পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত শরণার্থীদের পুনর্বাসনে তালিবানের জোর প্রস্তুতি

- সাইফুল ইসলাম

0
1191

গত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে একের পর এক ভয়াবহ যুদ্ধে বিধ্বস্ত একটি দেশ আফগানিস্তান। যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে অনেক আফগান নাগরিক পাকিস্তানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি পাকিস্তান প্রশাসন এই আফগান শরণার্থীদের প্রতি চরম বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ শুরু করেছে। আফগানিস্তানসহ সকল দেশের শরণার্থীদেরকে পাকিস্তান ত্যাগ করার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। গত ৩১শে অক্টোবরের মধ্যে পাকিস্তান ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানের এমন আচরণ ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধের আদর্শের বিপরীত, আর এটি ভালো প্রতিবেশীসুলভ আচরণও নয়।

পাকিস্তানের এমন অমানবিক আচরণের কারণে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছেন আফগান শরণার্থীরা। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই মানবেতর অবস্থায় আফগানিস্তানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন হাজার হাজার শরণার্থী।

বর্তমানে আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতায় রয়েছেন ইমারতে ইসলামিয়ার তালিবান প্রশাসন। পশ্চিমা দেশগুলো আফগানিস্তানের উপর নানা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে, তালিবান প্রশাসনকে এখনও স্বীকৃতি দেয়নি কোনো দেশ, উপরোন্তু আফগানদের রিজার্ভের অর্থও আটকে রেখেছে আমেরিকা। এমন প্রতিকূল পরিবেশেও ইমারতে ইসলামিয়া সরকার পাকিস্তান কর্তৃক বিতাড়িত আফগান শরণার্থীদের জন্য নিজেদের উজাড় করে দেবেন বলে জানিয়েছেন। শরণার্থীদের জন্য যথাসম্ভব প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করবে বলে জানিয়েছে তালিবান প্রশাসন।

শরণার্থীদের সহায়তা করার লক্ষ্যে আমিরুল মুমিনীন শাইখ হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদাহ হাফিজাহুল্লাহ-এর নির্দেশক্রমে একটি কমিশনও ইতোমধ্যে গঠন করা হয়েছে। তুরখাম এবং স্পিন বলদাক সীমান্ত এলাকায় এই কমিশন শরণার্থীদের সহায়তা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

কান্দাহার প্রদেশের স্থানীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁরা প্রত্যাবর্তনকারী আফগান শরণার্থীদের জন্য জরুরিভিত্তিতে ক্যাম্প তৈরি করছেন। এছাড়া ওষুধ, খাদ্য, নগদ অর্থ এবং পরিবহনের মতো মৌলিক প্রয়োজনগুলো শরণার্থীদের প্রদান করছেন ইমারতে ইসলামিয়া কর্তৃপক্ষ।

ইমারতে ইসলামিয়ার জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ডা. শারাফাত জামান বলেছেন, তুরখাম সীমান্তে আফগান শরণার্থীদের সেবা প্রদানে ব্যস্ত রয়েছেন কয়েক ডজন স্বাস্থ্য কর্মী। দ্রুতই সেখানে ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম এবং সরঞ্জামাদিও পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

ইমারতে ইসলামিয়ার সহকারী মুখপাত্র বিলাল কারিমি বলেন, জাতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুভমেন্ট ব্রিগেড কমান্ড ছোট বড় শত শত বাহন, জেনারেটর, পানির ট্যাংকার, ভ্রাম্যমাণ টয়লেট এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি পাঠানো অব্যাহত রেখেছেন।

এদিকে, ইমারতে ইসলামিয়া সরকার বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী আফগান শরণার্থীদের বিষয়ে একটি ঘোষণাপত্র জারি করেছেন। ঘোষণাপত্রে বলা হয়, গত ৪৫ বছর ধরে আফগানরা বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ ও আগ্রাসনের কারণে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন এবং দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। আফগানদের উপর এমন পরিস্থিতি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে এই আফগান শরণার্থীরা বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, আশ্রয় নেওয়া দেশ থেকে তাদের বিতাড়িত করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ইমারতে ইসলামিয়া সরকার কিছু বিষয় স্পষ্ট করেছেন তাদের ঘোষণাপত্রে। ঘোষণাপত্রে বলা হয় –

