সামগ্রিকভাবে আল্লাহ তা’আলা এই উম্মাহকে যতগুলো নিয়ামত দ্বারা সম্মানিত করেছেন, তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত হলো ইসলামী খিলাফাহ বা শরীয়াহর শাসন। উম্মাহর রক্ষাকবচ ইসলামী খিলাফাহ হলো। ইসলামী খিলাফাহ-ই হলো এই উম্মাহর জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু, দ্বীন ও শরীয়তের হিফাজতকারী। আর তাই তো উম্মাহ যুগে যুগে রক্ত ঝরিয়েছে, জীবন উৎসর্গ করেছে – কিন্তু এই মহা নেয়ামতকে কোন কিছুর বিনিময়েই হাতছাড়া হতে দেয়নি।
যে দ্বীন ও শরীয়াহ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ শরীর থেকে রক্ত ঝরিয়েছেন, দান্দান মোবারক শহীদ করেছেন; বিশ্বের আনাচে-কানাচে যে দ্বীন ও শরীয়াহকে ছড়িয়ে দিতে দিগ্বিজয়ী সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) ঘোড়া ছুটিয়েছেন পৃথিবীর প্রান্ত থেকে প্রান্তরে, অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেদের জীবন – কেবলমাত্র সেই শরীয়তে ইসলামীয়ার মধ্যেই উম্মাহর ইহলৌকিক ও পরলৌকিক কল্যাণ, সম্মান ও বিজয় নিহিত রয়েছে।
উম্মাহ যতদিন পর্যন্ত এই নিয়ামতকে পরিপূর্ণরূপে আঁকড়ে ধরেছিলো, ততদিন পর্যন্ত উম্মাহর জীবনে সম্মান ছিলো, সম্পদের প্রাচুর্য ছিলো, মা-বোনদের সম্ভ্রম সংরক্ষিত ছিলো, সেই সাথে ছিল দ্বীন পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা।
কিন্তু যেদিন থেকে উম্মাহ পূর্ণাঙ্গ শরীয়ার শাসন থেকে বঞ্চিত হয়েছে, কিংবা শাসনব্যবস্থার মত নেয়ামত হাতে থাকার পরও সেটাকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের দেখানো পদ্ধতিতে না চালিয়ে রাজা-বাদশাহগণ স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণেই সন্তুষ্ট থেকেছেন, সেদিন থেকেই উম্মাহর জীবনে নেমে এসেছে বিপর্যয় ও দুর্ভোগ! রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে তো বটেই, ব্যক্তি জীবনেও ধর্ম পালনের স্বাধীনতা থেকে অনেক ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হয়েছে এই উম্মাহ। ইসলামী শাসনব্যবস্থার চূড়ান্ত বিলুপ্তির পর থেকে জুলুম নির্যাতনের এমন কোনো অধ্যায় নেই যা মুসলিম উম্মাহকে পাড়ি দিতে হয়নি!
উম্মাহ নিজ মা-বোনদের সম্ভ্রম হারিয়েছে, হারিয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতা, হারিয়েছে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি জীবনের শান-শওকত ও সম্মান-মর্যাদা।
যদি এই উম্মাহ পুনরায় তার হৃত গৌরব ফিরে পেতে চায়, তাহলে পূর্ণাঙ্গ শরীয়াহর শাসন ফিরিয়ে আনা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই! অতএব, এই উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করেই আমাদের সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা পরিচালিত হওয়া উচিত।
কিন্তু আমাদের দুঃখের জায়গাটা এখানেই!
আমরা দ্বীনের নাম দিয়ে অসংখ্য মেহনতের সূচনা করেছি ঠিকই, বিভিন্ন কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছি ঠিকই, বহু সংগঠন-উপসংগঠনও গড়ে তুলেছি; কিন্তু ইসলামী শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত কোনো সুচিন্তিত কর্মপন্থা আজও পর্যন্ত নির্ধারণ করতে পারিনি। ইসলামী শরীয়াহ ফিরিয়ে আনতে সক্রিয় কোনো জামা’আতও আমরা তৈরি করতে পারিনি!! আর যারাই এই আলোকে প্রয়াস চালিয়েছে, পশ্চিমাদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও তাদেরকে জঙ্গি-সন্ত্রাসী বলে গালি দিয়েছি!!
প্রিয় উম্মাহ! প্রায় শতবছর যাবত আমরা খিলাফাহ তথা কুরআনের শাসন থেকে বঞ্চিত রয়েছি। খিলাফাহর প্রয়োজনীয়তা যে আমাদের জীবনে কতটা বেশি – তা এই দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছি!
