল পেতো না। তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারাই ছিল মজুতদারির নেপথ্যে আর মুজিব আমলে দুর্নীতি সর্বোচ্চ সীমা ছাড়িয়ে যায়। শেখ মুজিবের একটা উদ্ধৃতি থেকে তৎকালীন দুর্নীতির ভয়াবহতা কিছুটা অনুমান করা যায়। মুজিব বলেছিলেন, ‘ ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সাড়ে সাত কোটি কম্বল, আমার কম্বল কই’।
রেডক্রসের চেয়ারম্যান ও মুজিবের ডান হাত গাজি গোলাম মোস্তফাকে দেশবাসী ‘কম্বল চোর’ বলেই ডাকত। একবার এক অনানুষ্ঠানিক আলাপচারিতায় ডালিম, শেখ মুজিবকে আওয়ামী লীগের নেতাদের ভয়াবহ দুর্নীতি নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে মুজিব এর জবাবে বলেছিলেন,
“পাক শাসনামলে আমার লোকদের কি দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি? তারা কি ক্ষতির মুখোমুখি হয়নি? তারা কি তাদের সম্পদ-সম্পত্তি হারায়নি? আজ যদি তারা (ক্ষমতাসীন হয়ে) কিছু সুবিধা পেয়ে থাকে তবে তাতে দোষের কী? আমি তাদের প্রতি উদাসীন থাকতে পারি না। যদি কেউ এই বিষয়ে অসন্তুষ্ট হন সে জন্য আমার কিছু করার নেই।”
এভাবেই রাষ্ট্রপ্রধান মুজিব, দুর্নীতিবাজদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দান করেন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে বাংলাদেশ যেন দুর্নীতি আর অপরাধের এক টুকরো দোজখে পরিণত হয়েছিল। মুজিবের সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বিপুল পরিমাণ পাট, খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য আমদানিকৃত সামগ্রী ভারতে পাচার করা হয়। যার বাজারমূল্য ৬০০০ কোটি টাকা। মুজিবের প্রতিশ্রুতি ছিল স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে পাকিস্তানের অর্ধেক দামে চাল বিক্রি হবে। অথচ ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে ইয়াহিয়া আমলের চেয়েও দশগুণ বেশি দামে চাল বিক্রি হয়েছে।
ভারতের সীমান্ত খুলে দিলে পাচার আরও বেড়ে যায়। ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে আরো ২০০ কোটি ডলারের অধিক সম্পদ ভারতে চালান হয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশ সম্পূর্ণরূপে দেউলিয়া হয়ে পড়েছিল। সাংবাদিক আবু মুসা এ প্রসঙ্গে বলেন,
“তিনি (মুজিব) সবকিছু দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং তিনি সকলের সাথেই (সাধারণ মানুষ) বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন”।
রাষ্ট্রপতি মুজিব নিজেকে চাটুকার দিয়ে ঘিরে ফেলেছিলেন, মুজিব হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী তাহিরউদ্দিন ঠাকুর ছিলেন মুজিব সরকারেরই তথ্য প্রতিমন্ত্রী। এই দুর্নীতিবাজ চাটুকাররা মুজিবের পা স্পর্শ করার আচারও শুরু করেছিল। এরপরে মুজিব “যারা তার পা স্পর্শ না করার ‘স্পর্ধা’ দেখাত, তাদের নাম গুরুতরভাবে নোট করতেন।”