১. সর্বপ্রথম আমরা সেসব দেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই যারা গত ৪০ বছর আফগানদেরকে তাদের দেশে জায়গা দিয়েছেন। এখন আমরা আবারও তাদেরকে আহ্বান জানাই, আফগানদেরকে কোনোরকম পূর্ব-প্রস্তুতিহীন অবস্থাতে আপনাদের দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করবেন না। তাদেরকে বরং পর্যাপ্ত সময় দিন। দেশগুলোর উচিত ভালো প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করা, ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানবিক আবেদনকে গুরুত্ব দেওয়া।

২. আফগানরা ঐ দেশগুলোতে নিরাপত্তা সমস্যা সৃষ্টি করেনি। অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিতেও আফগানরা জড়িত নন।

৩. আমরা চাই প্রতিবেশী দেশগুলো ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধের মূলনীতি মাথায় রেখে আফগান শরণার্থীদের সাথে ভালো আচরণ করুক।

৪. যেসব দেশ আফগান শরণার্থীদেরকে তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করছে, সেই দেশগুলো থেকে আফগানরা স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সময় নিজেদের সাথে যে পণ্য, অর্থ এবং অন্যান্য মালামাল বহন করে আনছে এগুলো তাদের ব্যক্তিগত সম্পদ এবং তাদের অধিকার। এক্ষেত্রে এগুলো রেখে আসার বা তাদের উপর কোনো অন্যায় ও অন্যায্য শর্তারোপ করার অধিকার কারো নেই।

৫. সাম্প্রতিক সমস্যাবলির কারণে যেসকল আফগান অন্য দেশ থেকে বাধ্য হয়ে নিজ দেশে ফিরে আসছেন, তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীসহ সকল আফগানদের দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা উচিত। আর ফিরে আসা শরণার্থীদের স্থানান্তর, বাসস্থান, আশ্রয়, চিকিৎসা এবং অন্যান্য সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলোতে সবার হাত প্রসারিত করা উচিত।

৬. ইমারতে ইসলামিয়া বর্তমানে আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতায় আছেন। সরকার হিসেবে তারা পুরো দেশে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন এবং আফগানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের পরিবেশ কায়েম রেখেছেন। তাই ইমারতে ইসলামিয়ার কর্মকর্তাদেরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে প্রত্যাবর্তনকারী শরণার্থীদেরকে আন্তরিকতার সাথে সম্ভাব্য সকল উপায়ে সাহায্য করতে।

৭. বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত প্রত্যাবর্তনকারী ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও শিল্পপতিদেরকে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেওয়া।

৮. যেসব আফগান নাগরিক রাজনৈতিক কারণে দেশ ত্যাগ করেছেন, তাদেরকে আমরা দেশে ফিরে শান্তিতে বসবাস করার নিশ্চয়তা দিচ্ছি।

আফগান জাতি এবং ইমারতে ইসলামিয়া সরকার স্বদেশে প্রত্যাবর্তনকারী আফগান অভিবাসীদেরকে সাদরে গ্রহণ করে নিতে প্রস্তুত বলেও জানানো হয়েছে ইমারতে ইসলামিয়ার এই বিবৃতিতে। দেশে ফিরে আফগানিস্তানের উন্নয়নে অংশ নেওয়ার আহ্বানও জানান তাঁরা। আর আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ এবং বিশেষত ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদেরকে নিজেদের প্রত্যাবর্তনকারী অভিবাসী ভাই-বোনদেরকে সাহায্যের জন্য মাঠে নেমে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন ইমারতে ইসলামিয়া সরকার।



 

তথ্যসূত্র:

1. Facilitation of returning refugees underway in Spin Boldak, Torkham
https://tinyurl.com/2cmpa38u
2. Declaration of the Islamic Emirate on Afghan Refugees in Pakistan and Other Countries
https://tinyurl.com/mryr9dub
3. Arms of the homeland open for returning refugees
https://tinyurl.com/ye6ukab4

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধভারতে ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়ানোয় আটক ৪
পরবর্তী নিবন্ধজাবালিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় এক পরিবারেরই ১৯ সদস্য নিহত