গত ৩ মার্চ, আসন্ন রমাদানকে কেন্দ্র করে সৌদি আরবের ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে বেশ কিছু বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। দেশটির ধর্ম মন্ত্রী আব্দুল লতিফ শেখ এক বিবৃতিতে দশটি পয়েন্ট সংবলিত একটি আদেশনামা জারি করেছেন। এই নির্দেশনাগুলো সে দেশের সবাইকে মেনে চলতে হবে বলে বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
নির্দেশনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে –
– ইমাম ও মুয়াজ্জিন খুব প্রয়োজন ব্যতীত মসজিদে অনুপস্থিত থাকতে পারবেন না।
– তারাবিহ নামাজ দীর্ঘায়িত করা যাবে না।
– শেষ দশ দিন তাহাজ্জুদ নামাজ ফজর নামাজের অনেক আগেই শেষ করতে হবে যেন মুসল্লিদের কষ্ট না হয়।
– নামাজের দৃশ্য ধারণ ও সম্প্রচার করা যাবে না।
– শেষ দশ দিন ইতিকাফ পালন করার জন্য মসজিদের ইমাম সাহেবদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে এবং ইতিকাফকারীদের
নাম-পরিচয় ও ব্যক্তিগত তথ্য ইমাম সাহেবদের কাছে সংরক্ষণ করতে হবে।
– রোজাদারদের ইফতার করানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যতীত কেউ সাদাকাহ সংগ্রহ করতে পারবে না।
– মসজিদের ভেতরে ইফতারের আয়োজন করা যাবে না, তবে মসজিদের বাহিরে ইফতার করা যাবে।
– মসজিদের মাইকে আজানের শব্দ কমাতে হবে।
– বাবা-মায়ের সাথে নিজ সন্তানদেরকে নামাজে নিয়ে আসার ওপরও দেয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা।
এই নির্দেশনা জারির পর থেকে শুধু সৌদি আরব নয়, বরং পুরো মুসলিম বিশ্বেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ এই নির্দেশনাগুলোকে সরাসরি ইসলাম বিরোধী ও ইসলাম বিদ্বেষী সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, রমাদানে মসজিদগুলোতে সার্বিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য নির্দেশনাগুলো কার্যকরী ভূমিকা রাখবে।
যারা বিরোধিতা করছেন বা নিন্দা জানাচ্ছেন, তারা মূলত ৩/৪টি নির্দেশনার পেছনে সৌদি প্রশাসনের কুট উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন। পাশাপাশি এসকল নির্দেশনা বাস্তবায়নের ফলে দীর্ঘ মেয়াদে ইসলাম ও মুসলিমদের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন।
তারাবির নামাজ দীর্ঘায়িত না করা, তাহাজ্জুদ নামাজ ফজরের অনেক আগেই শেষ করা, মাইকে আজানের শব্দ কমানো, অভিভাবকের সাথেও বাচ্চাদের মসজিদে আনার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা – এই বিষয়গুলো নিয়েই বেশি আপত্তি দেখা যাচ্ছে।
এটা ঠিক যে, প্রতিটি নির্দেশনারই ইতিবাচক দিক রয়েছে। তবে বিষয়গুলো এমনও নয় যে, একেবারে রাষ্ট্রীয়ভাবে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা জারি করে এগুলো নিষেধ করতে হবে। সাধারণত দেখা যায়, মসজিদের ইমাম সাহেবরা প্রতি বছরই সাধারণ মুসল্লিদেরকে এসব বিষয়ে সচেতন করেন। তাছাড়া, গত দেড় হাজার বছরে এমন নজির হয়তো নেই যে, এ সকল বিষয় নিয়ে সমাজে বড় ধরনের কোনো বিশৃঙ্খলা হয়েছে।
আর এসব কারণেই সৌদি প্রশাসনের পক্ষ থেকে এমন বিধিনিষেধ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ রয়েছে। তাছাড়া, এটা সবার কাছেই স্পষ্ট যে, মুহাম্মাদ বিন সালমান ক্রাউন প্রিন্স হবার পর থেকেই একের পর এক শরিয়তের মেজাজ বিরোধী এবং অনেক হারাম বিষয়কে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সেসব বিষয়কে পৃষ্ঠপোষকতাও করা হচ্ছে। যে সকল উলামায়ে কেরাম সৌদি প্রশাসনের এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন, তাঁদের সকলকেই গ্রেফতার করা হয়েছে এবং সুনির্দিষ্ট ও যৌক্তিক তথ্য প্রমাণ ছাড়াই তাঁদেরকে দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ড দেয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে, সৌদি আরবে সম্প্রতি অত্যন্ত জাঁকজমক ভাবে পালিত হয়েছে পশ্চিমাদের হ্যালোইন উৎসব, যা কিনা একটি পৌত্তলিক সংস্কৃতি থেকে আবির্ভূত হয়েছে; একের পর এক খোলা হচ্ছে সিনেমা হল, যেখানে প্রদর্শিত হচ্ছে হলিউড-বলিউডের সব অশ্লীল সিনেমা; প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেশে এখন নিয়মিতই আয়োজন করা হয় নাচ-গানের কনসার্ট, যেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে ভাড়া করে আনা নর্তক-নর্তকীরা নেচে গেয়ে পৈশাচিক উন্মাদনা দেয় সেখানকার যুবক-যুবতীদের।
বিপরীতে, হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ মাস রমাদানকে ঘিরে আরোপিত এই বিধি-নিষেধগুলো ইসলামকে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনেকাংশেই সীমিত করবে। দীর্ঘ মেয়াদে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
প্রাথমিক ভাবে, এমন আপাত ইতিবাচক বিধিনিষেধের মাধ্যমে ধর্মীয় কার্যক্রমের উপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে জনমনে সহনীয় করা হচ্ছে। পরবর্তীতে আরও কঠোর বিধিনিষেধ আসলেও তখন জনগণ তা স্বাভাবিকভাবে নিতে শুরু করবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে এমন পদক্ষেপ ইতিহাসে নতুন নয়।
সার্বিক বিবেচনায় কেউ যদি বলে, ‘নানান ইসলামবিরোধী কাজ-কর্ম সম্পাদনে সৌদি আরবের মুসলিমরা স্বাধীন হলেও, ইসলাম পালনের ক্ষেত্রে তারা পুরোপুরি স্বাধীন নয়’ তাহলে খুব একটা অত্যুক্তি করা হবে না।
নিশ্চয়ই সৌদি প্রশাসন কিছু আশঙ্কাকে প্রতিহত করার জন্য এমন পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে, ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে মুসলিমদের স্বাধীনতায় কোনো বিধিনিষেধ আরোপ না করেও, তাদের আশঙ্কার জায়গাগুলো প্রতিহত করার সুযোগ রয়েছে নিশ্চয়ই।
একটি আদর্শ মুসলিম রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সকলে যেন সর্বোত্তম ভাবে আল্লাহ তা’আলার দ্বীন পালন করতে পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ধর্ম পালনে বিধিনিষেধ আরোপ করে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস জনমনে এমন আশঙ্কা তৈরি করবে এটাই স্বাভাবিক। সৌদি প্রশাসনের উচিৎ বিষয়গুলো নিয়ে আরও গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে জনবান্ধব এবং ইসলামবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
________________________________________
তথ্যসূত্র:
———
1. Saudi Arabia imposes restrictions on Ramadan practices, limiting loudspeakers and surveiling worshippers
– https://tinyurl.com/3crjsyya