
জীবিত অবস্থায় নিজেকে ‘ইমাম মাহদি’ দাবি করা নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলের মাজার ও বাড়িতে হামলা চালিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। এ সময় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
গত শুক্রবার (০৫ সেপ্টেম্বর) জুমার নামাজের পর রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ডে এই ঘটনা ঘটে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, নুরুল হক মোল্লা বা নুরাল পাগল রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পৌরসভার পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের হাতেম মোল্লার ছোট ছেলে। কৈশোর বয়স থেকে মাটির বদনা বাজিয়ে গান বাজনা শুরু করলেও পরবর্তীতে আশির দশকে নিজেকে ইমাম মাহদি দাবি করে দরবার প্রতিষ্ঠা করে।
ইমাম মাহদি দাবি ও পবিত্র কুরআন অবমাননা
নিজেকে মাহদি দাবি ও নানা অদ্ভুত ও শরীয়াহবিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে এলাকাবাসী তোপের মুখে ১৯৯৩ সালে এলাকা ছেড়ে চলে যায় নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগল। এরপর কিছুদিন পর আবার ফিরে এসে নিজেকে ইমাম মাহদি দাবি করে একটি দরবার খুলে বসে। দরবার থেকে পরিচালনা করা হতো ইসলামকে অবমাননা করে এমন নানা কর্মকাণ্ড। এসব কাজ স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণের সৃষ্টি করে।
স্থানীয়রা গণমাধ্যমকে জানায়, পবিত্র আল কুরআনকে “ভুজপাতা” বলে উপহাস করতো নুরাল পাগল। সে পবিত্র কুরআনকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। যা মুসলিম অধ্যুষিত এই জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাসের অপমান ও অবমাননা। এমনকি কুরআনকে পায়ের নিচে ফেলেও অবমাননা করে সে।
স্বতন্ত্র শরীয়ত
স্থানীয়রা গণমাধ্যমকে জানান, নুরাল পাগল ইসলামী মূল্যবোধকে অপমান ও অবজ্ঞা করে নিজে একটি স্বতন্ত্র শরীয়ত তৈরি করে। সেই শরীয়ত গ্রহণের জন্য সে নিজের নামে কালিমা চালু করে। কালিমা পাঠ করে নুরাল পাগলের ধর্মে প্রবেশ করতে হয়। নুরাল ইসলামের পবিত্র কালিমা বিকৃত করে “লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ এর পরিবর্তে ‘ লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ ইমাম মাহদি রসুলুল্লাহ’ তৈরি করেছিল, নাউজুবিল্লাহ। নিজের অনুসারীদের জন্য ইসলামের আযানকে বিকৃত করে নিজের নামে আজান চালু করেছিল ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ ‘ এর পরিবর্তে বিকৃত ‘আশহাদু আন্না ইমাম মাহদি রসুলুল্লাহ’ চালু করে।
নুরাল পাগল নিজে নামাজ পড়তো না। তার অনুসারীদের সে দক্ষিণ দিকে মুখ করে নামাজ পড়ার নির্দেশ দিত। এছাড়াও সে পবিত্র দরূদ শরীফের বিকৃতি করে নিজের নামে দরূদ চালু করে।
মৃত্যু ও কবর স্থাপন
গত ২৩ আগস্ট ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় গোয়ালন্দ মাজারের কথিত পীর নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগল। পরে তাকে দরবার প্রাঙ্গণে ১২ ফুট উঁচু বেদিতে দাফন করা হয়। বেদিটিকে কাবার আদলে তৈরি করা হয় এবং পাশে সাইনবোর্ডে লিখা হয় ‘ইমাম মেহেদি দরবার শরিফ’। যা সম্পূর্ণ ইসলামের বিকৃতি ও মুসলিমদের ধর্মীয় আবেগের স্পষ্ট অবমাননা।
আলেম-উলামা ও স্থানীয় তৌহিদি জনতার বিক্ষোভ
দীর্ঘদিন ধরেই নুরাল পাগলার শরীয়ত অবমাননা ও ইসলাম বিকৃতির প্রতিবাদ করে আসছিলেন স্থানীয় উলামায়ে কেরাম ও ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা। নুরুল পাগলের ইসলাম অবমাননা ও শরীয়ত বিকৃতির প্রতিবাদ এবং স্থানীয় মুসলিমদের ইমান ও আকিদা হেফাজতের জন্য ‘ইমান আকিদা রক্ষা কমিটি’ গঠন করেন স্থানীয় উলামারা।
পরপর কয়েকটি সংবাদ সম্মেলন করে নুরাল পাগলের ইসলাম বিকৃতি ও অবমাননার কথা জানানো হয়। স্থানীয় জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ ও স্মারকলিপি প্রদানের মাধ্যমে কবর সমতল, সাইনবোর্ড সরানোসহ ইসলাম বিকৃতির প্রতিবাদ জানানো হয়।
তবে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে স্থানীয় মুসলিম ও আলেম-উলামাদের মাঝে ক্ষোভ বাড়তে থাকে।
ফলে ৫ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুসারে বিক্ষোভ সমাবেশ আয়োজন করা হয়। এই বিক্ষোভ সামাবেশে স্থানীয় আলেম-উলামা ও বিএনপি, জামায়তসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতার উপস্থিত থাকেন এবং বক্তৃতা প্রদান করেন। বক্তব্যে বক্তারা বলেন কাবার অনুকরণে কবর নির্মাণ ইসলাম অবমাননা ও নীতিবিরোধি কাজ। তাই প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
পরে এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ জনতার একটি অংশ নুরাল পাগলর কথিত মাজার ভাঙচুর করে এবং এক পর্যায়ে কবর থেকে উত্তোলন করে তার লাশ পুড়িয়ে ফেলে।