শেখ মুজিব চেয়েছিলেন, বড় ছেলে জামালকে উচ্চপদস্থ সেনা অফিসার বানিয়ে সেনাবাহিনীকে নিজের কুক্ষিগত করে রাখতে। এজন্য জামালকে যুগোস্লাভ মিলিটারি একাডেমিতে প্রেরণ করেন, কিন্তু সে প্রশিক্ষণ গ্রহণে অক্ষম প্রমাণিত হয় এবং অসম্পূর্ণ অবস্থায় ফিরে আসে। এরপরও মুজিব হাল না ছেড়ে তাকে অন্য মিলিটারি একাডেমিতে প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর তিনি জামালকে ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্ট মিলিটারি একাডেমিতে প্রেরণ করেন। একাডেমি জামালকে এই শর্তে ভর্তি করাতে রাজি হয় যে তাদেরকে মোটা অংকের প্রশিক্ষণ ফি প্রদান করতে হবে। এজন্য তৎকালীন মূদ্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অবৈধভাবে প্রদান করেন প্রেসিডেন্ট মুজিব।
অপরদিকে, দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। এমনকি রাজধানী ঢাকা শহরও সন্ত্রাসীদের চারণভূমিতে পরিণত হয়। বাজারের গয়নার দোকান, অন্যান্য দোকানের নগদ অর্থ থেকে শুরু করে কোনো মূল্যবান জিনিস লুটেরাদের হাত থেকে রক্ষা পেতো না। ১৯৭২ সালের জানুয়ারী থেকে ১৯৭৩ সালের জুন পর্যন্ত সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে ২০৩৫টি গুপ্তহত্যা, ৪৯২৫টি হত্যা, ৩৩৭ অপহরণ, ১৯০টি ধর্ষণ এবং ৪৯০৭ টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছিল এবং ৬০০ টি থানার অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করা হয়েছিল। সাধারণ মানুষের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। রাস্তাগুলো সশস্ত্র গোষ্ঠী ও ডাকাতের আখড়ায় পরিণত হয়। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী নেতারা নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে নতুন করে আরও ব্যক্তিগত সশস্ত্রবাহিনী গড়ে তোলার কাজ শুরু করে।
আওয়ামী শ্রমিক লীগের নেতা আবদুল মান্নান ‘লাল বাহিনী’ নামে নিষ্ঠুর প্রকৃতির আধা সামরিক বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। একবার এক জনসভায় মুজিব গর্বের সাথে উল্লেখ করেন, “আমি রাষ্ট্রবিরোধী দুর্বৃত্তদের সতর্ক করে দিচ্ছি। প্রয়োজনবোধে আমি আমার লাল ঘোড়া [লাল বাহিনী] ছেড়ে দেবো। ”
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বাইরে মুজিব ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী গড়ে তোলার কাজে হাত দেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, জয় বাংলা বাহিনী, লাল বাহিনী এবং অন্যান্য বাহিনী নিয়ে বহু পরীক্ষার পরে তিনি গড়ে তুলেন ‘জাতীয় রক্ষী বাহিনী’ নামক বর্বর বাহিনী। সামরিক প্রশিক্ষণ, সেনা স্টাইলের ইউনিফর্ম, ইস্পাত হেলমেট এবং আধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসহ ২৫০০০ সদস্যের সমন্বয়ে এই বাহিনী গড়ে তোলা হয়। বাহিনীটির তুলনা চলে হিটলারের নৃশংস গেস্টাপোর সাথে। ভারতের কুখ্যাত গুপ্তচর সংস্থা ‘র’ এর সাথে রক্ষী বাহিনীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো। এই বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতো ভারতীয় বাহিনী, এর পোশাকও ছিলো ভারতীয় বাহিনীর অনুরূপ। এর ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল পুলিশের সাথে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখা, যদিও এর আসল উদ্দেশ্য ছিল মুজিব ও আওয়ামী লীগের বিরোধী এবং সমালোচকদের নির্মূল করা। এবং বাংলাদেশে ভারত তথা ‘র’ এর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা।
