কাশ্মীরে দখলদার ভারতের অপরাধনামা || পর্ব-১৪ || কাশ্মীরি মায়ের সন্তান হারানোর বেদনা

মুহাম্মাদ ইব্রাহীম

0
833

পৃথিবীর জান্নাত খ্যাত কাশ্মীর উপত্যকা এখন ক্ষতবিক্ষত এক রক্তাক্ত মুসলিম ভূ-খণ্ডের নাম। প্রতিনিয়ত হিন্দু সন্ত্রাসীদের আগ্রাসনে কাশ্মীরি মুসলিমরা হারাচ্ছেন প্রিয় সন্তান, স্বামী বা ভাইকে। কেউবা হারাচ্ছেন তাদের পিতা-মাতাকে, অথবা ধর্ষিত বোনের নিথর দেহ কোলে তুলে আর্তচিৎকার করছেন কোন ভাই। হিন্দু বর্বরতা আর এমন জুলুম সত্বেও বিশ্বের কেউই প্রতিবাদ করে না। তুলে ধরে না মাজলুম কাশ্মীরিদের প্রিয় সন্তান হারানোর শোকে হৃদয়ে গভীর ক্ষত ও বেদনার কথা।

এমনই একজন সন্তান হারা কাশ্মীরি মা ফিরদৌসা। যাঁর ছেলেকে গত এক বছর আগে খুন করে দখলদার ভারতীয় সেনাবাহিনী। ছেলে খুনের পর তাঁর পরিবারে ঝড় ঝাপটা বয়ে গিয়েছে, পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে তাঁর সাজানো সংসার। তিনি জানান, “আমার আরও চারটি সন্তান আছে, কিন্তু আমার হৃদয়ে যে ছিদ্র হয়েছে তা কখনো পূরণ হবার নয়।”

শাহিদের ছোট বোন মেহভিশ। ঘর থেকে একটি ছবির অ্যালবাম বের করে এনেছে সে। তাদের ভাই-বোনদের মধ্যে অনেক স্মৃতি লুকিয়ে আছে এটিতে। এতে তাঁর শহিদ ভাইয়ের লোমহর্ষক একটি ছবি সাজিয়ে রেখেছেন সে। গাড়ির চাকার সাথে হেলান দিয়ে পড়ে আছে তাঁর ভাইয়ের নিথর দেহ। ভারতীর বর্বর সেনাবাহিনী তাঁর ভাইকে খুন করে এভাবেই ফেলে রাখে। ফিরদৌসা যখনই ছবিটি দেখেন, তখনই চুম্বন করেন এতে।

ছবি: গাড়ির চাকার সাথে হেলান দিয়ে পড়ে থাকা শহিদের লাশ। তার হাত তখনও তার ফেরানের (কাশ্মীরি পোশাক) ভিতরে আটকে ছিল এবং তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।

গত এক বছর আগে কাশ্মীরে কথা, তখন শুষ্ক মৌসুম। সবার মতো ফিরদৌসাও অপেক্ষায় ছিলেন কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির জন্য। বৃষ্টি নামলেই আবারও সবুজ-শ্যামলে ভরে উঠবে চির চেনা সেই কাশ্মীর। হঠাৎ বৃষ্টি নামার খবর আসে ফিরদৌসার কাছে, সেই সাথে আরও একটি খবর আসে তাঁর কাছে। যার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। খবর আসে তাঁর ছেলেকে গুলি করে খুন করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী।

কাশ্মীরের সোপিয়ান জেলার নিকটবর্তী আরওয়ানি গ্রাম। এটি ছিল অক্টোবরের শুরু, বৃষ্টি নামার ফলে গাছের অনেক পাতা সময়ের চেয়ে আগে ঝরেছিল। জরাজীর্ণ গাছের পাতাগুলি যেন সেজেছিল শহিদকে বরণ করার জন্য। পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী গ্রামের পুরুষ, মহিলা এবং শিশুরাও জড়ো হয়েছিল শহিদের একতলা বাড়িতে।

