তিস্তার পানিবণ্টন: বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের বাস্তবতা

সাইফুল ইসলাম

0
1091

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা কৃষিনির্ভর। সারা দেশের চাহিদা পূরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে উত্তরাঞ্চলের কৃষি। কিন্তু, এই অঞ্চলের কৃষি এখন হুমকির মুখে। সেখানকার জমিগুলো খরাপ্রবণ। কৃষিকাজে সেচ দেওয়ার প্রধান মাধ্যম বিভিন্ন নদী-নালা। আল্লাহ তা’আলা পর্যাপ্ত নদী-নালা দিয়েছিলেনও সেখানে। কিন্তু এখন একের পর এক নদ-নদী ইতিহাসের অংশ হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বহু নদ-নদী কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আরও নদী ধ্বংস হওয়ার পথে। এসবের পেছনে দায়ী কারা?

সিকিম হিমালয়ের ৭,২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চিতামু হ্রদ থেকে তিস্তা নদীর উৎপত্তি। নদীটি ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে নীলফামারী জেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তিস্তা উত্তরবঙ্গের প্রধান নদীগুলোর একটি। সর্বমোট ৩১৫ কি.মি. দৈর্ঘ্যের এ নদীটির বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থিত ১১৫ কি.মি.। বাংলাদেশ অংশে তিস্তার তীর ঘেঁষে বসবাসকারী প্রায় ২ কোটি মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য এই নদীর উপর নির্ভরশীল।

উত্তরাঞ্চলের কৃষকের সেচ কাজের প্রধান মাধ্যম তিস্তার পানি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানিপ্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমেছে এবং কমছে। কারণ, ভারত তিস্তা থেকে বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করছে। এজন্য শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের মানুষ পানি পায় না, আবার বর্ষায় বাঁধ ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশকে ভয়াবহ বন্যায় ডুবানোর কাজটিও করছে ভারত। আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ক্ষেত্রে ভাটির দেশের সাথে আলোচনা না করে কোনো দেশ বাঁধ দিতে পারে না। কিন্তু, ভারত নীতি-নৈতিকতার কোনো তোয়াক্কা না করে তিস্তা নদীর উপর বাঁধ দিয়ে খবরদারি চালাচ্ছে, ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ।

২০১১ সালে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বাধা দিলে চুক্তি থেকে সরে যায় ভারত। এক দশক পার হলেও আজ পর্যন্ত আর তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি কোনো অগ্রগতির আলো দেখেনি। বরং, সম্প্রতি তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের আওতায় আরও দুটি খাল খননে প্রায় ১ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ বিভাগ। পশ্চিমবঙ্গ সেচ বিভাগ সূত্রের বরাতে টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী তিস্তা ও জলঢাকা থেকে পানি সরাতে কোচবিহার জেলার চ্যাংড়াবান্ধা পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল খনন করা হবে। একইসঙ্গে তিস্তার বাম তীরে ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আরেকটি খাল খনন করা হবে। এর ফলে, বাংলাদেশ এতদিন যতটুকু পানি পেত, সেটাও হুমকির মুখে পড়বে। এতটুকুই শেষ নয়, দার্জিলিং পাহাড়ে ৩টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার। টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, এই ৩টি ছাড়াও আরও ১০টি ছোট জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ডিপিআর তৈরির নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে ভারত।

ভারত সরকার তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির কথা আসলেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধিতাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাতে চায়। আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলছে, তিস্তায় পানি নেই। কিন্তু ঠিকই তারা সিকিমে পানি আটকে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করছে, তিস্তার পানি প্রত্যাহারের জন্য আরও দুটি খাল খনন করেছে।

জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ কী করছে সেই দায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে মিটমাট হবে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে দিল্লির সঙ্গে কথা বলবে এবং দিল্লি এই ব্যবস্থাপনা করবে।’

কিন্তু তিস্তা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রমকে ভারতের প্রতি নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ইঙ্গিত দেয়।

শেখ হাসিনা বলেছে, “আমরা দেখেছি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী (নরেন্দ্র মোদি) এ সমস্যা সমাধানে আগ্রহী। কিন্তু সমস্যাটা আপনাদের (ভারতের) দেশের ভেতরে। তাই আমার মনে হয়, এর সমাধান হওয়া উচিত।”

বাংলাদেশের জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেছে, “শুষ্ক মৌসুমে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তিস্তায় অতিরিক্ত পানি পাওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের নেই।”

অর্থাৎ, বাংলাদেশ কার্যত তিস্তা থেকে ভারত ‘দয়া করে’ যতটুকু পানি দেয়, ততটুকুই সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নেবে। এর বাইরে কোনো পদক্ষেপ তারা নেবে না। চীন থেকে ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ তিস্তা নিয়ে ভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা ভাবছিল। কিন্তু ভারত চায় না চীনের সাথে এই বিষয়ে বাংলাদেশ কাজ করুক।

এর আগে ভারতের বিরোধিতার কারণে চীনের অর্থায়নে বাংলাদেশের সোনাদিয়ায় নির্মিতব্য গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটি বাতিল করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কার সাথে কীভাবে কাজ করবে, এসব বিষয়ে ভারতের সকল আপত্তি বাংলাদেশ প্রশাসন মেনে নিচ্ছে কেন?