১৯৭৩ সালের ১৮ অক্টোবর মুজিব সরকার ‘জাতীয় রক্ষীবাহিনী (সংশোধনী) অধ্যাদেশ-১৯৭৩’ জারি করে, রক্ষীবাহিনীর সকল নিপীড়নমূলক অন্যায় কার্যকলাপ আইনসঙ্গত বলে ঘোষণা করে। রক্ষীবাহিনীর কোনো সদস্য ‘সরল বিশ্বাসে’ কোনো অপরাধ করলে অথবা ‘সৎ’ উদ্দেশ্যে উক্ত কাজ করে থাকলে অনুরূপ (বিচার বহির্ভূত হত্যা ও গুম) কাজের জন্য তার বিরুদ্ধে বিচারের জন্য কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া যাবে না বলেও ঘোষণা দেয় তৎকালীন মুজিব সরকার। এই আইনের ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়া রক্ষীবাহিনীর হাতে ২৭০০০ মানুষ হত্যার অভিযোগ রয়েছে।
এই সাড়ে তিন বছরে সরকারি তথ্য অনুযায়ী অনাহারে ২৭০০০ হাজার মানুষ মারা যান। বেসরকারি হিসেবে দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা ১০ লাখের উপরে। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে গৃহহীন হত-দরিদ্রদের রাজধানী থেকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হয়, এর ফলে ঢাকায় স্থাপিত তিনটি ক্যাম্পে অনেকে আশ্রয় নেন। এগুলো রক্ষীবাহিনী দ্বারা পরিচালিত হতো, এগুলোর অবস্থা চীনের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে কোনো অংশে ভালো ছিল না। ডাচ স্যালভেশন আর্মির স্বেচ্ছাসেবক গ্রেস স্যামসন বলেছিল:
“এটা(দুর্ভিক্ষ, বিপর্যয়) ঈশ্বরের সৃষ্ট নয়, বরং সরকারের কাজ; এটা মানবসৃষ্ট বিপর্যয়”।
চলবে ইনশা আল্লাহ…
লেখক: রাফিদ ইয়াজভান
আরো পড়ুন:
ফিরে দেখা শেখ মুজিবের শাসনকাল
পর্ব:১ https://alfirdaws.org/2020/12/18/45141/
পর্ব:২ https://alfirdaws.org/2021/01/06/45747/
পর্ব:৩ https://alfirdaws.org/2021/01/09/45858/
পর্ব: ৪ https://alfirdaws.org/2021/01/30/46541/
পর্ব: ৫ https://alfirdaws.org/2021/02/02/46670/
রেফারেন্স:
1/ Bangladesh: Untold facts, Shariful Haq Dalim
2/ Bangladesh in 1975: The Fall of the Mujib Regime and its Aftermath, University of California Press
3/ Bangladesh: A Legacy of Blood, Anthony Mascarenhas
4/ What happened to those who broke up Pakistan in 1971?
5/ ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ, আহমদ মূসা।
ইন্নালিল্লাহ। সংবাদটি পড়ে সত্যি-ই আৎকে উঠেছি!
জালেম,তাগুত,গাদ্দার মুজিবের কন্যা এখন তার বাবার দেখানো পথ ধরেই হাঁটছে। বাবার রেখে যাওয়া অসম্পূর্ণ মিশন সামনে এগিয়ে নিতে সে কাজ করে যাচ্ছে। তবে, তার বাবার মতন তার পতনও অবস্যম্ভাবী!…
একটি কথাঃ আপনারা নিচে যে-ই ইমেইল চেয়েছেন, সেখানে কি আসল ইমেল দিতে হবে? আর আপনাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্যও কি আসল ইমেইল ব্যবহার করতে হবে? জানালে উপকৃত হব। আল্লাহ আপনাদের কাজ গুলোকে কবুল করে নিক। আমীন
একটি কথাঃ আপনারা নিচে যে-ই ইমেইল চেয়েছেন, সেখানে কি আসল ইমেল দিতে হবে? আর আপনাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্যও কি আসল ইমেইল ব্যবহার করতে হবে? জানালে উপকৃত হব। আল্লাহ আপনাদের কাজ গুলোকে কবুল করে নিক। আমীন >>>>
নিজ থেকে বানিয়ে একটি ইমেল দিলেই হবে ইনশাআল্লাহ। আসল ইমেইল দিতে হবে না। আমীন।