৩য় দোহা বৈঠকে ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের ন্যায্য দাবি

0
465

সম্প্রতি কাতারের রাজধানী দোহায় অনুষ্ঠিত হল জাতিসংঘ আয়োজিত ৩য় দোহা বৈঠক। ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানকে উপলক্ষ করে আয়োজিত এই বৈঠকে আফগানিস্তানসহ বিশ্বের ৩১টি দেশের প্রতিনিধিবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। উক্ত বৈঠকে আফগানিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে ইমারতে ইসলামিয়া সরকারের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ হাফিযাহুল্লাহ বক্তব্য প্রদান করেন।

বক্তব্যের শুরুতে তিনি সভায় উপস্থিত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের ইমারতে ইসলামিয়ার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানান। আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘের এমন উদ্যোগে নিজ দেশ ও জনগণের প্রতিনিধি হতে পেরে তিনি আনন্দ অনুভূতি প্রকাশ করেন। স্বাগতিক দেশ হিসেবে তিনি কাতার সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।

সভায় অংশগ্রহণকারীদের সম্বোধন করে তিনি বলেন, আফগান জাতি প্রায় অর্ধশতাব্দী সময়ব্যাপী বিদেশী আগ্রাসনের স্বীকার হয়েছিল। যুদ্ধ ও নিরাপত্তাহীনতা দেশটির নিত্ত-নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের ইতিহাস রচনা করে শেষ পর্যন্ত এই জাতি স্বাধীনতা অর্জন করেছে। তা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক খাতে দেশটির উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে এই দেশের সরকারি ও বেসরকারি খাত প্রতিনিয়ত নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। তিনি এই সকল নিষেধাজ্ঞা ও বিধিনিষেধের ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, ইমারতে ইসলামিয়া সরকারের নীতিগত ব্যাপারে মতপার্থক্য থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এটিকে কেন্দ্র একতরফা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ আরোপ করা পুরোপুরি অযৌক্তিক।

এই সমস্ত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে তালেবান সরকার দেশ থেকে মাদক চাষ ও মাদকদ্রব্য নির্মূলের নজির স্থাপন করেছে বলে তিনি জোর দিয়ে বলেন। যা বর্তমানে শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে।

তিনি আরও জানান, দেশের অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করতে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে এই সরকার। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিল্পকারখানা স্থাপন, দারিদ্র দূরীকরণ ও নারী উদ্যোক্তার বিস্তার করতে প্রাথমিক উদ্যোগসমূহ ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে ইমারতে ইসলামিয়া সরকার। একই সাথে বিগত ৩বছরে ইমারতে ইসলামিয়া সরকার একটি শক্তিশালী ও কর্তৃত্বপূর্ণ শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে।

অর্থনীতিমুখীতা ইমারতে ইসলামিয়ার পররাষ্ট্রনীতির অপরিহার্য একটি উপাদান বলে তিনি মন্তব্য করেন। অর্থনীতিমুখী বৈদেশিক নীতির মাধ্যমে তারা প্রতিবেশী দেশসমূহের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করছে। এই লক্ষে মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে আফগানিস্তান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে গ্যাস জ্বালানি পরিবহনে চলমান গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন(টিএপিআই) মেগা প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধনের বিষয় তিনি তুলে ধরেন। এছাড়া উত্তর-দক্ষিণ করিডোর স্থাপনের ব্যাপারে তিনি আশ্বস্ত করেন ও এতে অংশীদার দেশসমূহের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন।

এছাড়া সমগ্র আফগান ভূমিতে বর্তমানে বিরাজমান নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার বিষয়টি তিনি সকলের দৃষ্টিগোচর করেন। পাশাপাশি মানবিক সহায়তায় ইমারতে ইসলামিয়ার পাশে দাঁড়ানো দেশসমূহের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

