আবদুল মজিদ মির। উদ্বিগ্ন এই বাবা শ্রীনগরের এক হাসপাতালের জনাকীর্ণ করিডোরে অপেক্ষা করছেন। তার সাথে আছে তার ১০ বছরের মেয়ে আরিফা। গত মাস থেকে মেয়েটি কেবল দুঃস্বপ্নই দেখে। প্রত্যেকের অস্বস্তিতে সে চিৎকার করে কান্না করে।
শুরুতে আরিফাকে নেয়া হয়েছিল ফকিরের কাছে। তিনি মেয়েটির মা-বাবাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে সাত দিন তাকে পবিত্র পানি দেয়া হলে সে সেরে যাবে। তিনি সারেনি। বরং প্রকোপে বেড়েছে, মাঝে মাঝেই সে রেগে যায়, অন্য সময় সে বিষণ্ন থাকে।
সাউথ এশিয়ান মনিটরকে মির বলেন, মিরের এক স্বজন তাকে পরামর্শ দেন আরিফাকে কোনো শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে। প্রথম দেখাতেই আরিফা সেনাবাহিনীর এনকাউন্টারে নিহত হওয়া নিয়ে তার ছোট ভাইয়ের দুঃস্বপ্নের কথা জানায়। সে জানায়, সেও এনকাউন্টারের স্থানে পাথর নিক্ষেপ করবে।
ভারতবিরোধী উগ্রবাদীদের উত্তপ্ত এলাকা দক্ষিণ কাশ্মিরের পুলওয়ামার বাসিন্দা আরিফারা। তাদের বাড়ির আশপাশ আছে ধান ক্ষেত আর আপেলের বাগান। ওই এলাকায় প্রায়ই বন্দুকযুদ্ধ হয়। কোনো বাড়িতে স্বাধীনতাকামীদের উপস্থিতি জানতে পারলে ভারতীয় মালাউন সন্ত্রাসী সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেটিকে গ্রেনেড দিয়ে উড়িয়ে দেয়, লাশগুলো বিকৃত করে চেনার অযোগ্য করে তোলে।
লোকজন প্রায়ই সেনা অভিযানে বিঘ্ন ঘটানো ও স্বাধীনতাকামীদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করার জন্য এনকাউন্টার স্থলে পাথর নিক্ষেপ করে। গত বছর এ ধরনের অভিযানে বিপুলসংখ্যক লোক নিহত হয়েছে।
মির বলেন, আরিফা নিশ্চয় তার বন্ধু ও স্বজনদের কাছে এসব নৃশংসতা ঘটনার কথা শুনেছে। তার এই অবস্থার কারণ এটিই।
আরিফার এক চিকিৎসক সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, তিনি যে হাসপাতালে কাজ করেন, সেখানে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা কেবল বাড়ছেই।
তিনি বলেন, অন্য লোকদের মতো কাশ্মিরে শিশুরাও ৫ আগস্ট থেকে খাঁচায় আটকে আছে। ৫ মাস ধরে তারা স্কুলে যেতে পারছে না, খেলতে পারছে না, ইন্টারন্টে নেই। যেটাকে স্বাভাবিক অবস্থা বলে মনে হচ্ছে, তা কৃত্রিম। বাস্তব অবস্থা ভয়াবহ ও বিপর্যয়কর।
এই শিশু বিশেষজ্ঞ গত দুই মাসে আক্রান্ত শিশু ও তাদের মা-বাবাদের অব্যাহতভাবে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। তবে তিনি নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চান না। তিনি বলেন, তাকে ও তার সহকর্মীদের কাশ্মিরের স্বাস্থ্যগত অবস্থা নিয়ে মিডিয়ার সাথে কথা বলতে বারণ করেছে কর্তৃপক্ষ।
তবে পরিচয় গোপন রাখা হবে, এই শর্তে রাজি হয়ে ওই চিকিৎসক বলেন, শিশুরাই মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে বেশি। আমরা যা অনুভব করি বা বুঝি, তা তারা অনেক বেশি ভাবায়। কাশ্মিরের বর্তমান পরিস্থিতি বয়স্কদের চেয়ে শিশুদেরই বেশি কষ্টে ফেলে দিয়েছে।
কাশ্মিরের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না, বন্ধুদের সাথে সাক্ষাত করতে পারছে না, তাদের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছে না।
তিনি বলেন, মা-বাবাকে বর্তমান পরিস্থিতিতে শিশুদের দিকে বেশি নজর রাখতে হবে। যদি মনে হয়, শিশুরা অদ্ভূত আচরণ করছে, তবে তাদের উচিত হবে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। আমরা এখন বিশেষ পরিস্থিতিতে বাস করছি।