মিডিয়ার এক-পাক্ষিক প্রচারণা
নুরাল পাগলের লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার পর দেশের মিডিয়াগুলো এক-পাক্ষিক প্রচারণায় মেতে ওঠে। তারা এই ইস্যুকে পুঁজি করে ইসলাম বিদ্বেষ ছড়াতে থাকে। মিডিয়ায় নুরাল পাগলের কবরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। অথচ হেফাজতে ইসলাম এই লাশ পুড়ানোর ব্যাপারে নিন্দা জনায় এবং একই সাথে প্রশাসনের উদাসীনতার নিন্দা করে। কিন্তু স্যাকুলার মিডিয়া নুরাল পাগলের ইতঃপূর্বে ইসলাম অবমাননার ঘটনাগুলো ইচ্ছাকৃত আড়াল করে প্রতিবাদকারী তৌহিদী জনতাকে ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করে।
প্রধান উপদেষ্টার নিন্দা ও ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের সাথে দ্বি-চারিতা
নুরাল পাগল ইস্যুর পর তৎক্ষণাৎ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করে। একই সাথে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনার হুশিয়ারিও দেয়।
অনেকেই বলছেন, এই বিশৃঙ্খলা ও খারাপ অবস্থার দায় অন্তর্বর্তী সরকার কোনভাবেই এড়াতে পারে না। কেননা স্থানীয় উলামায়ে কেরাম ও তৌহিদী জনতা বারবার প্রশাসনের কাছে ইসলাম অবমাননার প্রতিবাদে শাস্তির দাবি জানিয়েছেন এবং দ্রুত সময়ের মাঝে পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু প্রশাসন কোন ধরণের পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি। নির্লিপ্ত থেকেছে এবং এই ধরণের ঘটনার জন্যই অপেক্ষা করেছে বলেও অভিযোগ করেছে।
নুরাল পাগলের ঘটনার তাৎক্ষণিক পরেই একটি বিবৃতি প্রদান করে নিন্দা জানায় এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানায়। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার ওই বিবৃতিতে মুসলিমদের ধর্মীয় আবেগ ও ইসলামের অবমাননাকারী নুরাল পাগলের কোনো নিন্দা জানানো হয়নি। তার এই বিবৃতি স্পষ্ট মুসলিমদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ ও একটি দ্বিচারিতা।
নেটিজেনরা বলছেন, ০৫ আগস্টের পর দেশে একের পর এক ইসলাম ও মুসলিমদের আবেগ নিয়ে অবমাননা করছে একটি মহল। আল্লাহ তায়ালার শানে চরম অবমাননাকর শব্দ ব্যবহার করে ফেসবুকে পোস্ট করেছিল পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটির সদস্য রাখাল রাহা। অন্তর্বর্তী সরকার তার বিরুদ্ধেও কোনও পদক্ষেপ তো দূরের কথা একটি কথাও বলেনি। কোন মিডিয়া এই বিষয়ে দুটি লাইনও লেখেনি। যা ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের ধর্মীয় আবেগের জায়গায় আঘাত করেছে। উপরন্তু রাখাল রাহার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি কোনো শুনানি ছাড়াই খারিজ করে দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে মামলাটি দায়েরের সময় মামলাকারীকে হেনস্তা করা হয় এবং মামলা নিতেও অস্বীকার ও গড়িমসি করা হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি এক মুসলিম যুবতীকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে একটি বাড়িতে রেখে টানা সাতদিন ধর্ষণ করে এক হিন্দু যুবক। অন্তর্বর্তী সরকার এর বিরুদ্ধেও কোনো পদক্ষেপ তো দূরে থাক একটি বিবৃতিও দেওয়ার সাহস করেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপদেষ্টার নামে কটূক্তি করায় গ্রেফতারের ঘটনাও আমরা দেখতে পেয়েছি। একের পর এক আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর প্রিয় হাবিব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে কটূক্তি করা হলে সরকার চুপ থাকছে, কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। এমনকি মিডিয়াগুলো ইসলাম বিরোধী সংবাদ ঢালাওভাবে প্রচার করলেও এই সংবাদ প্রচারে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
এছাড়াও লালমনিরহাটে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রকাশ্যে অবমাননা করে হিন্দু নাপিত। স্থানীয় মুসলিমরা তার প্রতিবাদ করলে মিডিয়া সংখ্যালঘু নির্যাতন হিসেবে ঘটনাকে উপস্থাপন করে। সরকার এর দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নেয়নি।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে নিজ দেশে নিজের ইমান ও ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে বসবাস করা এই দেশের মুসলিমদের অপরাধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসলিমদের ঈমান ও বিশ্বাসের হেফাজত করতে বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে রাষ্ট্র।
তথ্যসূত্র:
১. https://tinyurl.com/5h5axjp5
২. https://tinyurl.com/mpk8zu9n
৩. https://tinyurl.com/yx3dvzwd


