‘ক্লোজআপ-কাছে আসার গল্প‘ ইউনিলিভার কোম্পানির প্রযোজিত একটি টেলিভিশন নাটক সিরিজ। এর বিষয়বস্তু হচ্ছে বৈবাহিক পদ্ধতি ব্যতীত হারাম ভাবে যিনায় লিপ্ত হওয়ার অশ্লীল কাহিনী। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে এনটিভিতে এটি প্রথম প্রচারিত হয়। পরবর্তীতে এ সিরিজটি প্রতিবছর শুধুমাত্র কথিত নোংরা ভালোবাসা দিবসে প্রচারিত হয়। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকেই এটি আরম্ভ হয়।
যুবক-যুবতীদেরকে এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উৎসাহ দেয়া হয় যে, তোমরা তোমাদের অবৈধ ও হারাম সম্পর্ক এবং এই সম্পর্কের মাধ্যমে কৃত অসামাজিক কর্মকাণ্ডের গল্পগুলো বলো। তারা এসব গল্প থেকে বাছাইকৃত নোংরা চিত্তাকর্ষক গল্পগুলো নিয়ে নাটক নির্মাণ করে। টেলিভিশনে প্রচার করে। যুবকদেরকে তাদের কৃত অবৈধ ও হারাম কাজ প্রকাশ করার জন্য উৎসাহিত করা হয়। এবং এর মাধ্যমে এই জাতীয় কাজগুলো করার জন্য অন্যদেরকে উস্কানি দেয়া হয়। এসব অবৈধ হারাম সমাজ-বিধ্বংসী কাজকে সমাজে জনপ্রিয় করা ও বৈধতা দেওয়ার মিশন বাস্তবায়ন করাই এই চক্রের মূল উদ্দেশ্য।
ক্লোজআপ কাছে আসার গল্পের নামে মুসলিম সমাজে অশ্লীলতা বেহায়াপনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারা ব্যবসার নামে এসে মুসলিম তরুণ-তরুণীদের চরিত্র ধ্বংস করছে। ব্রিটিশ কোম্পানি ইউনিলিভার তারা নিছক ব্যবসার জন্য আসেনি বরং তাদের পশ্চিমা অসভ্যতা, নোংরামি এ দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর এটাই তাদের প্রধান টার্গেট।
এটি আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির জন্য মোটেই লাভজনক নয়, বরং ক্ষতিকর। আদতে এটি জুবসমাজকে এমন এক অন্ধগলিতে ছেড়ে দিতে চাচ্ছে, যে অন্ধ গলির শেষ প্রান্তে রয়েছে ধর্ষণ, হত্যা, ভ্রুণহত্যা, আত্মহত্যা ও নানা রকম অনাচার। এসব অনাচার বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে এই ইসলামবিদ্বেষী চক্র।
কথিত “দ্বিধাহীন কাছে আসার সাহসী গল্প” থেকেই সমাজে নৈতিক পতন ঘটে, খুলে যায় অনেক ধর্ষণ ও হত্যার মত ঘটনার দরজা। গত বছর নিহত অনুশকার ঘটনা এর বড় প্রমাণ; হারাম সম্পর্ক যাকে অনন্তের যাত্রী বানিয়ে ছেড়েছে। এটি স্রেফ উদাহরণ মাত্র। জানা-অজানা এরকম উদাহরণের সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না।
কাছে আসার সাহসী গল্পে কখনো এমনটা দেখা যাবে না যে, মা-বাবার অবাধ্য সন্তান মা-বাবার নিকট ফিরে এসে বাধ্যগত হয়েছে, বড়ভাইয়ের সঙ্গে বৈরিতা পোষণকারী ছোটভাই নিজের ভুল বুঝতে পেরে একাত্ম হয়েছে; তদ্রুপ অন্যান্য আত্মীয়ের সঙ্গে ছিন্ন হওয়া সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেছে।