আরিফার কয়েক মিটার দূরে ৮ বছরের হামাদ উদ্বিগ্নভাবে তাকাচ্ছে, সারাক্ষণ মায়ের জামা টেনে ধরছে, পীড়াপিড়ি করছে হাসপাতাল থেকে চলে যেতে।
আগের দিন হামাদ চতুর্থবারের মতো বাড়ি থেকে বের হয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরছিল। তার পরিবার খুঁজে তাকে বাড়ি নিয়ে আসে। তার জামার পকেটে তার ঠিকানা সেলাই করে দেয়া হয়েছে, যাতে সে হারিয়ে গেলেও লোকজন তাকে বাড়ি নিয়ে আসতে পারে।
হামাদের মা আমিনা বানু বলেন, আমরা জানি না, তার কী হয়েছে। সে এমন ছিল না কখনো। অক্টোবরে সে চিৎকার করে ওঠত, আমাদেরকে বলত মার্কেটে নিয়ে যেতে। অনিশ্চয়তা থাকায় আমরা তাকে নিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানাতাম। আর এতেই সে বিষণ্ন ও ক্রুদ্ধ হয়ে যেত।
মা জানান, এক দিন হামাদ কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত হারিয়ে গিয়েছিল। পরে দেখতে পাই, সে নোংরা রাস্তায় একাকী মার্বেল খেলছে।
বানু বলেন, আমি তাকে ওই দিন বেশ বকেছিলাম। এর কয়েক দিন পর আবারো সে নীরবে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। আমরা আবার তাকে খুঁজে পাই, তাকে দেখি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে।
এক প্রতিবেশীর পরামর্শে তিনি তার ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে এসেছেন। হাসপাতালে ডাক্তার হামাদকে যা ইচ্ছা আঁকতে বলেন। সে বাইরে থেকে কালো শেকল দিয়ে তালাবদ্ধ একটি বাড়ির ছবি আঁকে।
গত ৫ আগস্ট কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করার পর থেকে কাশ্মিরে স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে। স্কুর কলেজ এখনো বন্ধ রয়েছে।
কাশ্মিরের শৈশব বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো নিরাপদ, আনন্দময়, সুখের নয়। কাশ্মিরের এক শিশু গবেষক উলফাত আমিন বলেন, কাশ্মির নির্দোষ ও তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে থাকা এক টুকরা জায়গার মতো। এখানে বসবাসরত শিশুদের দৈনন্দিন জীবন বিক্ষোভ, প্রতিশোধ আর আধা সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিতে ভারাক্রান্ত হয়।
তার মতে, সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায় যে কাশ্মিরের সাম্প্রতিক গোলযোগ এখানকার শিশুদের মনোস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলছে। এর ফলে পিটিএসডিও হতে পারে। এছাড়া আরো নানা সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
কাশ্মিরের প্রখ্যাত শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ মোস্তাক মারগুব সম্প্রতি এক গবেষণাপত্রে বলেছেন, গত এক বছরে তিনি ১৬ বছরের কম বয়সী যত শিশুকে দেখেছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিশু আক্রান্ত রয়েছে ‘ডিসোসিয়েটিভ ডিসঅর্ডারে (২২.৬৯ ভাগ)। এরপর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিশু আক্রান্ত রয়েছে মেন্টাল রেটার্ডে (১৭.৬৪ ভাগ)। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ৮.৪ ভাগ, আর নিউরোটিক ডিসঅর্ডারে ভুগছে ৪.২ ভাগ। আর গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো, ২.৫২ ভাগ ক্ষেত্রে রোগী পোস্ট-ট্রামেটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে ভুগছে।