সন্ধ্যা নেমে আসছে, তখনো শহিদের লাশ ফেরত দেয়নি ভারতীয় সেনাবাহিনী। মোবাইলে শহিদের একটি ছবি দেখছে তারা। ২১ বছরের যুবক আইজাজকে চেকপয়েন্টে গুলি করে হত্যা করেছে ভারতীয় দখলদার সেনারা।

মহিলারা কাঁদছেন, শিশুরাও কাঁদছেন। শহিদের লাশের ছবি দেখে মহিলারা একে অপরের কাছে ফিসফিস করে বলতে লাগলো, “দেখেছো দেখেছো ছেলেটার হাতে আপেলের ব্যাগ দেখেছো,” অন্য মহিলারা জবাব দেয় হ্যাঁ, আর তুমি কি ঐগুলো দেখেছ? সে নিশ্চয়ই তার পরিবারকে খাওয়ানোর জন্য এগুলো ক্রয় করেছিল?”

শহিদের আশি বছর বয়সী দাদী তাদের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে নাতির জন্য বিলাপ করছিল। ত্রিশ বছর আগে তিনি বিধবা হয়েছিলেন। নাতি-নাতনিদের লালন-পালনের মাধ্যমে দুঃখ কাটিয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাদেরকে নিয়েই বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন তিনি।

শহিদের ৮০ বছর বয়স্ক দাদী।

শহিদের খুনের খবর ছড়িয়ে পড়ার বেশ কয়েক ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে। গ্রামের লোকজন শহিদকে এক নজর দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। যে মহিলারা মিষ্টি এবং মেহেদি নিয়ে অপেক্ষা করার কথা ছিল, তাকে বর হিসেবে স্বাগত জানানোর কথা ছিল! কিন্তু সেই মহিলারা আজ শহিদের লাশকে শেষবারের মতো চির বিদায়ের জন্য অপেক্ষায় রত।

অনেক ভিড়ের মধ্যে ইফরা এবং ফারহানের মতো ছোট বাচ্চারাও এসেছে শহিদকে দেখার জন্য। তারা দুই ভাইবোন পাশের বাড়ি থেকে এসেছিলো। তারা শহীদের সহপাঠী ছিলো। “আমরা শেষবারের মতো তার মুখ দেখতে এসেছি,” ইফরা তার আট বছর বয়সী ভাইকে আঁকড়ে ধরে বলল, “আমাদের মা এই শর্তে আমাদের এখানে আসতে দিয়েছিলেন, যেন আমি আমার ভাইয়ের হাত না ছাড়ি।”

কাশ্মীরে শহীদদের জানাজার নামাজ সম্মানের সাথে আদায় করা হয়। তরুণ সন্তান হারানোর যতটা শোক পালন হয় সেখানে, ততটা গর্বও করে তাঁরা। কারণ তাদের সন্তান শহীদ হয়েছেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে গ্রামবাসী শহিদের জন্য অপেক্ষাও দীর্ঘ হতে থাকে।

কিন্তু পুলিশ জানাজা নামাজে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সময়টি ছিল করোনাভাইরাস মহামারির সময়। ফলে দখলদার ভারতীয় পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্হিতির লঙ্ঘন রোধ করার অযুহাতে জানাজা নামাজে বাধা সৃষ্টি করে। এরপরও দলে দলে গ্রামবাসী শহিদের জন্য ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকেন।

শহিদ আইজাজের বাড়ি থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে ফ্রিসালে থানা। সেখানে শহিদের বাবা-মা তাদের ছেলের লাশ তাদের কাছে হস্তান্তরের দাবিতে সারা দিন কাটিয়েছেন। পুলিশের দীর্ঘ গড়িমসির পর সন্ধায় লাশ হস্তান্তর করতে রাজি হয়। ফিরদৌসা জানায় আমরা রাত পৌনে নয়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে লাশ নিয়ে আসি।

শেষ পর্যন্ত রাতে লাশ এসে পৌঁছায় গ্রামে। গ্রাম ও আশেপাশের লোকজনে তাদের বাড়ি তখন জনসমুদ্রে পরিনত হয়। বিশাল এই জনসমুদ্র ডজন ডজন স্লোগানে শহিদকে স্বাগত জানায়। তাদের স্লোগানে ছিল-

