নিধনের ফাঁকা বুলি, ঢাকায় মশার ঘনত্ব বেড়েছে চারগুণ

0
486
নিধনের ফাঁকা বুলি, ঢাকায় মশার ঘনত্ব বেড়েছে চারগুণ

ঢাকার সিটি করপোরেশন নির্বাচন এলেই নাগরিক সেবার নানান প্রতিশ্রুতি দেন প্রার্থীরা। সেই তালিকায় সবার ওপরে থাকে মশা নিধন। প্রার্থীদের দেয়া সেই মিথ্যে প্রতিশ্রুতিতে আশায় বুক বাঁধেন নগরবাসী। তবে হতাশার কথা হলো, এখন পর্যন্ত ঢাকার কোনো মেয়রই মশা নিধন বা নিয়ন্ত্রণে সফলতা অর্জন করতে পারেননি। উল্টো দিন যতোই যাচ্ছে, রাজধানীতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মশা। বাড়ছে মশাবাহিত রোগ, এমনকি সেই রোগে ঝরছে প্রাণও।

রাজধানীতে মশার ঘনত্ব নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণার তথ্য বলছে, গত বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বরের তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় মশার ঘনত্ব চারগুণ বেড়েছে। এখন যে মশা দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে ৯০ শতাংশই কিউলেক্স মশা। সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে কিউলেক্স মশার প্রকোপ বাড়ে।

অথচ গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নির্বাচনের আগে মশা নিধনে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নির্বাচিত মেয়রেরা।

ডিএসসিসিতে শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র হওয়ার আগে সংস্থার সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের মশা নিধন কার্যক্রমের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু এক বছরের মাথায় তাকেই সইতে হচ্ছে সেই সমালোচনা।

একইভাবে সমালোচনার মুখে পড়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। মশা নিধনে তিনিও তার প্রতিশ্রুতি যথাযথভাবে রক্ষা করতে পারেননি।

নগরবিদ ও কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, নির্বাচনের আগে মেয়রপ্রার্থীরা মশা নিধন, যানজট নিরসনসহ অনেক প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু এর অধিকাংশই সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। আর যেসব প্রতিশ্রুতি সরাসরি সিটি করপোরেশনের বাস্তবায়ন করার কথা, সেগুলোতেও তারা অনেকাংশ সফল হতে পারেননি। তাই আগে নিজ সংস্থার কাজগুলো ঠিক মত করতে হবে।

মশা নিধনের নামে যতো উদ্যোগ
১৯৯০ সালের আগে ঢাকা সিটি করপোরেশন ‘ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন’ নামে পরিচিত ছিল। পরে নাম পরিবর্তন হয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন করা হয়। ১৯৯৪ সালের ৩০ জানুয়ারি নগরবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে মোহাম্মদ হানিফ ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগের দিন তিনি মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জনসভা করেছিলেন। ওই জনসভায় তিনি নির্বাচনী ইশতেহার চারটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এর মধ্যে মশা নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী পরিকল্পনা ছিল অন্যতম।

২০১৫ সালের এপ্রিলে নির্বাচনী ইশতেহারে ‘মশার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’ করে ডিএনসিসিতে আনিসুল হক ও ডিএসসিসিতে সাঈদ খোকন মেয়র নির্বাচিত হন। এর মধ্যে ২০১৭ সালে আনিসুল হক মারা যাওয়ার পর নগরে ব্যাপকভাবে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ বেড়ে যায়। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকাসহ সারাদেশে এডিস মশার বিস্তার ঘটে।

পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় তা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি করপোরেশনকে হিমশিম খেতে হয়েছে। তখন দুই সিটি করপোরেশনের ওষুধের মান, কেনাকাটায় অনিয়ম, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব অবহেলাসহ অনেক বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন নাগরিকেরা। এমনকি সাঈদ খোকন মেয়র পদে নির্বাচনে দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইলেও না পাওয়ার পেছনে এই মশা নিধনে ব্যর্থতাও দায়ী বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। সরকারি হিসাবে ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ১১১ জন মারা যান।

মশা নিধনের নামে ৪ বছরে ডিএসসিসির ব্যয় ৭৬ কোটি
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হিসাব বিভাগ সূত্র জানায়, (ডিএসসিসি) গত চার বছরে শুধু মশা মারতে ৭৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা খরচ করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রতিবছরই মশা আগের তুলনায় বাড়ছে। এখন চলতি অর্থবছরে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এর মধ্যে গত জুন থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় সাত কোটি টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকার লেক, জলাশয়, পুকুরের পানি অনেক নোংরা। সেখানে প্রচুর জীবাণু রয়েছে। বাস্তবতা না বুঝে হাঁসগুলো ছাড়া হয়েছিল। এরমধ্যে বিদেশি প্রজাতির হাঁসের সংখ্যাই বেশি ছিল। অথচ এসব হাঁস দেখভাল এবং খাবারের ব্যবস্থা করেনি সংস্থাটি। ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অধিকাংশ হাঁস মারা যায়। এখন নগরে কিউলেক্স মশার প্রভাব বাড়লেও ডিএসসিসি তেমন কোনো কর্মসূচি নেয়নি। আগের মতোই মশা নিধন কার্যক্রম ঢিলেঢালাভাবে চলছে।

ডিএনসিসির নোভালুরন ব্যবহৃত এলাকায়ই বেশি মশা
গত বছরের অক্টোবর থেকে কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে গুলশান, বনানী, উত্তরা, মিরপুরের ৬২৯টি লেক, খাল, জলাশয় চিহ্নিত করে ট্যাবলেট বড়ির মত দেখতে নোভালুরন ওষুধ ব্যবহার শুরু করে ডিএনসিসি। মশার প্রজনন ও বংশবিস্তার রোধে ওই ওষুধ ব্যবহার করেছিল বলে জানায় সংস্থাটি। কিন্তু এখন এই এলাকাগুলো শহরের অন্যতম মশাপ্রবণ এলাকা হিসেবে আলোচিত। অর্থাৎ ডিএনসিসির নোভালুরন পদ্ধতি কাজে লাগেনি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, কিউলেক্স মশা নিধনে গত ৮ মার্চ থেকে ডিএনসিসির ১০টি অঞ্চলে একযোগে ক্রাশ প্রোগ্রাম কর্মসূচি শুরু করেছেন তারা। এই কর্মসূচিতে এক হাজার ৪০০ কর্মী কাজ করছেন। এর মধ্যে ১০ মার্চ মেয়র আতিকুল ইসলামের উপস্থিতিতে মোহাম্মদপুরের রিং রোডে সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে থেকে ক্রাশ প্রোগ্রাম কর্মসূচি শুরু করে ডিএনসিসি। তবে এই ক্রাশ প্রোগ্রামে মশার উপদ্রব কমছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার জাগো নিউজকে বলেন, ‘এডিস এবং কিউলেক্স মশা নিধনে সিটি করপোরেশনকে বছরব্যাপী কর্মসূচি নিতে হবে। ওষুধের গুণগতমান এবং ব্যবহার যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে হবে। যদিও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ওষুধের মান এবং ব্যবহার নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।’

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধরোজার আগেই চড়ছে ভোগ্যপণ্যের বাজার
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ফাঁদ