অর্ডার কমছেই, অর্থবছরের প্রথম চার মাস রপ্তানিতে ধস । সাত মাসে ৫৯ কারখানা বন্ধ । প্রায় ২৯ হাজার শ্রমিক বেকার । সরকারি সহায়তা নেই, ব্যাংকও সহযোগিতা করছে না।
তৈরি পোশাকশিল্পে ভয়াবহ বিপর্যয় চলছে। অসম প্রতিযোগিতায় অসহায় হয়ে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। বিশ্বব্যাপী চলছে ব্যাপক মূল্য যুদ্ধ। অর্ডার কমিয়ে দিচ্ছেন ক্রেতারা।
চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রপ্তানি আয়ে ধস নেমেছে। ৫৯ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ২৮ হাজার ৭০০ পোশাক শ্রমিক বেকার হওয়ার তথ্য দিয়েছে বিজিএমইএ।
এ প্রসঙ্গে মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেছেন, পোশাকশিল্প ভালো যাচ্ছে না। বিশ্ববাজারও ভালো না। তবুও কোনো সরকারি সহায়তা পাচ্ছি না। ব্যাংকগুলোও অসহযোগিতা করছে। পাকিস্তানের মতো দেশও বাংলাদেশের চেয়ে ভালো করছে।
পাকিস্তান, তুরস্ক ও প্রতিবেশী ভারত সমানতালে পোশাক পণ্যের দাম কমিয়ে দিচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না, কীভাবে এই খাত চলবে। এত বড় শিল্প খাত ঘুরে না দাঁড়ালে দেশ ও অর্থনীতি কীভাবে চলবে?
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেছেন, প্রণোদনা যৌক্তিকীকরণ দরকার আছে। যেখানে রপ্তানি কমছে, সেটা প্রণোদনা দিয়ে কাজ হবে না। এখানে কাঠামোগত সংস্কার দরকার। তবে মুদ্রার অবমূল্যায়ন প্রয়োজন আছে। কারণ, টাকা বেশি অতিমূল্যায়িত হয়েছে। তারচেয়েও বেশি প্রয়োজন বিনিয়োগমুখী পরিবেশ নিশ্চিত করা। দীর্ঘ কয়েক বছরে এক্ষেত্রে বড় উন্নতি দেখছি না। চীনের বিনিয়োগ ও ক্রেতারা ভিয়েতনামে চলে গেলে বাংলাদেশের বিপদ আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং-সানেমের এই নির্বাহী পরিচালক।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রপ্তানি ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ কমেছে। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্বজুড়ে দ্বিতীয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশের খ্যাতি হারানোর ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বড় প্রতিযোগী বিশ্বের তৃতীয় পোশাক রপ্তানিকারক ভিয়েতনামের কাছে এই হারের আশঙ্কা। অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে গেছে ভিয়েতনাম।
জানুয়ারি-অক্টোবর ১০ মাসে বিদেশি ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় শ্রমিকদের বেতন-ভাতা, মজুরি এবং অফিসের ব্যয় বহন করতে না পেরে শুধু কারখানা বন্ধ হয়নি, চাকরি হারিয়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক। এখন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। অনেক কারখানা মালিক পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে ঠিকভাবে দরকষাকষি করতে পারছে না। অনেকে আবার অতিরিক্ত বিনিয়োগ করে আসছে। ফলে বর্তমানে তৈরি পোশাক খাতে দুরবস্থা চলছে। এ পরিস্থিতি আমরা সামলাতে পারছি না।
চলতি অর্থবছর শেষে আয়ের প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরের চেয়েও কমতে পারে। পোশাকশিল্পের এ পরিস্থিতির জন্য ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রার শক্তিশালী অবস্থান দায়ী। চিঠিতে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে পোশাক খাতে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১১ দশমিক ৯ শতাংশ। প্রথম ৪ মাসে রপ্তানি কমেছে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্থর ধারা অব্যাহত থাকতে পারে। মূল্যভিত্তিক প্রতিযোগিতায় অন্যদের সঙ্গে টিকে থাকতে না পারায় বাংলাদেশের এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের পোশাক খাতের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ৩ হাজার ৮২০ কোটি ডলার। তবে রপ্তানি হবে ৩ হাজার ১৯০ কোটি ডলার। অর্থবছরের শেষে ৭ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হবে। ২৫ শতাংশ স্থানীয় মূল্য সংযোজনের পরিমাণ ৭৯৮ কোটি ডলার। এই অঙ্কের ওপর ডলারপ্রতি পাঁচ টাকা অতিরিক্ত বিনিময় হার নির্ধারণ করা হলে, তাতে লাগবে ৩ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। যদিও চলতি অর্থবছর থেকে পোশাক খাতের জন্য নতুন করে ১ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দিতে বাজেটে ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, বিগত ২০০৯-১০ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৯৬ শতাংশ বা ১২ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৩৪ শতাংশ বা ৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। দেখা যাচ্ছে, প্রতিনিয়ত এ খাতের প্রবৃদ্ধি কমছে। বিগত পাঁচ বছরে (২০১৪-২০১৮) যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ ও ইউরোপের বাজারে ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ পোশাকের দরপতন হয়েছে। সর্বশেষ অক্টোবরে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অনেক কম। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধিতে ভিয়েতনাম অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিকস রিভিউ ২০১৯ প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), চীন, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ভারত, তুরস্ক, হংকং, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র এই শীর্ষ ১০টি দেশ ৪২ হাজার ১০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে, যা মোট রপ্তানির ৮৩ দশমিক ৩ শতাংশ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে চীন। বিশ্ববাজারে দেশটির হিস্যা ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ। চীনের পরই পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষ স্থানে আছে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম। বাংলাদেশ ৩ হাজার ২৯২ কোটি এবং ভিয়েতনাম ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। উভয় দেশের বাজার হিস্যা প্রায় কাছাকাছি। গত বছর ১০ শীর্ষ রপ্তানিকারকের মধ্যে বাংলাদেশের বাজার হিস্যা ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। ভিয়েতনামের বাজার হিস্যা হয়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ।
সুত্রঃ বিডি প্রতিদিন