সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দুত্ববাদীরা ভারতকে মুসলিমদের জন্য এক মৃত্যুপুরিতে পরিণত করেছে। ঘরে-বাইরে, মাসজিদে-চাকুরিতে সবখানে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে মুসলিমরা। মুসলিম-নিধনে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের চেতনার ন্যারেটিভ হলো জয়-শ্রীরাম ধ্বনি। এ এমন এক ধ্বনি, যার ব্যবহারে মুসলিম মারায় পাওয়া যায় রাষ্ট্রীয় ও আইনি ‘বৈধতা’।
ভারতের অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, ‘সারা দেশে এখন মানুষ মারতেই ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি ব্যবহার করা হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি আগে এতো হিংস্র আওয়াজে কাউকে ‘জয় শ্রী রাম’ বলতে শুনিনি। এখন মানুষকে লাশ বানাতে এই স্লোগান ব্যবহার করা হচ্ছে।’
জাতিসংঘের হিসেব বলছে, প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী যতো ‘অনার কিলিং’ হয়, তার প্রতি পাঁচটির একটিই ঘটে ভারতে। এখন তো সরাসরি রাস্তাঘাটেই মুসলিমদের ওপর হামলা চালাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী উগ্র ভারতীয়রা। আর এক্ষেত্রে হাতিয়ার বানানো হচ্ছে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানকে।
বিবিসির ভারতীয় সাংবাদিক গীতা পাণ্ডে বলেন, ‘আগে রামধ্বনি তুলে অভিবাদন জানানো হতো। আর এখন উগ্র হিন্দুরা এই ধ্বনি ব্যবহার করছে মানুষ খুনে। সম্প্রতি বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিমবিদ্বেষ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।’
জয় শ্রীরাম যেভাবে মুসলিম নিধনের হাতিয়ার হয়ে উঠলো:
১৯৮০ সালে ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মাসজিদ ভেঙে রামমন্দির প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে সর্বপ্রথম জয় শ্রীরাম স্লোগানকে একটি চেতনা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিজেপির তৎকালীন সভাপতি এল কে আদভানির নেতৃত্বে এই চেতনার বিনির্মাণ ঘটে।
১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে ঠিক এই স্লোগান জপতে জপতেই ষোড়শ শতকে সম্রাট বাবর নির্মিত বাবরি মাসজিদে প্রথম আঘাতটি আনা হয়। বাকিটা সবারই জানা। বলি হতে হয়েছে মুসলিম ইতিহাসের এই পবিত্রতম স্থাপনা।
এভাবেই উগ্র বিজেপির নেতৃত্বে জয় শ্রীরাম স্লোগানের রাজনীতিকরণ করা হয়। এখন জয় শ্রীরাম শুধুমাত্র একটি স্লোগান নয়। একটি চেতনা। একটি আদর্শ। প্রতিনিয়ত যেই আদর্শের বলি হতে হচ্ছে মাযলুম মুসলিমদের। এই জয় শ্রীরাম স্লোগান তুলেই ওরা মুসলিমের রক্ত ঝরায়, এই চেতনা থেকেই ওরা আমার বোনের পবিত্র দেহে হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, রাস্তাঘাটে মুসলিমকে ধরে এই স্লোগান জপতে বলে; অস্বীকৃতি জানালেই গণটিুনি দিয়ে করা হয় খুন।
নিকট অতিতের কিছু ঘটনা:
১. উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসামের বারপেটা জেলার ঘটনা। একদল মুসলিম যুবক রাস্তাধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন। পথরোধ করে দাঁড়ায় স্থানীয় হিন্দুরা। পোশাক-আশাক দেখে ওরা অনুমান করেছে এরা মুসলিম। তারপর যথারীতি ‘জয় শ্রীরাম’, ‘ভারত মাতা কি জয় এবং ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’ বলে সমস্বরে স্লোগান দিতে বলা হয়। অন্যথায় গণপিটুনি দেওয়া হবে, দেখানো হয় এই ভয়। শেষে বাধ্য হয়ে এসব অপবিত্র স্লোগান দিয়ে প্রাণেবাঁচেন ওই যুবকদল।
২.মুম্বাইয়ের ঘটনাও অনেকটা একইরকম। উগ্র হিন্দুরা ফায়জুল উসমান নামে ২৫ বছরের এক মুসলিম ড্রাইরকে ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বলে। বলতে না চাইলে একপর্যায়ে বেধড়ক মারধর করা হয় তাকে। পরে ফায়জুলের এক যাত্রী পুলিশ খবর দিলে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়।