“দেখো দেখো কোন আয়া
শের আয়া শের আয়া
শহিদ আয়া শহিদ আয়া”

গ্রামবাসীরা শেষবারের মতো ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে শহিদের মুখ দেখার চেষ্ঠা করেছিল। শহিদের ছোট ভাই উমেদ। সে সারাদিন ক্রিকেট খেলছিল। বাড়িতে এতো মানুষের আগমন কেন বোধগম্য হয়নি তার। শহিদের নিষ্প্রাণ দেহ ভিড়ের মধ্যে নিয়ে যেতে দেখেই চিৎকারে ভেঙে পড়ে সে। তার সাথে চিৎকার করে কাঁন্না শুরু করে গ্রামের অন্যান্য মুরব্বিরাও।

শহিদের ছোট ভাই

শেষ পর্যন্ত শহিদের জানাজা তার নিজ উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। এবং তাকে তাঁর বিদ্যালয়ের পাশে একটি কবরস্থানে দাফন করা হয়।

শহিদের কবরের পাশে তাঁর ছোট ভাই জুবায়ের

শহিদের মা ফিরদৌসি তাঁর ছেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানান, “সে তার স্কুলের বকেয়া ফি দেওয়ার জন্য আমার কাছে টাকা চেয়েছিল। আমার কিছু সঞ্চয়কৃত অর্থ ছিল। যা দিয়ে আমার সংসারের খরচ বহন করতে হতো, কিন্তু সে আমার কাছ থেকে টাকা নেয়নি। তার বিবেক তাকে অনুমতি দেয়নি, তাই সে শ্রমের কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে চলে গিয়েছিল।”

শহিদের ভাই জুবায়ের বলেন, “তার ফোনের ডিসপ্লে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তাই তিনি দূরে থাকার সময় আমরা তার সাথে ঠিকভাবে কথা বলতে পারিনি।”

হত্যার দিন ফেরদৌসা তার পরিবারের জন্য চা বানাচ্ছিলেন। এমন সময় এবং তার কাছে একজন এসে তাকে জানায় যে একটি ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। দুই জন মহিলা শহিদের সাথে যোগাযোগ করে তার সুস্থতা সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় শহিদের চাচা দৌড়ে এসে তার খুনের বিষয়টি নিশ্চিত করে। তিনি জানান, একটি সেনা তল্লাশি চৌকির কাছে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন আইজাজ। ক্রসফায়ারে তিনি নিহত হয়েছেন বলে ভারতীয় সেনাবাহিনী জানায়।

ফিরদৌসি আফসোস করে বলেন, ক্রসফায়ার শুধু আমার ছেলের বুকেই কেন আঘাত করল? “অন্য কেউ নিহত বা আহত হয়নি, এবং চলন্ত যানবাহন বা অন্য কোথাও কেন গুলি লাগলো না। ছেলে হত্যার এমন শোক নিয়ে এক বছর পার হয়েছে। তবে, এখনোও ফিরদৌসার ঘুমাতে কষ্ট হয়। ছেলের হত্যাকাণ্ড তার হৃদয়কে দুর্বল করে দিয়েছে।

ফিরদৌসি থানায় কাটানো সময়গুলোর কথা স্মরণ করে বলেন, আমাদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে আমরা আমার ছেলের হত্যার জন্য চাকরি বা ক্ষতিপূরণ চাই কিনা। ফিরদৌসা প্রশ্ন রেখে বলেন, “একজন মা কিভাবে তার ছেলের রক্তের সাথে ব্যবসা করতে পারে?” তিনি তার ছেলের মৃতদেহ ফেরত দেওয়ার জন্য পুলিশ অফিসারদের কাছে অনুরোধ করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছেন।

