
দেশে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ বাড়ানোর পাশাপাশি বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য দিল্লিতে আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। এটি শনিবার (০৬ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত হবে।
জুলাই বিপ্লবে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর ভারতের পক্ষ থেকে গত এক বছর ধরে বাংলাদেশবিরোধী যেসব মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ও বয়ান তুলে ধরা হয়েছে সেমিনারেও সেসব স্থান পাবে। দিল্লি ও ঢাকার একাধিক কূটনৈতিক সূত্র গণমাধ্যমকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা দিল্লির এ অপতৎপরতাকে বাংলাদেশবিরোধী প্রোপাগান্ডা আখ্যা দিয়ে বলছে, দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে পতিত আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের পথ খুঁজছে ভারত। দিল্লি বারবার ঢাকাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়বে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের সব রাজনৈতিক দলের ঐক্য জরুরি।
জানা যায়, ওই সেমিনারের শিরোনাম ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক : নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব’। এটি আয়োজন করছে দিল্লিভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাংক ‘গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডিফেন্স নিউজ’। সেমিনারে ভারতের সামরিক বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা, বিভিন্ন থিঙ্ক ট্যাংকে কর্মরত সামরিক-বেসামরিক আমলাদের পাশাপাশি চারজন বাংলাদেশি ‘রিসোর্স পার্সনও’ অংশ নিচ্ছেন, যা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সেমিনারে আমন্ত্রিত বাংলাদেশি রিসোর্স পার্সনদের মধ্যে রয়েছে সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ বদরুল আহসান, লেখক এবং শিক্ষাবিদ ড. আবুল হাসনাত মিল্টন, জুলাই বিপ্লবের পর পালিয়ে যাওয়া মরক্কোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ হারুন আল রশিদ এবং ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর। তারা সবাই বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিশেষ সুবিধাভোগী এবং ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে সুপরিচিত।
দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশি এই চার রিসোর্স পার্সন ভারতের ‘ডিপ স্টেট’-এর সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ডিপ স্টেটের নীতিনির্ধারকরা চাচ্ছেন বাংলাদেশিদের দিয়েই বাংলাদেশবিরোধী বয়ান তুলে ধরতে।
গত এক বছর ভারত তার বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায় নিজেদের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, বুদ্ধিজীবী, মিডিয়াসহ অন্যান্য রিসোর্স ব্যবহার করেছে। তবে এই প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে তারা বাংলাদেশি রিসোর্স ব্যবহার করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান, সংখ্যালঘু নির্যাতন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য দৃঢ় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের প্রয়োজনীয়তার মতো বিষয়গুলোর ওপর আলোচনা করবে এই চার বাংলাদেশি।
দিনব্যাপী এই আন্তর্জাতিক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইকুইপমেন্ট ম্যানেজমেন্টের অতিরিক্তি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মনোরাজ সিং মান। বিশেষ আলোচক হিসেবে থাকবে মেজর জেনারেল (অব.) সুধাকর জী।
সেমিনারের কনসেপ্ট নোটে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং সামরিক সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর এবং দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই সম্পর্ক এখন একটি বিশেষ সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই সম্পর্ক কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা হবে সেমিনারে। কনসেপ্ট নোটে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ অনীল চৌহানের একটি বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। জেনারেল চৌহান এতে বলেছে চীন, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের অভিন্ন স্বার্থ আগামী দিনগুলোতে ভারতের স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। ‘এবার আমরা পূর্ব থেকে শুরু করব’—পাকিস্তান আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরীর