বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডে আটককৃত পুলিশ সদস্যরা র্যাবের হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ওই মামলার প্রধান আসামী লিয়াকত আলী ও আরেক আসামী প্রদীপ কুমার দাস।
সম্প্রতি কক্সবাজার আদালত থেকে কারাগারে নেওয়ার পথে লিয়াকত আলী ও প্রদীপ কুমার দাশের একাধিক ভিডিও বার্তা ধারণ করা হয়। ওই ভিডিও বার্তাগুলোতে তারা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে নালিশের সুরে এসব অভিযোগ করে। নেত্র নিউজ নামক একটি সংবাদমাধ্যম এ ভিডিওগুলো প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। ভিডিও ক্লিপগুলোর কপি পুলিশেরই একজন কর্মকর্তা নেত্র নিউজকে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন নেত্র নিউজ কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও আলাদাভাবে চারজন পুলিশ কর্মকর্তা এই ক্লিপগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করেছে বলে নেত্র নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়। অজ্ঞাত পরিচয়ের ঐ পুলিশ সদস্যদের সূত্রে নেত্র নিউজ আরও জানিয়েছে যে, র্যাবের হেফাজতে লিয়াকত, প্রদীপ ও নন্দদুলালের নির্যাতন সম্পর্কে পুলিশের আইজিপি বেনজির আহমেদসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবগত আছে।
নেত্র নিউজ প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায় নিজেদের উপর নির্যাতনের কথা সরকারের উর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার কাছে ফোনে বর্ণনা করছে সিনহা হত্যা মামলার আসামী লিয়াকত আলী ও প্রদীপ কুমার দাস। তাদের অভিযোগ, র্যাব তাদেরকে বেধড়ক পিটিয়েছে, সারারাত উলঙ্গ অবস্থায় রেখেছে, স্পর্শকাতর জায়গায় ইলেকট্রিক শক দিয়েছে, বুকের পশম উঠিয়ে ফেলেছে, ইঞ্জেকশন দিয়েছে, হাত বেধে ঝুলিয়ে রেখেছে ইত্যাদি।
তবে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলে ৱ্যাবের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ নেত্র নিউজকে বলে, “ৱ্যাবের মুখপাত্র হিসেবেই কেবল নয়, দীর্ঘদিন ক্রাইমে কাজ করার অভিজ্ঞতায় আমি বলবো, এই ধরনের কোনো আচরণ [নির্যাতন] তাদের সঙ্গে করা হয়নি। [যা] করা হয়েছে সেটি সম্পূর্ণভাবে, সমস্ত প্রকার বিধি-নিষেধ মেনেই করা হয়েছে।” ৱ্যাবের মুখপাত্র বলেন যে, তিনি বিষয়টি আরও যাচাই-বাছাই করে উত্তর দিতে চান।
অন্যদিকে পুলিশের একজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে নেত্র নিউজ জানিয়েছে, সিনহা হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততা নেই, টেকনাফ থানার এমন আরও পাঁচ পুলিশ সদস্যকেও “হন্য হয়ে খুঁজছে” র্যাব। এছাড়াও কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন এই হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত, এমন স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্যও র্যাব “জোর প্রচেষ্টা চালায়” বলে দাবি করেছে আসামী প্রদীপ।
আজ র্যাবের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগ করলেও, একসময় এই প্রদীপও নিরপরাধ মানুষকে নির্যাতন করে জোরপূর্বক মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করতো। দায়িত্বে থাকাকালে টেকনাফে মাদক কারবারি সন্দেহে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন করেছে বলে প্রদীপ নিজেই স্বীকার করেছিল। গত ২ বছরে প্রদীপ কুমার দাসের নেতৃত্বাধীন পুলিশ বাহিনীর হাতে এরকম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ১৫০জন। সর্বশেষ মেজর সিনহাকে হত্যা করা হলে টনক নড়ে দেশবাসীর, প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর। আর দেশবাসী বা প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলো হত্যাকারীর বিরুদ্ধে আন্দোলনে না নামলে, বাংলাদেশ সরকার হত্যাকারীর বিচারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। তাই ১৫০ খুন করার পরও প্রদীপ কুমারের মতো সন্ত্রাসীরা বহাল তবিয়তে দায়িত্বে ছিল, কিন্তু পরে ১টি খুন করেই জনতা বা প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের আন্দোলনের মুখে বিচারের মুখোমুখি হতে হলো প্রদীপ ও তার সহচরদেরকে।
আর বন্দী অবস্থায় তাদেরকে র্যাব নির্মম নির্যাতন করেছে বলে অভিযোগ তাদের। বন্দীর উপর নির্যাতন সঠিক নয়। তবে, এতদিন এরাই নিরীহ মানুষ বিশেষ করে মুজাহিদিনের উপর এ ধরনের বরং তার চেয়েও ভয়ংকর নির্যাতন চালাতো। অধিকাংশ ঘটনার সাথে পুলিশ আর র্যাব সদস্যরা জড়িত থাকলেও যৌথবাহিনী, সেনাবাহিনী, বিজিবি, গোয়েন্দা পুলিশ, কোস্টগার্ড, আনসারসহ হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন ও বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশে প্রায় সবগুলো বাহিনীর বিরুদ্ধেই। আর এক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতা দেখিয়ে “ডেথ স্কোয়াড” বা “জল্লাদ বাহিনী” হিসেবে কুখ্যাতি পেয়েছে র্যাব। পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীও জনতার কাছে বিভিন্ন কুখ্যাত নামে পরিচিত।