ফিলিস্তিনে অবৈধভাবে ইহুদি বসতি স্থাপনে সহায়তা করছেন রাশিয়ান অভিজাতদের অন্যতম ইংলিশ ফুটবল ক্লাব চেলসির মালিক রোমান আব্রামোভিচ। বিবিসি এরাবিকের অনুসন্ধানে এই তথ্য বেরিয়ে আসে।
গতো ২২ সেপ্টেম্বর তারা এই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, রাশিয়ান অভিজাত ব্যক্তিত্ব এবং চেলসি ফুটবল ক্লাবের মালিক রোমান আব্রামোভিচের নিয়ন্ত্রণাধীন কয়েকটি কোম্পানি।ফিলিস্তিনে অবৈধভাবে বসতি স্থাপনের জন্য ‘ইলাদ’ নামক একটি বসতি নির্মাণকারী সংস্থাকে ১০০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।
উদ্বেগের বিষয় হল, ওই কোম্পানিটি পূর্ব জেরুসালেমে অবৈধভাবে ইহুদি বসতি নির্মাণকারী একটি সংস্থা। যারা আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সেখানে অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ করে যাচ্ছে। ইলাদ সেই সংস্থা যারা ফিলিস্তিনের পূর্ব জেরুসালেমের পার্শ্ববর্তী সিলওয়ান শহরকে হিব্রুতে ‘আইর ডেভিড’ বা দাউদের শহর বলে ডাকে!
ইলাদ সংস্থাটি সিলওয়ান শহরের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলোও পরিচালনা করে থাকে। অতি প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও স্থাপনায় ভরপুর এই শহটি পর্যটকদেরও প্রচুর পরিমাণে আকর্ষণ করে থাকে। বছরে প্রায় এক মিলিয়নেরও বেশি পর্যটক এই শহরটিতে বেড়াতে আসেন।
ইলাদের সাবেক মার্কেটিং ডিরেক্টর শাহার শিলো বিবিসি এ্যারাবিকে সাক্ষাৎকার প্রদানকালে বলেন, ইলাদের লক্ষ্য হল সিলওয়ানের আকর্ষণীয় পর্যটন খাত ব্যবহার করে সিলওয়ান শহরে একটি ভিন্নমাত্রার ইহুদি রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করা।
ইলাদ তাদের কাজের জন্য তহবিলের উপর নির্ভরশীল। ২০০৫-২০১৮ সালের মধ্যে তাদের প্রাপ্ত তহবিলের প্রায় অর্ধেকই এসেছে ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া দ্বীপপুঞ্জের ৪টি কোম্পানি থেকে। ওই কোম্পানিগুলোর আড়ালে থাকা ব্যক্তিদের ব্যাপারে এখনো কিছুই জানা যায়নি।
ফিন্সেন ফাইলস নামে নথিগুলো মূলত বাজফিড নিউজের কাছে ফাঁস করা হয়েছিল যা পরবর্তীতে তারা তদন্তকারী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিবিসির সাথে শেয়ার করে নেয়। নথিগুলোতে রোমান আব্রামোভিচের নামটিও সামনে আসে। সেখানে তাকে ইলাদকে আর্থিক সহায়তাকারী চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিনটির সবচেয়ে বেশি লভ্যাংশের মালিক রূপে এবং চতুর্থ কোম্পানিরটির নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
ইলাদের একাউন্টের তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, ইলাদকে ওই কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যেই বর্তমান ডলার রেট অনুযায়ী ১০০ মিলিয়নেরও বেশি আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে। অর্থাত, বিগত ১৫ বছরে ইলাদের সবেচেয়ে বড় ডোনার হল চেলসি ফুটবল ক্লাবের মালিক একাই!
