ভারতের যোগীরাজ্যে পরিকল্পিত ছকে মুসলিম নির্যাতন

0
949
ভারতের যোগীরাজ্যে পরিকল্পিত ছকে মুসলিম নির্যাতন

জনসংখ্যার বিচারে ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন আগামী বছরের শুরুতেই। ভোটের আগে রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকেই খবর আসছে, পরিকল্পিতভাবে মুসলিমদের ওপর সেখানে হামলা চালানো হচ্ছে এবং মারধর করে তাদের ‘জয় শ্রীরাম’ বলতেও বাধ্য করা হচ্ছে।

এই ধরনের ঘটনাগুলোর ভিডিও করে তা ছেড়ে দেয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও – যাতে মুসলিম সমাজে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

সমাজকর্মী ও অ্যাক্টিভিস্টদের মতে, ভোটের আগে রাজ্যে হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণের লক্ষ্যেই খুব পরিকল্পনা করে এই কাণ্ডগুলো ঘটানো হচ্ছে।

মন্দিরে পানি খেতে গিয়ে বিপদে
সময়টা এ বছরের মার্চের মাঝামাঝি, ঘটনাস্থল দিল্লির কাছে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদ।

সেখানকার একটি হিন্দু মন্দিরে ঢুকে পানি খাওয়ার অপরাধে বারো-তেরো বছরের একটি ছেলেকে মাটিতে ফেলে নৃশংসভাবে মারধর করছিল দু‌’তিনজন যুবক।

বাচ্চা ছেলেটির নাম আসিফ, বাবার নাম হাবিব – এটা শোনার পর বেধড়ক মারের পাশাপাশি চলতে থাকে অকথ্য গালিগালাজ।

মোবাইল ফোনে গোটা ঘটনার ভিডিও করে পরে হোয়াটসঅ্যাপে আর ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয় ওই যুবকরাই।

যার হেনস্থার ভিডিও দেখে গোটা দেশ শিউড়ে উঠেছিল, সেই আসিফ পরে বিবিসিকে জানায়, শুধু মুসলিম হওয়ার জন্যই তাকে সেদিন ওভাবে মার খেতে হয়েছিল।

‘প্রথমে মাটিতে ফেলে রড দিয়ে পেটায়, তারপর হাত-পা মুচড়ে দিয়ে লাথি মারতে থাকে আমাকে।’

বাবার সাথে মিলে রাস্তার ময়লা কুড়িয়ে বাঁচা ছেলেটি ভয়ে কাঁপাতে কাঁপতে আরো বলেছিল, হিন্দুরা তাদের বাড়িতে এলে সে অবশ্যই পানি খাওয়াবে – কিন্তু কোনোদিন আর ভুলেও কোনো মন্দিরে পানি খেতে ঢুকবে না।

‘তুই তো পাকিস্তানের চর’
এর মাসতিনেক পরেই গাজিয়াবাদের কাছে লোনিতে সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ আবদুস সামাদকে একটি নির্জন জায়গায় টেনে নিয়ে গিয়ে প্রবল মারধর করা হয়।

জোর করে তাকে ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করা হয়, কাঁচি দিয়ে কেটে দেয়া হয় লম্বা দাড়ি – আর এখানেও ভিডিও ধারণ করা হয় গোটা ঘটনাটির।

প্রবীণ মানুষটি কাঁদতে কাঁদতে পরে জানিয়েছিলেন, ‘ক্যানালের ধার থেকে আমাকে একটি অটোতে করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ওই হামলাকারীরা।’

‘একটু দূরে ছেড়ে দেবে বলে নিয়ে যায় একটা জঙ্গলে, তারপর একটা ঘরে আটকে রেখে বেধড়ক মার মারতে শুরু করে দেয়।’

‘ওরা শুধু আমাকে শ্রীরাম শ্রীরামই বলায়নি, বারবার বলছিল, করবি আর পাকিস্তানের দালালি?’

ফিরে আসছে দাঙ্গার স্মৃতি
পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের যে মুজাফফরনগর ও শামলিতে আট বছর আগের দাঙ্গায় শত শত মুসলিম ঘরছাড়া হয়েছিলেন, সেখানেও হালে আবার ফিরে এসেছে সেই দুঃস্বপ্নের স্মৃতি।

‘মকতুব’ নামে একটি এনজিও’র হয়ে সেখানে দাঙ্গাপীড়িতদের মধ্যে বহুদিন ধরে কাজ করছেন রাবিহা আবদুররহিম। তিনি বিবিসিকে জানাচ্ছেন, মুসলিম ছেলেদের মারধর করে বা মেয়েদের হেনস্তা করে তার ভিডিও তুলে রাখার ঘটনা সেখানে অহরহ ঘটছে।

শুধু তাই নয়, ওই এলাকার গ্রামে গ্রামে হিন্দু জাঠরা বড় বড় জমায়েত বা মহাপঞ্চায়েত ডেকে সেইসব নির্যাতন উদযাপন করছেন, মুসলিমদের প্রকাশ্য হুমকি দেয়া হচ্ছে।

রাবিহার কথায়, ‘মুসলিমদের লিঞ্চিং উপেক্ষা করা বা চুপচাপ বরদাস্ত করা এক জিনিস – কিন্তু হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে মুসলিমদের হত্যাকে সমর্থন করছে, উৎসব করছে – ভাবা যায়? এতো গণহত্যার প্রথম ধাপ!’