এরা কাছে আসার কোন গল্পগুলো শোনায়? তারা কাছে আসার যে গল্পগুলো শোনায়, তা মূলত জাহান্নামের কাছে আসার গল্প। সেই কাছে আসা মানে মা-বাবা থেকে দূরে সরা, ভাই-বোন থেকে দূরে সরা, সমাজ থেকে দূরে সরা, জান্নাত থেকে দূরে সরা; কিন্তু অবৈধ হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে পরনারীর নিকতবরতি হওয়া, যিনার নিকটবর্তী হওয়া, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার নিকটবর্তী হওয়া। আর এভাবে তারা শোনায় ও শেখায় জাহান্নামের নিকটবর্তী হওয়ার গল্প।
দ্বিধাহীন কাছে আসার সাহসী গল্পের এই নিকৃষ্ট ফেরিওয়ালারা আপনাকে কখনই এই হারাম সম্পর্কের শেষ পরিণতি দেখাবেনা। এর বলি হয়ে কত তরুণ-তরুণী, পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে- সেটা তুলে ধরবে না। তাদের দায়িত্ব কেবল মুসলিম তরুণ-তরুণীদের বিপথগামী করা। ধ্বংসের অতল গহ্বরে পৌঁছে দেওয়া।
মাত্র কয়েকদিন আগে আপনারা অনুশকা ও দিহানের ঘটনা শুনেছেন। একই ধরনের ঘটনা গাজীপুরের রিসোর্টেও ঘটেছে। ঢাকার কোনো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটেছে।
তাদের কাছে আসার গল্পে উৎসাহিত হয়ে অনেক তরুণ-তরুণী গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। যার মাশুল দিতে হচ্ছে অনেক মাসুম শিশুকে। জন্মের পরই ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করা হচ্ছে হারাম সম্পর্কের ফলে জন্ম নেওয়া এসব নবজাতককে। হাসপাতালের আস্তাকুড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে তাদের। নিহত মাসুম শিশুকে কুকুররা নিয়ে টানা হেচরা করছে। কাক ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে। এইসবই এ কাছে আসার গল্পের উদ্যোক্তাদের অপকর্মের ফলাফল।
মোদ্দাকথা, এসব কাছে আসার অশ্লীল গল্পের পরের গল্পটা কখনো সুখকর হয় না। এজন্য তারা পরের গল্পটা কখনো শোনায় না। যারা আমাদের যুবকদেরকে অধঃপতিত করতে চায়, বিপথগামী করতে চায়— তাদের বিরোদ্ধে আমাদেরকে সচেতন থাকতে হবে।
কেননা বিয়ের আগে যারা তথাকথিত প্রেম-ভালোবাসায় লিপ্ত হয়, বিবাহ-পরবর্তী পবিত্র জীবনের আসল আনন্দের স্বাদ থেকে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বঞ্চিত করেন। এজন্য সবাইকে বিবাহ-বহির্ভূত অবৈধ প্রেম-ভালোবাসার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। স্রোতের বিপরীতে চলা শিখতে হবে।
আমরা মুসলিম যুবক-যুবতীদের যে কাছে আসার গল্প শোনাব, তা আল্লাহর কাছে আসার। আমি আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য মাদক ছেড়ে দিয়েছি, সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে দিয়েছি, হারাম সম্পর্ক ছিন্ন করেছি— আমরা এই জাতীয় গল্পগুলো শুনব ও শোনাব। আমরাও যুবকদেরকে বলব, তোমরাও কাছে আসার গল্প শোনাও— আল্লাহর কাছে আসার। শয়তানের দোসরদেরকে জানিয়ে দিতে হবে যে- আমরা শয়তানের কাছে আসার নয়, রহমানের কাছে আসার গল্প শোনাব। যে যুবক ধূমপান করতেন, তিনি ধূমপান ছেড়ে দেয়ার গল্প শোনাবেন; যিনি হারাম সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তিনি তা ছিন্ন করার গল্প শোনাবেন।
মুসলিম যুবকদের যে চেতনা থাকার কথা, তা ছিল আবদুল্লাহ বিন উমর রা.-এর মধ্যে, আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রা.-এর মধ্যে, বিলাল রা.-এর মধ্যে, সুহায়ল রা.-এর মধ্যে, আম্মারের মধ্যে এবং অন্যান্য যুবক সাহাবীদের মধ্যে। সেই চেতনা যেন মুসলিম যুবকদের মধ্যে না থাকতে পারে, তাদের চেতনা যেন ভোঁতা হয়ে যায়, লুপ্ত হয়ে যায়— সেজন্য নাস্তিক্যবাদী অপশক্তি তাদেরকে প্রেম-ভালোবাসায় আচ্ছন্ন রাখার জন্য নাটক-সিনেমা ও গল্প-উপন্যাসের মাধ্যমে প্ররোচিত করে।
অশ্লীলতার ঐ ফেরিওয়ালারা খুব ভালো করেই জানে, মুসলিম যুবকরা যদি তাদের সত্যিকারের বীরেদের বীরত্ব ও পবিত্রতার গল্প শুনে ও যেনে তাদেরকে অউকরন ও অনুসরণ করে, তাহলে তাদের অন্যায়-অবিচার-অশ্লীলতায় ভরা সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে।
“কাছে আসার সাহসী গল্প” আমাদের যুবসমাজকে নির্লজ্জ হতে প্ররোচিত করছে। একসময় মানুষ অসামাজিক কাজ করতে চাইলে একটু হলেও ভাবত, হারাম সম্পর্ক করার আগে একটু হলেও চিন্তা করত। কাছে আসার সাহসী গল্প যুবসমাজকে নির্লজ্জ ও বেহায়া করে তুলেছে। এখন যুবকদের একটা অংশ বুক ফুলিয়ে নিজের নির্লজ্জতার গল্প প্রচার করে বেড়ায়। কীভাবে মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, অসামাজিক কাজ করে কীভাবে সমাজচ্যুত হয়েছে—এক শ্রেণীর যুবক তা অবলীলায় বলে বেড়ায়। এজন্য কাছে আসার সাহসী গল্পের উদ্যোক্তারাই দায়ী। অপরাধ করার পর যদি মানুষের মধ্যে অপরাধবোধ না থাকে, তাহলে মানুষ অপরাধ থেকে সরে আসতে পারে না। অপরাধ করার পর অপরাধবোধে তাড়িত হওয়া মুমিনের আলামত, অপরাধবোধ লিপ্ত হয়ে যাওয়া ঈমানহারা হয়ে যাওয়ার লক্ষণ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যদি তোমাকে তোমার কৃত পুণ্যকর্ম আনন্দ দেয় এবং পাপকর্ম পীড়া দেয়, তাহলে তুমি মুমিন।’
দুঃখজনকভাবে আমাদের সমাজ থেকে ধীরে ধীরে অপরাধবোধ লুপ্ত হওয়ার পথে। কৌশলে অপরাধীর মন থেকে অপরাধবোধ সমূলে উৎপাটন করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে।
যারা এদেশের যুবসমাজকে ধ্বংস করতে চায়, পরিবার-ব্যবস্থা বিনষ্ট করতে চায়, পরকীয়ার প্রসার চায়, সন্তানদেরকে মা-বাবার অবাধ্য বানাতে চায়, যুবকদের সমাজ-বিরোধী হওয়ার উস্কানি দেয়, অশ্লীলতা ছড়িয়ে দিতে চায়, ধর্ষণ ও হত্যা সহজ করতে চায়— তাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে; তাদের অপচেষ্টা রুখে দিতে হবে। যারা এদেশে ব্যবসা করার পাশাপাশি এদেশে অশ্লীলতার বিস্তার করে, যুবসমাজকে সমাজত্যাগের উস্কানি দেয়, পরকীয়ায় উদ্বুদ্ধ করে — তাদের পণ্য বর্জন করা, তাদের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে মানুষের মঝে সচেতনতা তৈরি করা এবং সর্বোপরি তদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানো আমাদের ঈমানী ও নৈতিক দায়িত্ব।
লেখক : উসামা মাহমুদ