ফেরদৌসা জনায়, “গত এক বছর ধরে, আমি আমার ছেলের জিনিসপত্র ফেরত পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। আমি তাদের কাছে কিছু চাই না। আমি সেই জামাটি চাই যেটি আমার ছেলে সেদিন পড়েছিল। আমি তার ফেরান (কাশ্মীরি পোশাক) চাই । কেন তারা আমাকে তার আমানত ফিরিয়ে দিল না? প্রতিদিন আমি ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকি এবং এই সমস্ত জিনিস সম্পর্কে ভাবি, তারপর কিছু ওষুধ খাই এবং ঘুমানোর চেষ্টা করি।”

শহিদের ছোট বোন মেহভিশ তার ডায়রিতে ভাইয়ের ছবি স্টিকার লাগিয়ে সাজিয়েছে। মেহভিশ এখনো তার ভাইয়ের সাথে কাটানো শেষ দিনের কথা মনে করে বলে, “আমরা একসাথে চা পান করছিলাম। ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলো যে, আমার কিছু দরকার কিনা। আমি বললাম, না, এবং এ কথা বলেই আমি নানীর বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। তিনি আমার সাথে রাস্তায় হাঁটলেন এবং আমাকে কিছু টাকা দিলেন। তিনি সব সময় এভাবে আমাকে আদর করতেন।”

গৃহকর্মে শহিদের অবদান ছিল অস্বাভাবিক, কারণ সাধারণত কাশ্মীরি পরিবারের মহিলারাই ঘরের কাজকর্ম গুছিয়ে থাকেন। ফিরদৌসা তার ছেলের কথা স্মরণ করে বলেন, সে আমার হাত ছিল। সে আমাদের পরিবারের জন্য চা বানিয়েছে, এমনকি ভাতও রান্না করেছে। এবং পরিবারের জন্য তার পিতার সাথে সব সময় কাজকর্ম করেছে।

শহিদের মৃত্যুর পর তার ভাই জুবায়ের স্কুল ছেড়ে দেয়। সে এখন পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে চায়, কিন্তু ফিরদৌসা তার ছেলেকে চোখের আড়াল হতে দেন না। যদি তাকেও না আবার কোন দিন বড় ছেলের মতো হারিয়ে ফেলেন, এই ভয়ে।

তিনি জানান, আমি যত দিন বেঁচে থাকি এই ক্ষত কখনো শেষ হবে না। শহিদেরদের মৃত্যুর পর আমার পরিবার এখন হুমকির মুখে জীবনযাপন করছে। দরজায় হঠাৎ প্রতিটি ঠকঠক শব্দ উদ্বিগ্ন এবং ভীত করে তোলে আমাদের। এই বাড়ির সবাই এখন লড়াই করছে। কখনও কখনও আমি চাই আমরা সবাই একসাথে চেকপয়েন্টে গিয়ে দাঁড়াই, আর সেনারা আমদের সবাইকে গুলি করে শহীদ করে ফেলুক, যাতে আমরা সবাই শহিদের সাথে একত্রিত হতে পারি।

ফিরদৌসা জানায়, আমি একজন মুসলিম। আমি তাদের কাছ থেকে কোনো বিচার আশা করি না। আমি মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তা’য়ালার ন্যায়বিচারে বিশ্বাস করি এবং তাঁর কাছেই বিচার কামনা করি।

শুধু ফিরদৌসার পরিবারই নয়, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী সেনাদের জুলুম-নিপীড়নে অগণিত কাশ্মীরি মুসলিম পরিবারে বয়ে গিয়েছে এমন ট্রাজেডি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অসহায় ও নিঃস্ব হয়ে গিয়েছে কত শত মুসলিম পরিবার। শুধুমাত্র মুসলিম হবার অপরাধে ধর্ষিত হয়েছেন অসংখ্য মুসলিম নারী, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে লাখ লাখ কাশ্মীরি মুসলিম।



 

তথ্যসূত্র:
——-
1. In pictures | One year of longing in Kashmir
https://tinyurl.com/3pfj53kz

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধবৈঠকরত শত্রুর সামরিক কেন্দ্রে শাবাবের ইস্তেশহাদী অপারেশন: হতাহত অন্তত ৩৩ কর্মকর্তা
পরবর্তী নিবন্ধআইএসকেপি-কে অর্থায়ন করছে পাকিস্তান: প্রাক্তন আইএস নেতা