সোভিয়েত বিরোধী আফগান যুদ্ধ: একটি পরাশক্তির পরাজয়ের গল্প

0
201

৩৬ বছর আগে, শেষ সোভিয়েত সৈনিকটি এক দশকের পরাজয় এবং রক্তপাতের পর আতঙ্কে আফগানিস্তানের হায়রাত সেতু পার হয়েছিল। সোভিয়েতরা এই যুদ্ধকে কয়েকদিনের ও দ্রুততম সময়ে শেষ হওয়া একটি যুদ্ধ বলে মনে করেছিল, কিন্তু এই যুদ্ধ এমন এক জলাবদ্ধতায় পরিণত হয়েছিল যা তাদের সেনাবাহিনীকে ক্লান্ত করে দিয়েছিল এবং তাদের সাম্রাজ্যের পতন ডেকে এনেছিল।

আফগানদের প্রতিরোধ কীভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী পরাশক্তিদের একটি সাম্রাজ্যকে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য করেছিল? আফগানদের এই বিজয় কীভাবে বিশ্ব ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণ ছিল? সেই গল্প নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন…

আগ্রাসন এবং প্রতিরোধ

সময়টা ১৯৭৯ সালের ২৪শে ডিসেম্বর। সোভিয়েত বাহিনী সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট সরকারকে সমর্থন করার জন্য আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ১ লক্ষ ৫ হাজার সৈন্য নিয়ে আফগানিস্তান আক্রমণ চালায়। এসময় সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে, দেশটিতে সর্ব প্রকার জুলুম, নির্যাতন এবং ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে থাকে। আগ্রাসী সোভিয়েত বাহিনীর এধরণের কর্মকাণ্ড আফগানদের হৃদয়ে প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ফলে দেশটির সকল শ্রেণীর মানুষ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হন, শুরু হয় ইতিহাস পাল্টে দেওয়া সোভিয়েত বিরোধী আফগান যুদ্ধ।

ধ্বংস ও রক্তাক্ত প্রতিরোধ যুদ্ধের এক দশক

আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্ব কেবল একটি আক্রমণ ছিল না, বরং প্রায় ১০ বছর স্থায়ী একটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ ছিল। এই যুদ্ধে দেড় মিলিয়নেরও বেশি আফগান শহীদ হন, আহত হয়েছেন কয়েক লক্ষ মুসলিম। আর বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ৫০ লক্ষেরও বেশি লোক। কিন্তু সোভিয়েতদের সমস্ত দমন-পীড়ন সত্ত্বেও আফগানরা হাল ছেড়ে দেননি। এসময় ঈমান ও দেশ রক্ষায় আফগানদের দৃঢ়সংকল্পের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের সাহায্যে এই ভূমিতে আগমন ঘটে শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম, শাইখ ওসামা, আইমান ও আবু মুস’আব আস-সূরীদের মতো মহান জিহাদি নেতা ও অসংখ্য আরব-আজমের জানবায মুজাহিদদের। এই মুজাহিদরা অসম সামরিক শক্তির অধিকারী সোভিয়েতদের সামনে প্রতিরোধের পথ থেকে পিছু হটেননি। তারা ঈমানী শক্তিতে বলিয়ান অটুট হৃদয় আর মুসলিম বিশ্বের ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন।

এই যুদ্ধে আরব-আজমের মুজাহিদিনরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সোভিয়েত বাহিনীর উপর বেদনাদায়ক আঘাত হানতে থাকেন। অসম এই যুদ্ধে মুজাহিদদের অগ্রগতির সাথে সাথে সোভিয়েত সেনাবাহিনী পাহাড় এবং উপত্যকায় মুজাহিদিনদের কাছ থেকে তীব্র আঘাতের সম্মুখীন হতে থাকে। মুজাহিদিনরা দুর্গম ভূখণ্ড, উঁচুনিচু পাহাড় এবং গেরিলা যুদ্ধের কৌশলের সুযোগ নেন। দীর্ঘ ১০ বছরের অসম এই লড়াইয়ে সোভিয়েত বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১৫ হাজারেরও বেশি নিহত এবং কয়েক হাজার আহত। ব্যাপক এই হতাহতের ফলে সোভিয়েত বাহিনীর যুদ্ধের মনোভাব ভেঙে পড়ে।

পরাজয়ের রাস্তা: হায়রাত সেতু

দৃঢ় চিত্তের অধিকারী আফগান ও আরব-অনারবের মুজাহিদদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষতি বাড়তে থাকে। এতে অভ্যন্তরীণ চাপ বাড়তে থাকে, ফলে মস্কো এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে শুরু করে। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালে জেনেভা চুক্তির মাধ্যমে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনী প্রত্যাহারের পথ প্রশস্ত করে। কিন্তু সত্য হল যে, এই বিজয় জেনেভা চুক্তির ফলাফল ছিল না, বরং মহান রাব্বুল আলামিনের সাহায্য, আফগানদের দৃঢ়তা এবং মহান ত্যাগই এই ফলাফল এনে দিয়েছিল। আর চুক্তিটি ছিলো সোভিয়েত বাহিনীর নিজেদের ক্ষতি কিছুটা কমিয়ে আনার একটি শেষ প্রচেষ্টা।

ইতিহাসের পাঠ: আফগানিস্তান সাম্রাজ্যবাদীদের কবরস্থান

সোভিয়েত বিরোধী এই যুদ্ধের ফলাফল কেবল আফগানিস্তানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং সোভিয়েত ইউনিয়নের কেন্দ্রস্থলেও বিস্তৃত ছিল। কেননা আফগানদের বিজয় ও দখলদারদের পরাজয় ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ব্যবস্থার পতন এবং ইউনিয়নের ভাঙনে অবদান রাখে। এর‌ই মধ্য দিয়ে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটে।

সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধে ঐতিহাসিক এই বিজয়ের মাধ্যমে আফগানরা প্রমাণ করেছিল যে, তাদের দেশ দখল করার ভূমি নয়, বরং হানাদারদের কবরস্থান।

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাশ্মীরি মুসলিমের বাড়ি বাজেয়াপ্ত করলো দখলদার ভারতীয় বাহিনী
পরবর্তী নিবন্ধতিন জিম্মির বিনিময়ে মুক্তি পেতে যাচ্ছেন ৩৬৯ ফিলিস্তিনি