হ্যাঁ, সারা বিশ্বের সকল মুসলিম এক আমীরের অধীনে জীবন-যাপন করার নেয়ামত আমরা ভুলে গিয়েছি!
এরই এক ফাঁকে গণতান্ত্রিক কুফুরী জীবন ব্যবস্থাকেই আমরা প্রকৃত জীবন ব্যবস্থা ভেবে বসেছি! আর ইসলামকে মনে করেছি রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন ও ব্যক্তিজীবনে পালনীয় একটি ঐচ্ছিক বিষয়! আমাদের মাঝ থেকেও তাই উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে এই সত্য দ্বীনের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণকামীতার প্রতি আকর্ষণ।
ইসলাম যে দীর্ঘ সাড়ে ১৩ শত বছর পৃথিবী শাসন করেছে – এই সত্য স্বীকার করতেও এখন আমারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করিনা! ধর্মপ্রাণ অনেক মুসলিমও মনে করেন, আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার এই যুগে ইসলামী শাসনব্যবস্থা আসলেই হয়তো অচল! নাঊযুবিল্লাহ!
ওয়াল্লাহি! এটা কোনো মুসলিমের বিশ্বাস হতে পারে না! আমাদের ইসলামী শাসনামলের ইতিহাস পড়ুন হে আত্মবিস্মৃত উম্মাহ!
আমাদের স্পেনকে অধ্যয়ন করুন, উসমানী সালতানাতকে অধ্যয়ন করুন; তাহলে জানতে পারবেন যে তৎকালীন কে কাকে সমীহ করে চলত, আর কেই বা কাকে সভ্যতার শিক্ষা দিত!
আমরাই ছিলাম তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে আধুনিক; জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তিতে তৎকালীন ইউরোপ ইসলামী স্পেনের ছাত্র!
আমরাই তাদেরকে সভ্যতা শিক্ষা দিয়েছি! আমরাই তাদেরকে গোসল করা আর পবিত্রতা অর্জন শিখিয়েছি, শিখিয়েছি শালীনতা আর সামাজিকতা।
আমাদের প্রভাব এতটাই ছিল যে, আমাদের বাহিনীর ঘোড়ার খুরের স্ফুলিঙ্গ দেখে তাদের বড় বড় সেনাপতি আর রাজারা রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যেত। এতটাই সম্মানিত ছিলাম আমরা!
কিন্তু আজ আমরা শরীয়ার শাসন থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন হয়েছি যে, এর প্রয়োজনীয়তাটুকুও আমাদের জানা নেই। ইয়া আল্লাহ, আমাদের ক্ষমা করুন!!
প্রিয় উম্মাহ! আল্লাহ তা’আলা কুরআন কেনো অবতীর্ণ করলেন? বান্দার ব্যক্তিজীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বিধান সংক্রান্ত শত শত আয়াত আল্লাহ তা’আলা কেনো নাজিল করলেন? বর্তমানে অনেক মুসলিমের ধারণাই এরকম যে, কুরআন শুধু, তেলাওয়াত করা এবং মৃত ব্যক্তির জন্য খতম পড়ার কিতাব। মুসলিম সমাজেও অনেক জ্ঞান পাপী আছে যারা মনে করে, কুরআন হলো পূর্ববর্তী রাজা-বাদশাদের কিসসা-কাহিনির কিতাব। নাউজুবিল্লাহ!
কুরআন যে আমাদের একমাত্র সংবিধান এই সত্য আমরা ভুলে গিয়েছি! দিন দিন এর আলোচনাটুকুও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে! মসজিদের মিম্বার, খানকার ইসলাহী বয়ান ও মাদরাসার দরসের মসনদ থেকেও এ ব্যাপারে কোনো আওয়াজ আসে না। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন!
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহর সংবিধান কী ছিলো? আবু বকর, উমর, উসমান, আলী ও মু’আবিয়া রাঃ কোন সংবিধান দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন? উমাইয়া খিলাফাহ, আব্বাসী খিলাফাহ এবং উসমানী খিলাফহ কোন সংবিধানের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো??
রাসূলুল্লাহ থেকে শুরু করে সাড়ে ১৩ শত বছর পর্যন্ত যদি পবিত্র কুরআন মুসলমানদের একমাত্র সংবিধান হতে পারে, তাহলে বর্তমানে মুসলিম ভূখণ্ডগুলো গণতন্ত্রের মত একটি নিকৃষ্ট সংবিধান দিয়ে পরিচালিত হবার কী যুক্তি থাকতে পারে??