ইহুদিবাদী সন্ত্রাসীদের অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলের দখলে থাকা অঞ্চলটিতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যগুলো অনেক বিতর্কিত আইন দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। তাছাড়া, অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল ইলাদকে সিলওয়ানে অনুসন্ধানমূলক কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে আরো বেশি পরিমাণে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করার ঔদ্ধত্য প্রকাশ করার সম্ভাবনাও প্রবল। কেননা তারা ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইলাদকে ফিলিস্তিনে অবৈধ বসতি ও স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। এমনকি তারা অবৈধভাবে বসতিও নির্মাণ করে যাচ্ছে।
আব্রামোভিচের মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, মি.আব্রামোভিচ হলেন ইসরায়েল এবং ইহুদি সম্প্রদায়ের নিকট অঙ্গীকারবদ্ধ তাদের একনিষ্ঠ সমর্থক। ইসরায়েলে এবং বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিদের স্বাস্থ্যসেবা, বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষায় সহযোগিতার জন্য বিগত ২০ বছরে তিনি ৫০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছেন।
আব্রামোভিচের এই তহবিল ব্যাতীত ইলাদ এতো দ্রুত সাফল্যের সাথে ফিলিস্তিনে অবৈধভাবে ইহুদিদের শক্তিশালী অবস্থান তৈরিতে কোনোভাবেই সক্ষম হতো না।
ইলাদের অবৈধ বসতির কিছু অংশ ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে জোরপূর্বক কিনে নেওয়া হলেও বেশিরভাগ বাড়ির মালিকানা কিন্তু ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করে অন্য ইহুদিদের মাধ্যমে জবরদখলকৃত। আর এই অবৈধ মালিকানা যাকে তারা বৈধ বলে দাবী করে থাকে, এটি তথাকথিত ‘অনুপস্থিত সম্পত্তি আইন’ নামে উদ্ভট এক ইসরায়েলের আইনের মাধ্যমে!
ইসরায়েলের ভাষ্যমতে, ওই আইনটিই তাদেরকে ওই সমস্ত ফিলিস্তিনিদের সম্পত্তি নিজের করে নেওয়ার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে,যেসব সম্পত্তির মালিকেরা সংঘাতের সময় বাড়িঘর ছেড়ে চলে গিয়েছে বা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
এমনই পরিস্থিতির শিকার হয়েছে সুমারিন বংশের বাড়ি যা ইলাদের ভিজিটর সেন্টারের একেবারে পাশেই অবস্থিত। বর্তমানে সেখানে একই পরিবারের ১৯ জন সদস্য বসবাস করছে যাদের মধ্যে কনিষ্ঠতমের বয়স ২ মাসেরও কম।
আমাল সুমারিন যিনি বর্তমান সুমারিন প্রজন্মের মা তিনি তার সন্তানদের বলেছিলেন, যখন আমার বিয়ে হয় তখন আমি এখানে চলে আসি। আমার স্বামী তার চাচা হাজ্বী মুসা সুমারিনের সাথে এখানেই বসবাস করতো। যখন মুসা সুমারিনের স্ত্রী ইন্তেকাল করে তখন আমার মনে আছে যে, আমি চাচা মুসা সুমারিনের দেখভাল করতাম। আর আমার স্বামী তাকে গোসল ইত্যাদি ও ডাক্তারের কাছে আনা-নেওয়ায় সহযোগিতা করতো।
আমাল সুমারিন বলেন, চাচা মুসা সুমারিন আমাদেরকে বলতেন, হে আমার প্রিয় মেয়ে! এই ঘর তোমার এবং তোমার স্বামীর। ১৯৮৩ সালে যখন চাচা মুসা সুমারিনও ইন্তেকাল করেন তখন ১৯৮৭ সালে ইসরায়েলের তথাকথিত ‘অনুপস্থিত সম্পত্তি আইনের’ আওতায় তার বাড়িটিকে ইহুদি সন্ত্রাসীদের অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলের সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ওই বাড়িটি জিউশ ন্যাশনাল ফান্ড জেএনফের সহকারী সংস্থা হেমনুতাহর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
জেএনএফের অন্যতম লক্ষ্য উদ্দেশ্য হল ইহুদি জনগণের পক্ষে জমি ক্রয় এবং এর ব্যপক বিস্তৃতি। ১৯৯১ সালে হেমনুতাহ অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলের আদালতকে সুমারিনদেরকে তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে মামলা দায়ের করে। মূলত তখন থেকেই ফিলিস্তিনি সুমারিন পরিবারটি এনজিও এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সহায়তা ও অর্থায়নে আইনী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
