যানজট, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা, বায়ুদূষণ, মশার উৎপাত, বেহাল সড়ক, ফুটপাত দখলসহ নানা দুর্ভোগে অতিষ্ট রাজধানীবাসীর জীবন। নগরীর সড়কের বেহাল দশা কাটছেই না, এতে যানজটের ভোগান্তি আরও চরম আকার ধারণ করেছে। এর সাথে ফুটপাত দখল, রাস্তার দুই পাশে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, গলি কিংবা সড়কের উপর ময়লা-আবর্জনার স্তুপ, মশার উপদ্রব সব মিলিয়ে নগরবাসীর জীবন একেবারে দুর্বিষহ। এর বাইরে ভয়াবহ বায়ুদূষণ রাজধানীবাসীর জন্য ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’য়ের মতো অবস্থা। এ ছাড়া ঢাকার প্রাণ হিসাবে খ্যাত বুড়িগঙ্গার মরণ দশায় রাজধানী ঢাকাকে ‘পরিবেশগত সংকটাপন্ন’ এলাকা ঘোষণা করা উচিৎ-মর্মে ২২ জানুয়ারি মন্তব্য করেছেন হাইককোর্ট। বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধ সংক্রান্ত রিটে আদালত অবমাননা মামলার শুনানিকালে আদালত উপরোক্ত মন্তব্য করেন।
বছরজুড়েই রাজধানীতে চলছে ছোট বড় খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। যার ফলে শুকনো মওসুম এলে ধূলোর উৎপাত বেড়ে যায় আর বর্ষাকাল শুরু হলেই কাদামাটির ছড়াছড়ি। ধুলা আর কলকারখানার ও গাড়ীর কালো ধোঁয়া এবং ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় রাজধানীর বাতাস ভয়াবহ দূষণের কবলে। গত দুমাসের মধ্যে রাজধানী ঢাকা বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে প্রায়ই বিশ্বের বিভিন্ন শহরের মধ্যে শীর্ষস্থানে ছিল। দূষণ আর দুর্ভোগের এই নগরীতে রাজধানীবাসী অনেকটা ধুকছে বলা যায়।
প্রতিবছর বর্ষার আগেই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়। কিন্তু বর্ষা শেষ হলেও শেষ হয় না মেরামতের কাজ। বিভিন্ন সড়কের মাঝখানে ছোট ছোট খানাখন্দের জন্য রাজধানীবাসীকে কম ভোগান্তি পোহাতে হয় না। এখন রাজধানীতে চলছে যানজট নিরসনে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও বিআরটি- এই তিনটি মেগা প্রকল্পের কাজ। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কুড়িল-বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে। এ প্রকল্প শেষ হবে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে। গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প বা বিআরটি প্রকল্পটি গাজীপুর শহরের বাস ডিপো থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর পর্যন্ত প্রায় ২১ কিলোমিটার। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২০ সালের জুন মাসে। ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট (এমআরটি) লাইন-৬ প্রকল্প- যেটা জনসাধারণের কাছে মেট্রোরেল প্রকল্প নামে পরিচিত। এটা উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পের অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প এলাকা থেকে পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কাওরানবাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তোপখানা রোড (সচিবালয়) হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত দীর্ঘ হবে। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে। বিগ বাজেটের বড় তিনটি প্রকল্প শেষ করার জন্য রাজধানীর সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির মধ্য দিয়ে চলছে। এ দিকে, বর্ষাকাল দরজায় কড়া নাড়ছে। বর্ষার আগেই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শেষ না হলে রাজধানীবাসীর জন্য অন্তহীন ভোগান্তি অপেক্ষা করছে। রাজধানীর সড়কের বেহাল দশা কাটিয়ে উঠতে হলে বড় বড় প্রকল্পগুলো শিগগিরই শেষ হওয়া জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানীর সড়কের বেহাল দশা প্রসঙ্গে বুয়েটের এআরআই ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ সাইফুন নেওয়াজ বলেন, নিরাপদ সড়কে চলাচল কারা জনগণের অধিকার। এ কারণে সড়ক নিরাপদ রাখা সরকারের দায়িত্ব। যারা সড়ক নির্মাণ করেন তারা নির্মাণ কাজটিই ভালো বোঝেন, কিন্তু কোন সড়কে কোন গাড়ি চলবে এটা বিশেষজ্ঞরা ভালো জানেন। আমাদের দেশে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়ার প্রচলন একেবারেই কম। তিনি বলেন, সমন্বয়হীনতার কারণে কিছুদিন পর পর দেখা যায় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। সঠিক নির্দেশনার অভাবে দীর্ঘসূত্রতার বিষয় চলে আসে।
রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির পাশাপাশি ফুটপাত দখল নগরবাসীর জন্য আরেক দুর্ভোগের কারণ। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সর্বত্র এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অন্তত দেড়শ পয়েন্টে ফুটপাত-রাস্তা জবরদখলসহ অসংখ্য পয়েন্টে গড়ে উঠেছে অবৈধ হাটবাজার। রাস্তা-গলি মোড় দখল করে ব্যস্ততম রাজধানীতে অবৈধভাবেই গড়ে উঠেছে অন্তত ১৭টি বাস-ট্রাক টার্মিনাল। এসব ঘিরে চলছে চাঁদাবাজির মহোৎসব। দখলবাজরা প্রতি বছর লুটে নিচ্ছে শত শত কোটি টাকা। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী, পুলিশ আর স্থানীয় সিন্ডিকেট এসব বখরা ভাগ করে নিচ্ছে। প্রশাসনের নানা উদ্যোগেও ফুটপাথ-রাস্তা জবরদখলমুক্ত হয় না, দূর হয় না নগরবাসীর ভোগান্তি।
রাজধানীর অলিগলি বা রাজপথে বের হলেই বাসাবাড়ির বর্জ্যসহ হরেক রকম বর্জ্যর কোনো অভাব নেই। বর্জ্যরে কারণে প্রতিদিন নানান রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। যত্রতত্র বর্জ্য ফেলায় ভরাট হচ্ছে নদী, খাল, লেক ও জলাশয়। দুই সিটি কর্পোরেশন থেকে ঢাকায় প্রতিদিন উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৫ হাজার টন বর্জ্য, যার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ডাম্পিং করা হয়। ২০ শতাংশ স্থানীয়ভাবে বেসরকারি উদ্যোগে বিশেষ করে টোকাইদের মাধ্যমে সংগ্রহ করে রিসাইক্লিং হয়। আর বাকিটা পথে-ঘাটে থেকে যায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।
বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা মতে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৭ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে ডাম্পিং হয় ৩ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। অপর এক বেসরকারি জরিপ অনুযায়ী প্রতিদিন গৃহস্থালি বর্জ্য উৎপাদিত হয় ৫ হাজার ৯৫০ মেট্রিক টন। এছাড়া মেডিকেলসহ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে ১ হাজার ৫০ এবং রাস্তাঘাট থেকে ৪০০ মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। প্রতিদিন নগরীতে মাথাপিছু উৎপাদিত হয় ৫৬০ গ্রাম বর্জ্য। উৎপাদিত বর্জ্যরে মধ্যে আছে প্লাস্টিক, কাগজ, কাচ, ধাতু ও জৈব বর্জ্য।
সরেজমিন দেখা গেছে, যাত্রাবাড়ীর একেবারে মোড়ে, ফকিরেরপুল বাজারে মূল সড়কের পাশে, বিজয়নগর পানির ট্যাংকের নিচে, ধানমন্ডির মূল সড়কের পাশেসহ রাজধানীর ছোট বড় রাস্তার মোড়ে, মূল সড়কের পাশে কিংবা সরুপথে ময়লার বড় বড় ডিপো রয়েছে; যেখান দিয়ে অসহনীয় দুর্গন্ধ ছড়ায়। পথচারীরা কিংবা বাসের যাত্রীরা যানজটে পড়ে ওই ময়লার স্ত‚পের কাছে আটকে পড়লে নাকে রুমাল কিংবা কাপড় দিয়ে টিপে ধরে। রুমাল না থাকলে হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে নাক টিপে ধরে পথচারীরা ওই এলাকা পার হন। এ ছাড়া, অনেক রাস্তার দুই পাশে অনবরত মলমূত্র ত্যাগ করে চলাচলের অনুপযোগী করে তোলা হলেও এগুলো যেন দেখার কেউ নেই। মূল সড়ক দখল করে গাড়ি মেরামত ও ধোঁয়ার কাজ চলছে অহরহ। গাড়ি রীতিমতো ফুটপাথের উপর বসিয়ে ধোয়া ও মেরামতের কাজ করলেও পথচারীদের সমস্যা হচ্ছে কি না তা দেখার কোনো সময় নেই তাদের। মতিঝিল, আরামবাগ, নয়াপল্টন ভিআইপি রোডের একপাশ, নাইটিংগেল মোড় দিয়ে বিজয়নগর পানির ট্যাংক ও আশপাশের এলাকা, মগবাজার, মালিবাগসহ রাজধানীর বেশকিছু এলাকা ঘুরে এ রকম চিত্র চোখে পড়ে। এখন রাজধানীবাসীর প্রশ্ন একটাই, কবেশেষ হবে সড়কের এই বেহাল দশা, কবে শেষ হবে ভোগান্তি, কবে ফিরে আসবে স্বস্তি?
ময়লা-দুর্গন্ধের চেয়ে মশার উৎপাতে নাকাল নগরবাসী। গতবছর এডিস মশার উপদ্রবে ডেঙ্গুর মহামারিতে পড়েছিল রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষ। ডেঙ্গুজ্বরের আতঙ্কে কেটেছে রাজধানীবাসীর। ডেঙ্গুর আতঙ্ক এখনো কাটেনি। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কত মানুষ মারা গেছে, তারও সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা প্রায় তিন শ। সরকারের রোগতত্ত¡, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বলছে, গতবছর ১২৭টি মৃত্যু নিশ্চিতভাবে ডেঙ্গুতে হয়েছে। এই সংখ্যাও ডেঙ্গুতে মৃত্যুর নতুন রেকর্ড।
সাধারণত গতবছর মে-জুন থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়। অক্টোবরের শেষ পর্যন্তও এর ভয়াহতা ছিল। এডিস মশার প্রকোপ এখন কিছুটা কমলেও নতুন করে কিউলেক্স মশার উপদ্রব শুরু হয়েছে। অর্থাৎ মশার উপদ্রব থেকে নগরবাসী কিছুতেই রেহাই পাচ্ছেনা।
সূত্র: ইনকিলাব