খিলাফার পতনের পর থেকে আবরাহাম লিংকনের গণতান্ত্রিক সংবিধানে ইসলামের হুদূদ কিসাস সম্পর্কিত কতগুলো আয়াতকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিত্যক্ত করে রাখা হয়েছে? কুরআনের এই আয়াতগুলিতে বর্ণিত বিধানকে মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলে কটূক্তিও করা হয়েছে।
মীরাসের কুরআন-বর্ণিত বিধানকে অগ্রাহ্য করে ছেলে-মেয়েকে সমান ভাগ দেওয়া হয়েছে। কুরআনের একাধিক আয়াতে বর্ণিত মদের স্পষ্ট হারাম বিধানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে লাইসেন্স দিয়ে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। কুরআনে নিষিদ্ধ পতিতাবৃত্তিকে গণতান্ত্রিক সংবিধান দিয়ে বৈধ করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাপী সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি চালু করে কুরআনের একাধিক আয়াতকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
এভাবেই এক এক করে কুরআনের বিধানগুলোকে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা থেকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে!! আমরা যতদিন না ইসলামী শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনবো, ততদিন পর্যন্ত কুরআনের উপর পূর্ণাঙ্গরূপে আমল করা আমাদের দ্বারা সম্ভব হবে না।
প্রিয় উম্মাহ! একটু চিন্তা করে দেখুন তো! কুরআনের শত শত আয়াতকে পরিত্যক্ত করে গণতন্ত্রের মত একটি নিকৃষ্ট জীবনব্যবস্থা দিয়ে মুসলিম ভূখণ্ডগুলো পরিচালিত হচ্ছে। এটা কতই না গর্হিত কাজ! কতো না বড় আল্লাহ দ্রোহীতা!
এ অবস্থা একদিন বা দুইদিনের নয়, বরং শত বছর এভাবে অতিক্রম করেছে! কিন্তু মুসলিম উম্মাহর মাঝে কোনো পরিবর্তন নেই! আল্লাহর কুরআনের জন্য অন্তরে কোনো দরদ নেই! বিন্দুমাত্রও কোনো ব্যথা নেই! আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন!
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের শরীর থেকে কেনো রক্ত ঝরিয়েছিলেন? উমর ও উসমান(রাঃ) কে কেনো শহীদ করা হয়েছিলো?? বিভিন্ন রণাঙ্গনে গিয়ে রাসূলের অসংখ্য সাহাবী কেনো শাহাদাৎ বরণ করেছিলেন?
আমাদের শরীরের রক্ত কি রাসূলুল্লাহ রক্ত থেকেও বেশি দামি? সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবয়ে তাবঈনের রক্তের চেয়েও বেশি দাম আমাদের রক্তের? সুবহানাল্লাহ!!
আমরা কোন মুখ নিয়ে রাসূলুল্লাহর শাফায়াতের আশা করি? কীভাবে আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর হিম্মত করি আমরা? কিয়ামতের দিন যদি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলেন:
یٰرَبِّ اِنَّ قَوۡمِی اتَّخَذُوۡا ہٰذَا الۡقُرۡاٰنَ مَہۡجُوۡرًا
হে আমার প্রভু! নিঃসন্দেহ আমার জাতি এই কুরআনকে পরিত্যজ্য বলে ধরে নিয়েছিল। “(সূরা আল ফুরকান-৩০) তাহলে আমরা আর কার কাছে যাবো সুপারিশের জন্য??
হে আল্লাহ! আমাদেরকে বোঝার তাওফীক দাও!
তোমার দ্বীনের জন্য আমাদেরকে সব ধরণের কুরবানী করার তাওফীক দাও, আমীন!
লেখক: আব্দুল্লাহ মুনতাসির
শরীয়াহ আইন প্রতিষ্ঠার জন্য যে, জিহাদ করা জরুরি, এটা অনেক মানুষই বুঝতে চায় না।
(وَلَا تَهِنُوا۟ وَلَا تَحۡزَنُوا۟ وَأَنتُمُ ٱلۡأَعۡلَوۡنَ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِینَ)
[Surah Aal-E-Imran 139]
আল্লাহর এই জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েম হবেই একদিন ইনশাআল্লাহ
জাযাকাল্লাহ
সবাই হক্বের দা’ওয়াতকে ‘আম করুন।
সত্যের আহ্বানকে ব্যাপক করুন।
জাযাকাল্লাহ…
উম্মাহর কল্যাণকামী লেখক
ভাই আব্দুল্লাহ মুনতাসির-কে.