সেদিনটিকে আমি কখনও ভুলতে পারব না। ২০১৭ সালের ২৩শে মে। শেষবারের মতো আমার বাবার কণ্ঠ শুনেছিলাম সেদিন। এরপর পরিবারের উনিশ জন সদস্যের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বাবার কথাগুলো এখনও আমার কানে বাজে, প্রতিধ্বনিত হয় বার বার।
‘আপনি কেমন আছেন, বাবা? আমি জানি, আমার মায়ের মৃত্যুতে আপনার অবশ্যই দুঃখ হচ্ছে। আমার সৎ মা কি আপনার যত্ন ঠিকঠাক নিচ্ছেন? আপনার এই দুঃসময়ে আপনার প্রিয় সন্তান হিসেবে আমার সান্ত্বনা জানানোর সক্ষমতা নেই। আপনি হাসপাতালে ভর্তি হলে আপনার সেবা করার সক্ষমতাটুকুও আমার নেই। আপনার সন্তান হিসেবে আমার দায়িত্ব-কর্তব্যগুলো পালন করতে অক্ষম আমি। এই অপরাধবোধ আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আমি দুঃখিত বাবা।’
আমার চোখ জুড়ে তখন অশ্রুর বন্যা বয়ে চলেছে। মোবাইলের বিপরীত পাশ থেকে বাবার জবাব এলো, ‘সন্তান আমার, দুঃখ করো না। কেউই আগে থেকে জানতো না যে, তোমাকে নিজ দেশ থেকে পালিয়ে অন্য দেশে বাস করতে হবে। ইতিবাচক চিন্তা করো। হয়তো এতে অপ্রত্যাশিত কল্যাণ আছে। অন্য দেশে স্থানান্তরিত হওয়ার পর তোমাকে অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তুমি এই বিশ্বকে এবং নিজেকে ভালোভাবে বুঝতে শিখেছো। হয়তো এখন তুমি তোমার চাকরি ছেড়ে দেওয়া এবং নিজের আত্মীয়স্বজন ও শৈশবের বন্ধুদের সাথে থাকার পরিবর্তে পালানোর সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিলে, সেই উত্তর খুঁজে পাবে।’
বাবা বললেন, ‘তুমি যেখানেই থাকো না কেন, নিজ দেশকে ভুলে যেয়ো না। ভুলে যেয়োনা সেই স্থান, যেখানে তুমি বেড়ে ওঠেছো। নিজ পরিবারের ঠিকঠাক যত্ন নাও, আর নিজ সন্তানদের ন্যায়পরায়ণ হিসেবে গড়ে তোলো। তোমার স্ত্রী ও সন্তানেরা তোমাকে সর্বদা আরামে রাখে, সুখী রাখে। তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা, আমার সাথে ভালো ব্যবহার করার সমান।’
আমার মনে আছে, দাদাকে সবসময় সম্মান ও মান্য করতেন আমার বাবা। তিনি উইঘুরদের পুরাকথা মেনে চলতেন। উইঘুর পুরাকথা আছে যে, পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করা আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য অসিয়ত।
তিনি আমাকে অনেক উপদেশ দিয়েছিলেন। যেন তিনি জানতেন যে, এটাই আমাদের শেষ কথোপকথন। আমার ভাবনাতেও আসেনি যে, এটাই আমাদের শেষ কথোপকথন। চার বছর চলে গেল একদিনের মতো করে। আমি সর্বদা তার কণ্ঠ মিস করি; মিস করি তার দয়া ও ন্যায়পরায়ণতাকে। তার চেহারা সর্বদা আমার হৃদয়ে ভাসে।
মাঝে মাঝে তাকে আমি স্বপ্নে দেখি, কথা বলি তার সাথে। ‘আমার প্রিয় বাবা! আমি আপনাকে খুব বেশি মিস করি। আমি বুঝেছি, আপনি আমাদের বড় করতে কত ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এখন যে আমিও আমার সন্তানদের পিতা। মাঝে মাঝে আপনি বলতেন, প্রত্যেকেই তার সন্তানদের অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসে। যখন আমার সন্তানদের সাথে খেলি, তখনই আপনার কথা মনে পড়ে এবং আপনাকে খুব মিস করি। আপনি বাবা হিসেবে আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন। আমার দায়িত্ব তো কেবল শুরু হয়েছে।’
উইঘুরদের একটি পুরাকথা আছে: সন্তান হলো তার বাবার গোপন সম্পদ। ‘যখনই দেখি যে, আমি আপনার স্বভাব-প্রকৃতির উত্তরাধিকারী হয়েছি, আমি স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানাই আমাকে এমন চমৎকার বাবা উপহার দেওয়ার জন্য। আপনার হাসিমাখা মুখ আমার মোটিভেশন। আমার সন্তানদের মধ্যে এই ভালো বৈশিষ্ট্যগুলোর সম্মিলন ঘটানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। আপনার নম্রতা এবং বিচক্ষণতা আমাকে ধৈর্য্যের গুরুত্বের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়। আপনার ন্যায়পরায়ণতা আমাকে শেখায় কীভাবে শত্রু থেকে বন্ধুকে পার্থক্য করতে হয়। আপনি আমার গর্ব, আমার প্রেরণার বাতিঘর, আমার ভালোবাসার উৎস।
আল্লাহ আপনার প্রতি রহম করুন এবং যদি জীবিত থাকেন, তবে হেফাজত করুন। আর যদি আপনি ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করে থাকেন, তবে আপনাকে আল্লাহ জান্নাত দান করুন।
মূল লেখক: আব্দুর রহিম ঘেনি উইঘুর
তথ্যসূত্র:
——–
1. My last conversation with my father
– https://tinyurl.com/yc2p59wf