গুরুগ্রাম। ভারতের ব্যয়বহুল একটি শহর। দীর্ঘ স্বপ্ন এবং চটুল প্রতিশ্রুতি এই শহরের বৈশিষ্ট্য। দিল্লির উপকণ্ঠে শহরটির অবস্থান। বড়ো বড়ো দালানকোঠা, টেক জায়ান্টদের অফিস এবং অগণিত মদের বার ও ক্লাব শহরটিকে জাঁকজমকভাবে তুলে ধরছে। এসব অন্ধকারাচ্ছন্ন আলো শহরটিকে যেন এমন বানিয়েছে, যেখানে ব্যক্তির ধর্মের কোনো গুরুত্ব নেই।
গত তিন বছর ধরে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা খোলা ময়দানে জুমুআর সালাত আদায়ের বিরোধিতা করছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে হিন্দুদের এই উগ্রতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এক শুক্রবারে গুরুগ্রাম
গুরুগ্রাম নাগরিক একতা মঞ্চ-এর সহকারী প্রতিষ্ঠাতা আলতাফ আহমেদ। তিনি বলছেন, “আমি আলতাফ আহমেদ। আমার জন্ম দিল্লিতে। সেখানে আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। আমার জীবনের ত্রিশ বছর কেটেছে দিল্লিতে। বিয়ে করার পর আমি গুরুগ্রামে স্থায়ী হই। এখানে আমি একটি আইটি কোম্পানিতে চাকরি করতাম। গত ১৫ বছর ধরে আমি গুরুগ্রামে বাস করছি। সম্প্রতি আমি চাকরিটি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছি।
আমি আগে সেক্টর ৪৭-এ নামাজ আদায় করতাম। এখন সেটা বন্ধ করে দিয়েছে। তাই আজ আমি সেক্টর ৪৪-এ জুমুআর নামাজ আদায়ের চিন্তা করছি। তবে আমার কাছে ফোন আসছে যে, সেখানেও নাকি সমস্যা করা হচ্ছে “
জনাব আলতাফের স্ত্রী হেন্না আহমেদ। তিনি বলছেন, “আলতাফ জুমুআর নামাজ আদায় করতে গেলে আমার ভয় হয়, জুমুআর নামাজ আদায়ের সময় খারাপ কিছু হয়ে যায় কি না..! তাই আমি সর্বদা তাকে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হয়ে নিই যে, সে জুমুআর নামাজ আদায় করে কোথায় যাবে। যেন আমি জানতে পারি সে কোথায় আছে।”
গুরুগ্রামে দেড় লাখ মুসলিম বাস করেন। এত বিশাল সংখ্যক মুসলিমের জন্য সেখানে কার্যকরী মসজিদ আছে মাত্র ১৩টি। যার কারণে মুসলিমরা খোলা ময়দানে নামাজ আদায় করতে বাধ্য হন। এই খোলা স্থানগুলোর বেশিরভাগই এখন হিন্দুদের আক্রমণের শিকার। প্রতি জুমুআতেই এগুলোতে তারা আক্রমণ করছে।
“পুরো একটি জাতিকে নির্যাতন করা হয়েছে, বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে” বলছিলেন আলতাফ আহমেদ। মুসলিমদের উপর উগ্র হিন্দুদের এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “এই দেশ কি আমাদের নয়? আমাদের কি কোনো স্বাধীনতা নেই? আমরা মুসলিমরা সপ্তাহে মাত্র একবার জুমুআর নামাজ আদায় করি। গুরুগ্রাম প্রশাসন মসজিদের জন্য আমাদের জমি বরাদ্দ দেয় না। তারা কি আমাদেরকে নামাজ আদায়ের জন্য জমি দিয়ে এই সমস্যাটির সমাধান করতে পারে না? পরিকল্পনা করে এটিকে নয়া শহর বানানো হচ্ছে। এখানে অনেক ভূমি এখনও খালি আছে। মন্দির, গুরুদ্বার বানানোর জন্য জমি বরাদ্দ দিচ্ছে। তবে মসজিদ বানানোর জন্য আমাদেরকে জমি বরাদ্দ দিচ্ছে না।”
তিনি বলেন, “এটা খুবই জঘন্য। নামাজ আমাদের ইসলামের মৌলিক ভিত্তি। আর নামাজকেই এরা আক্রমণ করছে। গরীব মানুষদের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। এটা কেবল নামাজের উপরই আক্রমণ নয়, এটা মুসলিমদের উপর নির্যাতন। মুসলিমদের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে।”
আলতাফের স্ত্রী হেন্না আহমেদ বলেন, “আমার ছোটো মেয়ে তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। একদিন স্কুল থেকে ফিরেই সে কান্না শুরু করে দেয়। সে বলছিল, আমার বান্ধবীরা আমাকে ‘পাকিস্তানী‘ বলে ডেকেছে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, কেন?
‘কারণ আমি একজন মুসলিম’—আমার মেয়ে জবাব দেয়।”
তিনি আরও বলেন, “আমি ঐ শিশুদের দোষারূপ করছি না। তারা এগুলো শিখেছে নিজেদের পরিবার থেকে। তাদের পারিবারিক পরিবেশই এমন। আজকাল আপনি টিভি স্ক্রিনে তাকালে দেখবেন, মিডিয়া সর্বদা মুসলিমবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে। আর এভাবে ইসলামবিদ্বেষ প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গেছে।”
তবে বিষয়গুলো আশির দশকে এতটা খারাপ ছিল না বলে মনে করেন আলতাফ আহমেদ। বিগত কয়েক বছরে উগ্র হিন্দুরা খুব বেশি হিংস্র হয়ে ওঠেছে। ২০১৮ সালে গুরুগ্রামে ১০০ এর বেশি নামাজ আদায়ের জন্য খোলা ময়দান ছিল, এখন ২০২১ সালে এসে তা ২০ এর চেয়েও কমে গেছে। গুরুগ্রামে মাত্র ৩ বছরে ৮০ শতাংশের বেশি নামাজের জন্য বরাদ্দ থাকা খোলা ময়দান কমেছে।
এভাবে সমগ্র ভারতেই আজ মুসলিমদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে হিন্দুরা। মুসলিমদের নামাজ আদায়ের অধিকারও কেড়ে নিচ্ছে। অথচ এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে আজ কেউ কিছু বলছে না। জাতিসংঘ কিংবা কথিত মানবাধিকার সংগঠনগুলো তো না-ই, বাংলাদেশে কল্পিত সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে সরব ব্যক্তিরাও আজ ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর নির্যাতনে চুপ। তাদের এই নিশ্চুপ ভূমিকা মুসলিমদের সামনে শত্রু-মিত্রের সংজ্ঞা আরও স্পষ্ট করে দিচ্ছে।
মুসলিমদের উপর এই নির্যাতনকে ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু বলে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। এই অঞ্চলের বরং সমগ্র বিশ্বের মুসলিমরা একই দেহের অংশ। সেই মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের ভিত্তিতে আজও মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ হতে না পারলে, ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সন্ত্রাসীদের হাত থেকে এই উপমহাদেশকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। এই অঞ্চলের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে মুসলিমদের মাঝে সব ধরনের ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং ইসলামের আলোকে সমাধানের পথ বের করতে হবে।
লেখক: সাইফুল ইসলাম
তথ্যসূত্র:
1. Gurugram Namaz | Looking for Space and Dignity to Pray in ‘Millennium City’, The Quint; https://tinyurl.com/4np8b87r