‘আজকের ভারতে, উত্তরপ্রদেশে বা হরিয়ানায় কিন্তু ঠিক সেই জিনিসই হচ্ছে।’

‘আজ এদেশে মুসলিম মেয়েরা ভাবতে বাধ্য হচ্ছে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই … যেকোনো দিন তারা খুন হতে পারে, ক্যামেরার সামনে ধর্ষিতা হতে পারে বা জীবন্ত জ্বালিয়ে দেয়া হতে পারে – স্রেফ তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য।’

লিফট নেয়াই কাল হলো কাজিম আহমেদের
এই জুলাই মাসের শুরুতেই উত্তরপ্রদেশের নয়ডাতে একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে সম্পূর্ণ অচেনা লোকজন মেরে অজ্ঞান করে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল প্রবীণ কাজিম আহমেদকেও।

লম্বা দাড়ি আর ফেজ টুপি থেকে তাকে খুব সহজেই চেনা যায় মুসলিম বলে – আর সে জন্যই তাকে টার্গেট করেছিল হামলাকারীরা।

কোনোক্রমে প্রাণে বেঁচে ফেরা কাজিম আহমেদ পরে জানিয়েছিলেন, ‘আলিগড়ের বাসের জন্য যখন অপেক্ষা করছিলাম, তখন ওই গাড়িটি এগিয়ে এসে আমাকে লিফট দিতে চায়।’

‘কিন্তু আমাকে গাড়িতে তুলেই যখন ওরা জানালার কালো কাঁচ নামিয়ে দেয়, তখনই আমি প্রমাদ গুনি।’

‘নামিয়ে দেয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করলেও তাতে ওরা কান দেয়নি, আমার দাড়ি টেনে ধরে একধারসে কিল-চড়-ঘুষি মারতে থাকে; দিতে থাকে খুব খারাপ গালাগালি!’

মুসলিম নির্যাতনেও পরিকল্পিত প্যাটার্ন?
কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথের আমলে উত্তরপ্রদেশে এই ধরনের ঘটনা এখন এতটাই ডালভাত হয়ে গেছে যে এখন মিডিয়াতেও এসব খবর ঠাঁই পায় না বললেই চলে।

ভারতের সবচেয়ে জনবহুল ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই রাজ্যটিতে বিধানসভা ভোট মাত্র ছ-সাত মাস পরেই।

তার ঠিক আগে সেই রাজ্যে মুসলিম নির্যাতন যেন একটা নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী চলছে, একটা প্যাটার্ন অনুসরণ করছে, বিবিসিকে বলছিলেন আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির সাবেক ছাত্রনেত্রী ও অ্যাক্টিভিস্ট আফরিন ফতিমা।

আফরিন ফতিমা বলছিলেন, ‘এ রাজ্যে মুসলিমদের মধ্যে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে – আর পুরোটাই করা হচ্ছে পরিকল্পিত ছকে।’

‘গবেষণা বলে, যেকোনো দাঙ্গার পরেই মুসলিমরা কিন্তু মিশ্র বসতির এলাকা ছেড়ে গিয়ে নিজেদের ঘেটো-তে গিয়ে বাস করতে চায়। এখানেও ভোটের আগে ভয় দেখিয়ে ঠিক সেভাবেই মুসলিমদের কোণঠাসা করে ফেলা হচ্ছে।’

‘রুটিরুজির প্রয়োজনে তাদেরও বাইরে বেরোতেই হয়, কিন্তু উত্তরপ্রদেশে প্রতিটি মুসলিম নারী-পুরুষই জানেন, প্রতিদিন বাড়ির বাইরে পা ফেলেই তারা বিরাট একটা ঝুঁকি নিচ্ছেন!’

যতই অবিশ্বাস্য শোনাক – নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে বিশেষ করে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে বাস্তবতা কিন্তু এটাই।

বয়স বারো হোক বা বাহাত্তর, মুসলিমদের পরিকল্পিতভাবে মারধর করা হচ্ছে, জোর করে বলানো হচ্ছে- জয় শ্রীরাম।

গোটা ঘটনার ভিডিও করে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে – যেগুলো দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ছে জাঠদের মহাপঞ্চায়েত। সূত্র : বিবিসি।

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধফটো রিপোর্ট | ক্রুসেডার ফ্রান্স ও মুরতাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে আল-কায়েদার বীরত্বপূর্ণ অভিযানের দৃশ্য
পরবর্তী নিবন্ধমুসলমানদের সংখ্যা কমাতে দুইয়ের বেশি সন্তান নিলে সরকারি চাকরি নয়: যোগী আদিত্যনাথ