বিগত ১০ বছর যাবত সুমারিনদের পক্ষে আইনী লড়াই চালিয়ে যাওয়া আইনজীবী মুহাম্মাদ দাহেলী বিবিসি এ্যারাবিকে বলেন, ফিলিস্তিনি সম্পত্তিকে যখন ইহুদীদের অথবা ইসরায়েলের সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে দেওয়া হয়, তখন সেই সম্পত্তি ফিলিস্তিনিদের কাছে ফিরে আসার সম্ভাবনা একেবারে শূন্য।
কিন্তু.. হ্যাঁ, জেরুসালেমে অবস্থিত ইসরায়েলের জেলা কোর্ট গত আগস্টে সুমারিনদের আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। তারা এখন ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছে, যার শুনানি হবে আগামী বছরের এপ্রিলে। তাছাড়া বিবিসির অনুসন্ধানী দল ১৯৯১ সালে হেমনুতাহ সংস্থাকে পাঠানো ইলাদের একটি চিঠি পায় যেখানে ফিলিস্তিনে সংঘটিত অবৈধ কর্মকাণ্ডের সাথে ইলাদের জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে।
চিঠিতে,সুমারিন পরিবার সহ পুরো সিলওয়ান শহরের অন্যান্য পরিবারগুলোকেও তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে মামলা সংশ্লিষ্ট যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করার বিষয়টি হেমনুতাহ সংস্থাকে নিশ্চিত করেছে অবৈধ বসতি নির্মাণকারী সংস্থা ইলাদ।
উচ্ছেদ সম্পর্কিত মামলার বিষয়ে প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়নি জেএনএফের সহকারী সংস্থা হেমনুতাহ। অপরদিকে অবৈধ বসতি নির্মাণকারী সংস্থা ইলাদও মামলার জন্য তাদের আর্থিক তহবিল এখনো বহাল রেখেছে কি না তা নিশ্চিত করেনি।
ইলাদের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ডোরোন স্পিলম্যান বিবিসির কাছে তথাকথিত ‘অনুপস্থিত সম্পত্তি আইনের’ দোহায় দিয়ে দাবি করেন যে, তাদের সমস্ত সম্পত্তি ন্যায্য এবং আইনী প্রক্রিয়ায় অর্জিত। তার দাবি, কোনও ফিলিস্তিনিকে আদালত এবং আইনী প্রক্রিয়া ব্যতিরেকে সিলওয়ান, আইর দাউদ বা দাউদের শহরে তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়নি।
সুমারিন পরিবারের আইনজীবী মুহাম্মাদ দাহেলীকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বিবিসিকে জানান, নিজেদের স্বার্থরক্ষায় দখলদার ইসরায়েল উদ্ভট আইনের আওতায় এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে স্থানীয় ফিলিস্তিনি জাতিগোষ্ঠীকে।
উল্লেখ্য, সারাবিশ্ব থেকে আসা বাড়ন্ত তহবিলের পাশাপাশি ইলাদের প্রভাবও আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। কেননা আমেরিকার সরকারের উপর তাদের প্রভাব এখন একেবারেই প্রকাশ্য। ফিলিস্তিনের ভূমিতে অবৈধ ইহুদী অবৈধ বসতি স্থাপনের কট্টর সমর্থক ইসরায়েলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড ফ্রেডম্যান।
জেরুসালেমকে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা দেওয়ার পিছনে প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলেন এই ডেভিড ফ্রেডম্যান। এমনকি তিনি দখলকৃত ফিলিস্তিনে ইলাদের অবৈধ স্থাপনা রক্ষায় ২০২০ এ তথাকথিত শান্তি প্রক্রিয়ার আওতায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দিয়ে এই ইহুদী প্রতিষ্ঠানটির নির্মিত এলাকাগুলোকে ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আর এভাবেই সারা পৃথিবী থেকে আসা অর্থ, মুসলিমবিরোধী শক্তিগুলোর সমর্থন এবং মুসলিম নামধারী মোনাফেকদের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য স্বীকৃতির ফলেই ফিলিস্তিনকে দখল করে নিচ্ছে ঘৃণ্য ইহুদিবাদী সন্ত্রাসীদের অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল। আর দিনদিন মলিন হয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন।