১৯৯২ সালের ১৮ অক্টোবর, সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কাশ্মীরের সোপোর জেলার ঝিলাম নদীতে একটি যাত্রীবাহি নৌকায় আকস্মিক গুলি চালায় বিএসএফের সন্ত্রাসীরা। তাদের তথ্যমতে, তখন সেই নৌকায় ছিল কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামীরা। আর মূলত তাদের ধরতেই এই অপারেশন চালায় বিএসএফের সন্ত্রাসীরা।
তবে, এশিয়া ওয়াচ/পিএইচআর-কে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায় যে, সেই নৌকায় তখন মাঝি ছাড়াও ছিল মোট পাঁচজন মুসলিম। নৌকাটি তীরের কাছাকাছি আসলে প্রায় ৩০ জন বিএসএফ তাদের তীরে আসার আহ্বান জানায়। দু’জন তখন নৌকা থেকে লাফ দিয়ে সাঁতরে তীরে উঠে পালিয়ে যায়। তীরের কাছে চলে আসলে বিএসএফ সন্ত্রাসীরা নৌকাটিকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এতে নিহত হয় দু’জন নিরীহ কাশ্মীরি মুসলিম। আহত হয় নৌকাটির মাঝি। তৃতীয় আরেকজন মুসলিম পানিতে ডুবেই মারা যায় বলে ধারণা করেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
গোলাগুলির পর যখন দেখা যায় যে, সন্দেহভাজন স্বাধীনতাকামীরা হয় নিহত হয়েছে না হয় পালিয়ে গেছে, তখন বিএসএফ সন্ত্রাসীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে স্থানীয় বেসামরিক মুসলিমদের উপর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, গোলাগুলির পর বিএসএফ সন্ত্রাসীরা স্থানীয় পাঁচজন মুসলিমকে সেই মৃতদেহগুলো ও বন্দুকগুলো নিয়ে আসার নির্দেশ দেয়। বিএসএফ তাদের হুমকি দিয়ে বলে যে, “তোমরা যদি আমাদের কথা না শোন, তাহলে আমরা তোমাদের মহিলাদের ধর্ষণ করব।” এরপর বাধ্য হয়ে তারা সেই মৃতদেহগুলি ও নৌকার মাঝিকে আহত অবস্থায় নিয়ে আসে।
নৌকাটির মাঝি ছিল গুলাম আহমেদ কুন্ডু নামের এক বৃদ্ধ ব্যক্তি। বিএসএফ সন্ত্রাসীদের ছোঁড়া গুলি তাঁর পায়ে লাগার কারণে তিনি বেশ আহত হন। তীরে নিয়ে আসার সাথে সাথেই একজন বিএসএফ সন্ত্রাসী তাঁর গলা কেটে তাঁকে খুন করে দেয়।
গোলাগুলির সময় বেশ কয়েকজন কাশ্মীরি নারী এসে বিএসএফ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু বিএসএফ তাদের উপরও গুলি চালাতে কোন দ্বিধা বোধ করে না। এতে সন্ত্রাসী বিএসএফ-এর গুলিতে নিহত হয় দুইজন মুসলিম নারী।
পরবর্তীতে এই ঘটনা সম্পর্কে একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, “বিএসএফকে উদ্দেশ্য করে ‘জঙ্গিরা’ গুলি করে এবং এর পাল্টা জবাবে বিএসএফ বাহিনীও তাঁদের উপর গুলি করে। এতে তিনজন জঙ্গির মৃত্যু হয়। গুলি বিনিময়ের সময় সেখানে দুইজন নারীও মারা যায়।” কিন্তু নিকৃষ্ট হিন্দুত্ববাদীদের বিবৃতিতে সেই নৌকার মাঝিকে হত্যার কোন উল্লেখই ছিল না।
সোপোর সাব-ডিস্ট্রিক্ট হাসপাতালের একজন চিকিৎসক পিএইচআর/এশিয়া ওয়াচকে জানান, ১৮ই অক্টোবর তিনটি মৃতদেহ পরীক্ষার জন্য এবং পুলিশের মেডিকেল রিপোর্ট লেখার জন্য বিএসএফ সদর দপ্তরে তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়। সেখানে দুটি মৃতদেহে তিনি বুলেটের আঘাতের চিহ্ন পান। তৃতীয় মৃতদেহটি ছিল এক বৃদ্ধের, যার গলায় তিনি প্রায় ছয় ইঞ্চির মতো বড় কাটা দাগ দেখতে পান।
সেই চিকিৎসক এশিয়া ওয়াচ/পিএইচআর-কে আরও জানান যে, বিএসএফ নিয়মিত ডাক্তারদের ডেকে পুলিশের মেডিকেল রিপোর্ট দাখিল করে। তবে তারা ডাক্তারদেরকে মৃতদেহগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পোস্টমর্টেম করতে না দিয়ে বরং শুধুমাত্র আঘাতের চিহ্নগুলি নোট করার নির্দেশ দেয়।
অনুবাদক ও সংকলক
আবু-উবায়দা
মূলসূত্র
বই: হিউম্যান রাইটস ক্রাইসিস ইন কাশ্মীর (The Human Rights Crisis in Kashmir) [Page: 70-71];
প্রথম প্রকাশিতঃ জুন ১৯৯৩
প্রতিবেদনকারী:
এশিয়া ওয়াচ (হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি বিভাগ) এবং ফিজিশিয়ান্স ফর হিউম্যান রাইটস (পিএইচআর)
আগের পর্বগুলো পড়ুন:
১। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা ।। পর্ব-১।। চিকিৎসা সেবায় ঘাটতি
– https://alfirdaws.org/2022/09/24/59437/
২। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা।। পর্ব-২।। ধর্ষণ যাদের সংস্কৃতি
– https://alfirdaws.org/2022/09/25/59476/
৩। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা || পর্ব-৩ || নাসরুল্লাহপুরার হত্যাকাণ্ড
– https://alfirdaws.org/2022/09/28/59560/
৪। কাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা।। পর্ব-৪।। সাফাকাদাল হত্যাকাণ্ড
– https://alfirdaws.org/2022/10/04/59692/