তিনি উল্লেখ করেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে পশ্চিমাদের বিরোধিতামূলক প্রচার সত্ত্বেও ইমারতে ইসলামিয়া আঞ্চলিক দেশসমূহের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের প্রমাণ দেখিয়েছে। তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে জানান, ইমারতে ইসলামিয়া সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ লালন করে। এই মূল্যবোধ নিয়েই তারা সার্বভৌম রাষ্ট্রের মত অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবে। পশ্চিমা দেশেরও উচিত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখা এবং এই নীতিকে মেনে নেয়া। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী প্রতিটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, মূল্যবোধ ও পছন্দ-অপছন্দকে সম্মান করা সকলের কর্তব্য।

তিনি দৃষ্টান্ত পেশ করে বলেন, কাজাকিস্তান সরকার তালেবানকে নিষিদ্ধ গোষ্ঠীর তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে, চীন ইমারতে ইসলামিয়ার রাষ্ট্রদূতকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। এছাড়া অনেক দেশই ইমারতে ইসলামিয়া সরকারকে কূটনীতিকদের সাথে মত বিনিময়ে আহ্বানের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে।

এছাড়া তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ফিলিস্তিনের মানবিক বিপর্যয়ের ব্যাপারে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন ইতিহাসের সর্বনিকৃষ্ট এই গণহত্যায় মানবাধিকারের দাবিদার দেশসমূহ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের বিশ্বাসঘাতকতার মুখোশ উন্মোচন করেছে।

তিনি দোহা বৈঠক ফলপ্রসূ করতে কয়েকটি ন্যায়সঙ্গত দাবিদাওয়া পেশ করেন:

প্রথমত, ইমারতে ইসলামিয়ার উপর চাপিয়ে দেয়া সমস্ত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও অযৌক্তিক শর্তারোপ প্রত্যাহার করতে হবে। দ্বিতীয়ত আফগান জনগণের বৈধ সম্পত্তি অর্থাৎ আফগানিস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমস্ত বৈদেশিক রিজার্ভ ছাড় দিতে হবে এবং তা ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে দিতে হবে। উল্লেখ্য যে, তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের সময় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকা আফগানিস্তানের ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার রিজার্ভ বাজেয়াপ্ত করেছিল, যা মূলত আফগান জনগণের বৈধ সম্পদ। তৃতীয়ত তিনি বলেন, ইমারতে ইসলামিয়া সরকার কৃষকদের জন্য বর্তমানে পপি চাষের বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বিষয়টি সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও একই সাথে এগিয়ে আসতে হবে। কেননা আফগানিস্তানে মাদক নিষিদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে বিশ্বের অন্যান্য দেশও একইভাবে উপকৃত হচ্ছে।

উত্থাপিত সমস্যাগুলো সমাধানে তিনি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের প্রস্তাব করেন। পরিশেষে প্রস্তাবিত দাবিসমূহ পূরণে উপস্থিত প্রতিনিধিগণ ভূমিকা রাখবে এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তিনি বক্তব্য শেষ করেন।

উল্লেখ্য যে, শর্ত মেনে না নেয়ায় ইতোপূর্বে অনুষ্ঠিত প্রথম ও দ্বিতীয় দোহা বৈঠকে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত ছিল ইমারতে ইসলামিয়া সরকার। এর মধ্যে অন্যতম একটি শর্ত ছিল, ইমারতে ইসলামিয়া সরকারকে আফগানিস্তানের একমাত্র সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে বৈঠকে আমন্ত্রণ করা।


তথ্যসূত্র:
1. Speech by Honorable Zabihullah Mujahid, Head of the Delegation of the IEA, at the Inauguration Ceremony of the Doha Meeting
– https://tinyurl.com/ywttb8cp

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধইসলামের সাথে যুদ্ধ: তাজিকিস্তানে নিষিদ্ধ হলো হিজাব ও ঈদ উদযাপন
পরবর্তী নিবন্ধফিলিস্তিনের জিহাদ || আপডেট – ৩ জুলাই, ২০২৪