
ভারতের আস্থা অর্জনের নামে বাংলাদেশ সরকারের কলকাতা মিশনে দীর্ঘদিনের কোরবানি প্রথা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন নতুন ডেপুটি হাইকমিশনার শাবাব বিন আহমেদ। দায়িত্ব গ্রহণের আগেই সে মিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোরবানি বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলেছে। এই সিদ্ধান্ত জানাজানি হতেই মিশনের ভেতরে এবং কূটনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, কলকাতা মিশনে দীর্ঘ তিন দশক ধরে কোরবানির একটি রেওয়াজ চলে আসছে। প্রতি বছর কোরবানির ঈদ উপলক্ষে পাঁচ থেকে সাতটি গরু ও ছাগল জবাই করা হয় এবং সেগুলোর গোশত এতিমখানা, দরিদ্র মুসলিম ও আশপাশের বাসিন্দাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। মিশনের কর্মকর্তাদের মতে, এটা কেবল ধর্মীয় আচার নয়, একটি সামাজিক দায়িত্ব এবং স্থানীয় মুসলিমদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
নতুন ডেপুটি হাইকমিশনার শাবাব বিন আহমেদ অবশ্য ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। সে বলেছে, মিশনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ২৫ জনেরও বেশি কর্মী হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং তারা গরুকে পূজা করে। সেই গরু জবাই করলে তাদের মনের ওপর প্রভাব পড়ে। এমনকি সে দাবি করেছে, গত বছর মিশনে কোরবানি করার ফলে ভেতরের পরিবেশ নোংরা হয়েছিল এবং যেখানে-সেখানে পশু জবাই করা যাবে না এ মর্মে কলকাতা হাইকোর্টের রায়ও রয়েছে।
তবে এই বক্তব্য নিয়ে মিশনের অন্যান্য কর্মকর্তারা তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। একজন কূটনীতিক বলেন, এখনো দায়িত্ব নেননি, অথচ এমন স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত আগেভাগে জানিয়ে দেওয়া কূটনৈতিক রীতিনীতির পরিপন্থী। কোরবানি বন্ধের সিদ্ধান্ত হেডকোয়ার্টার কিংবা হাইকমিশনার নিতে পারেন, ডেপুটি নন। তিনি আরও বলেন, শাবাব বিন আহমেদের বক্তব্য আর আরএসএসের বক্তব্যের মধ্যে তফাৎ করা যাচ্ছে না।
এদিকে স্থানীয় পর্যায়ে বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর কলকাতার একাধিক হিন্দু সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী ফোন করে বাংলাদেশ মিশনের সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, কলকাতায় কোরবানি বন্ধ হলে সেটা রাজনৈতিক ইস্যুতে রূপ নেবে এবং বিজেপি ও আরএসএস একে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করবে। পশ্চিমবঙ্গের মমতা সরকার বরাবরই কোরবানিকে ধর্মীয় সহনশীলতার উদাহরণ হিসেবে দেখে, এমন অবস্থায় মিশনের এই সিদ্ধান্ত তারা ভালোভাবে নেবে না বলেই ধারণা।
মিশনের ভেতরে শাবাব বিন আহমেদের আচরণ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন অনেকে। কর্মকর্তারা জানান, জানুয়ারি মাসে তার পোস্টিং হলেও জুনে দায়িত্ব নেওয়ার কথা রয়েছে। অথচ এখন থেকেই সে কোরবানি বন্ধে চিঠিপত্র ও মৌখিক নির্দেশ দিচ্ছে। কর্মকর্তারা বারবার তাকে বুঝিয়ে বলেছে, বিষয়টি স্পর্শকাতর এবং এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া তার এখতিয়ারে পড়ে না। তারা এমনকি তাকে অনুরোধও করেছেন যেন সে কোরবানির পর দায়িত্ব গ্রহণ করে, কিন্তু সে তা প্রত্যাখ্যান করে ২ জুন দায়িত্ব নেওয়ার কথা জানিয়ে কোরবানির যাবতীয় প্রস্তুতি বন্ধের নির্দেশ দেয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কূটনীতিক বলেন, আমি বিস্মিত। দায়িত্ব না নিয়েই এমন সিদ্ধান্ত, আর এ ধরনের বক্তব্য, এটা রহস্যজনক ও বিপজ্জনক। এমনও হতে পারে, দিল্লি হাইকমিশনে কর্মরত অবস্থায় তিনি বিজেপির আদর্শে প্রভাবিত হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, এই সিদ্ধান্ত কেবল ধর্মীয় নয়, কূটনৈতিকভাবে একটি অস্বাভাবিক বার্তা বহন করে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে।
এর মধ্যেই ভারতীয় প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে শাবাব বিন আহমেদের নিয়োগকে ঘিরে একটি বিশাল প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যখন উত্তপ্ত, তখন কলকাতা মিশনে তার নিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবেদনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র ধরে শাবাবকে প্রশংসিত করা হয় এবং বলা হয়, তিনি সংখ্যালঘু সুরক্ষা, সাম্প্রদায়িকতা ও অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ভূমিকা রাখবেন। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এসব বার্তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কূটনীতিতে একটি অশুভ ইঙ্গিত বহন করে।
সবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ মিশনে কোরবানি বন্ধ করা নিছক একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং তা ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার প্রশ্নে এক গুরুত্বপূর্ণ বিপদসংকেত।
তথ্যসূত্র:
1. ভারতের আস্থা অর্জনে কলকাতা মিশনে কোরবানি বন্ধের নির্দেশ
– https://tinyurl.com/yudftvj9