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘কিন্তু যে প্রশ্নটির জবাব আমাদের রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন মহলকে দিতেই হবে, তা হলো স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আমরা কি আমাদের স্বার্থে স্বাধীনভাবে প্রকল্প গ্রহণ করতে পারব না? ভারত আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র, কিন্তু ভারতের অন্যায় কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করার তো সুযোগ নেই।

আমরা দেখছি, সীমান্ত বিরোধ সত্ত্বেও ভারত চীনের সঙ্গে প্রায় এক শ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ নিজের অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য চীন থেকে সহজ শর্তে ঋণ নিতে গেলেই ভারত নানা অজুহাতে এর বিরোধিতা করছে। আমাদের জানা আছে, ভারত বাংলাদেশকে নানা প্রকল্পে যে ঋণসহায়তা দিয়েছে, সেগুলো এতই কঠিন শর্ত-কণ্টকিত যে বাস্তবে বাংলাদেশ ওই ঋণ সহায়তার সামান্যই ব্যবহার করতে পারছে।’

বাংলাদেশ বর্তমানে ভারতের সেবাদাসে পরিণত হয়েছে। এ কারণে ভারত থেকে তিস্তার পানি না পেলেও, বাংলাদেশ ঠিকই আবার ভারত চাওয়ামাত্র সবকিছু দিয়ে দিতে রাজি থাকে। ২০১৯ সালে শেখ হাসিনা ভারত সফরকালীন ভারতের দাবি অনুযায়ী অভিন্ন নদী ফেনী থেকে ভারতকে তাদের চাহিদা মতো পানি দিতে রাজি হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেছিল, সম্পূর্ণ মানবিক কারণেই প্রধানমন্ত্রী হাসিনা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এর আগে ২০১৮ সালে ভারত সফর থেকে ফিরে শেখ হাসিনা বলেছিল, ‘আমরা ভারতকে যেটা দিয়েছি তারা তা সারা জীবন মনে রাখবে।’

আর ভারতের প্রতি এই নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণেই তারা তিস্তার উপর একচ্ছত্র মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে বসে আছে। নিজের ইচ্ছেমতো তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে, তিস্তাকে ঘিরে নানা প্রকল্প গড়ে তুলছে। বাংলাদেশের কৃষি, অর্থনীতি, এবং সাধারণ মানুষকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতেও দ্বিধা বোধ করছে না। অবস্থা দৃষ্টে, বাংলাদেশকে ভারতের বন্ধু নয় বরং ‘অনুগত সেবাদাস’ হিসেবে আখ্যায়িত করলে অত্যুক্তি হবে না হয়তো।



তথ্যসূত্র:
১. তিস্তায় আরও ২ খাল খনন করবে পশ্চিমবঙ্গ, উদ্বেগ বাড়বে ঢাকার
https://tinyurl.com/58bf6brj

২. দার্জিলিংয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প: ‘ভাটির মানুষের ক্ষতির অভিসন্ধি কি না দেখতে হবে’
https://tinyurl.com/ycybzp5h
৩. ‘রাজ্য নয়, বাংলাদেশকে দাবি জানাতে হবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে’
https://tinyurl.com/bdtkvnak
৪. তিস্তা নিয়ে ভারতের ভেতরেই সমস্যা
https://tinyurl.com/4darjs93
৫. ‘শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি পাওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের নেই’
https://tinyurl.com/d8rt9nx9
৬. তিস্তা ব্যবস্থাপনা: ভারতের আপত্তি কেন মানতে হবে
https://tinyurl.com/3z27sewt

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধফিলিস্তিন ও ফিলিস্তিনি জনগণ বলতে কিছু নেই: ইসরাইলি মন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধবিজয়ের মাস; মাহে রামাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ।। পর্ব-৮।। ১৩ হিজরীর ১২ রমাদান, ঐতিহাসিক বুওয়াইবের যুদ্ধে পারস্য বাহিনীর বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অবিশ্বাস্য বিজয়।