৩. কলকাতার পূর্বাঞ্চলীয় শহরের আরেকটি ঘটনা। ট্রেনে করে যাচ্ছিলেন এক মাদ্রাসা শিক্ষক। দাড়ি-টুপি-পাঞ্জাবি দেখে হিন্দুত্ববাদীরা তাকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে থাকে। জয়শ্রীরাম বলতে অস্বীকৃতি জানানোয় একপর্যায়ে চলন্ত ট্রেন থেকে থাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয় ওই আলেমকে। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে কাটান দীর্ঘদিন।
৪.ভারতের ঝাড়খন্ডে চুরির অপবাদে এক মুসলিম যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২৪ বছরের ওই যুবকের নাম তাবেজ আনসারি। অবশ্য চুরির অপবাদে মুসলিম-খুন হিন্দুদের একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। জয় শ্রীরাম বলতে অস্বীকার করলেই ‘চোর চোর’ ধ্বনি তুলে শুরু হয় পাশবিকতা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলতে থাকে নির্যাতন।
৫. উত্তর প্রদেশের ঘটনা। আফতাব আলম নামে ৪৫ বছরের এক মধ্যবয়স্ক মুসলিম। পেশায় ট্যাক্সিচালক। যাত্রী নামিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন রাতে। পথিমধ্যে গাড়ি থামায় উগ্র হিন্দুরা। বুঝতে পারে, লোকটি একজন মুসলিম। হিংস্রতা জেগে উঠে ওদের চেতনায়। যথারীতি সেই গ্র্যান্ড-ন্যারেটিভের ব্যবহার। বল, জয় শ্রীরাম। অবস্থা বুঝতে পেরে আফতাব আলম ছেলেকে কল দিয়ে মোবাইল পাশে রেখে দেন।
ছেলে জানায়, ওপাশে চিল্লাপাল্লার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। বাবাকে কেউ বলছে, জয় শ্রীরাম না বললে তোকে খুন করে ফেলবো। একপর্যায়ে ওরা ভারি কিছু দিয়ে বাবার মাথায় আঘাত করে। এরপর কলটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
আমি তৎক্ষণাৎ পুলিশ স্টেশনে ফোন দিই। কিন্তু পুলিশ এ ব্যাপরে নির্বিকার ছিল। কোনো পদক্ষেপেই নেয়নি তারা আমার বাবাকে বাঁচাতে।
পরদিন সকালে রাস্তার ধারে নিহত আফতাব আলমের লাশ পাওয়া যায়।
৬. গফুর আহমেদ নামে এক অটো চালকের গাড়ি থামিয়ে নরেন্দ্র মোদি জিন্দাবাদ এবং জয় শ্রী রাম বলতে বলা হয়। এমনটা বলতে রাজি হন না তিনি। হিন্দুরা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তার দাড়ি টেনে ছিঁড়ে ফেলে। আঘাতের পর আঘাতে নাক-মুখ ফেটে রক্ত বেরুতে থাকে। এভাবেই একপর্যায়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। উগ্র হিন্দুরা নিহতের মানিব্যাগ ও ঘড়িটি পর্যন্ত ছিনতাই করে।
২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত এমন ঘটনা ঘটেছে কয়েকশত। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছে কয়েকডজন নিরপরাধ মুসলিম। আহতের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়; শতাধিক। এসবের কোনোটিরই বিচার হয়নি আদালতে। খুনিরা দিনেদুপুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে বুক উঁচু করে। আর বিজেপি নেতারা বলছে, এসব ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’।
উগ্র হিন্দুরা যখন জয় শ্রীরাম ধ্বনি তুলে একের পর এক মুসলিমকে খুন করছে, তখন মুসলিমরা তাকবির ধ্বনি তুলে এই নির্যাতন প্রতিরোধ করবে- এই হিম্মতটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। অথচ কোরআন স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিচ্ছে,
أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللَّهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ
‘যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদেরকে যাদের উপরে অত্যাচার করা হয়েছে; কেননা তারা জুলুমের শিকার। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম’। [আল-কোরআন ২২:৩৯]
কোরআনের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে যতক্ষণ না প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে, জয় শ্রীরাম স্লোগানের বিপরীতে যতক্ষণ তাকবির ধ্বনি তুলে অত্যাচারের মোক্ষম জবাব দেওয়া না হবে, যতক্ষণ না মুসলিমরা তাওহিদি স্লোগানের মর্ম বুঝবে, ততক্ষণ একের পর এক মুসলিমের লাশ ঝরতেই থাকবে, নারীরা সম্ভ্রমহারা হতেই থাকবে।
—
উসামা মাহমুদ, প্রতিবেদক আল-ফিরদাউস নিউজ