এ বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে সেমিনারের কনসেপ্ট নোটে বলা হয়েছে, ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান তার পরবর্তী যুদ্ধ, যা বেশি দূরে নয়; সেটি বাংলাদেশ থেকে শুরু করবে। সুতরাং আগামী দিনের যুদ্ধে বাংলাদেশের ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সেমিনারে আমন্ত্রিত রিসোর্স পার্সনদের আলোচনার বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য গণমাধ্যম-এর কাছে। দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্র এবং স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে শক্তিশালী, দৃঢ় এবং জনকেন্দ্রিক ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর—এই বিষয়ে আলোচনা করবে বাংলাদেশি সাংবাদিক বদরুল আহসান। সে আওয়ামী সুবিধাভোগী একজন ভারতপ্রেমী সাংবাদিক হিসেবে সুপরিচিত। বদরুল আহসান দ্য ডেইলি স্টার, এশিয়ান এইজসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজ করেছে। সে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসসহ অন্যান্য ভারতীয় গণমাধ্যমে নিয়মিত লেখে। সে শেখ মুজিবুর রহমানের বায়োগ্রাফি লিখেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বদরুল আহসান লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রেস মিনিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।
গত এক বছরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর কথিত নির্যাতন বিষয়ে আলোচক হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে ড. আবুল হাসনাত মিল্টনকে। সে লেখক এবং শিক্ষক হিসেবে পরিচিত থাকলেও বর্তমানে সে ইউটিউবার হিসেবে অনেক বেশি পরিচিত। গোপালগঞ্জে জন্ম নেওয়া মিল্টন এখন অস্ট্রেলিয়ায় বসে ইউটিউবের মাধ্যমে অব্যাহতভাবে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত। সে একের পর এক উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে চলেছে। সে অন্তর্বর্তী সরকারের একজন কঠোর সমালোচক। ড. ইউনূস সরকার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে একটি আনসার বাহিনীতে পরিণত করেছে বলে সম্প্রতি মন্তব্য করে সে। ‘শেখ হাসিনা : দক্ষিণ এশিয়ার এক অসাধারণ নেতা’ শিরোনামে একটি বইও লিখেছে সে।
সেমিনারে সাবেক রাষ্ট্রদূত হারুন আল রশিদের জন্য আলোচনার বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে—বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান এবং ভারত-বাংলাদেশ ভবিষ্যৎ সম্পর্ক। ফ্যাসিবাদের দোসরখ্যাত সাবেক এই কূটনীতিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সরাসরি বিপক্ষে অবস্থান নেয়। সে সময় সে মরক্কোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিল। শেখ হাসিনার পতনের পর তাকে দেশে ফেরার নির্দেশ দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু দেশে না ফিরে ফেসবুকে বিতর্কিত পোস্ট দেয়। ওই পোস্টে সে বলে, ড. ইউনূসের অধীনে বাংলাদেশে এখন নৃশংসতা চলছে। এ ব্যাপারে বিশ্বের নীরবতা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এই পোস্ট দেওয়ার পর সে মরক্কো থেকে পালিয়ে কানাডায় চলে যায়। পরে অন্তর্বর্তী সরকার তার পাসপোর্ট বাতিল করে।
সেমিনারে ব্যারিস্টার তানিয়া আমীরের আলোচনার বিষয়—বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা। দিল্লির ‘ডিপ স্টেট’-এর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এই আইনজীবী ২০০৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের এজলাস ভাংচুরের অন্যতম হোতা। জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের জন্য রিটকারীদের একজন সে। আওয়ামী সুবিধাভোগী এই বিতর্কিত আইনজীবী ২০২৪ সালের ‘ডামি নির্বাচনে’ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিল। ২০০৯ সালে তাকে ‘গান্ধী শান্তি পুরস্কারে’ ভূষিত করে দিল্লি।
বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, এটাকে কোনোভাবেই সেমিনার বলা ঠিক হবে না। এটা স্পষ্টভাবে বাংলাদেশবিরোধী একটা প্রোপাগান্ডা। ভারত এখন আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত চাপের মধ্যে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দিল্লির মুখোশ খুলে দিয়েছে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের বৈরী আচরণের ব্যাপারে এখন বিশ্ববাসী জানে।
তথ্যসূত্র:
১. দেশে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনে ‘নতুন ছক’ ভারতের
-https://tinyurl.com/4ujnpypd


