গাজায় ইসরায়েলের শিশুহত্যার তাণ্ডব অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে

- মুহাম্মাদ মহসিন

0
398
ইসরায়েলি আগ্রাসনে গাজায় নিহত শিশুদের একাংশ, ছবি: এক্স (সাবেক টুইটার)।

গাজায় মাত্র তিন সপ্তাহে ইসরায়েলি বোমায় যত শিশু নিহত হয়েছে তা বিশ্বের বাকি সব যুদ্ধক্ষেত্রে শিশুহত্যার চেয়েও বেশি। শিশুদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের বরাতে আল-জাজিরা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।

সংস্থাটির তথ্যমতে, গাজায় ইসরায়েলিদের হাতে নিহত শিশুদের সংখ্যা ২০১৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত যুদ্ধ সংক্রান্ত দেশগুলোর বার্ষিক শিশুহত্যার সংখ্যাকে ছাড়িয়েছে। ফিলিস্তিনি শিশুদের এই বিপর্যয়কর অধ্যায়কে আরও কঠিন করেছে গাজায় ইসরায়েলের স্থলাভিযান, যেখানে এখন মিসাইল আর ট্যাংকের গোলায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে সাদা কাফনে জড়ানো রক্তাক্ত ছোট্ট শিশুর লাশের সংখ্যা।

আল-জাজিরার এক প্রতিবেদন বলছে, যুদ্ধ এক মাস পার হলেও গাজায় শিশুহত্যার প্রকৃত চিত্র এখনো উন্মোচিত হয়নি, পরিস্থিতি ধারণা থেকেও খারাপ।
গাজায় শিশু হত্যার সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত শিশুদের পরিসংখ্যানের এক তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেছে সংবাদমাধ্যমটি। এতে শুরুতেই উঠে এসেছে গাজায় শিশুহত্যার ভয়াবহতা। জাতিসংঘের বরাতে বলা হচ্ছে, গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ১০৪ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এটা কেবল এক মাসের তথ্য, অর্থাৎ সহজেই বোঝা যাচ্ছে গাজায় দিনে কমপক্ষে ১০০ শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে।

৩৬৫ বর্গ কিলোমিটারের গাজায় ২৩ লাখ মানুষের বসবাস, প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৬ হাজার ৩০০ মানুষ। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের হিসাবে গাজায় মোট জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশ শিশু। আল-জাজিরার ইনফোগ্রাফিতে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের সাম্প্রতিক যুদ্ধ সংক্রান্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে গাজাতেই সবচেয়ে বেশি শিশু হত্যার শিকার হয়েছে।

গাজা যুদ্ধের আগে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত যুদ্ধক্ষেত্র ছিল ইউক্রেন। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো ইউক্রেন সরকারের বরাতে জানিয়ে আসছিল রাশিয়ার আক্রমণে সেখানে বিপুলসংখ্যক বেসামরিক মানুষ নিহত হচ্ছে, যাদের অনেকেই শিশু। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়া আক্রমণ করে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট কার্যালয় পরিচালিত চিলড্রেন অফ ওয়ার ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, দেশটিতে এখন পর্যন্ত যুদ্ধে নিহত শিশুর সংখ্যা ৫১০। সেই যুদ্ধের আজ (০৭ নভেম্বর) ৬২৩তম দিন, এই হিসেবে ইউক্রেন যুদ্ধে শিশু নিহতের সংখ্যা দিনে একজনেরও কম।
তবে আল-জাজিরা বলছে, রুশ দখলকৃত এলাকাগুলোয় শিশু মৃত্যুর সংখ্যা এখনো অজানা, সেখানে শিশু নিহতের প্রকৃত সংখ্যা হাতে এলে হয়তো ইউক্রেনে শিশুহত্যার আরও বাস্তব চিত্র পাওয়া যেত। তবুও ধারণা করা যায় সেটা গাজার শিশুহত্যার তুলনায় কম।

এরপর আল-জাজিরা তুলে ধরেছে ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন ও আফগানিস্তানে শিশুহত্যার পরিসংখ্যান। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ২০০৩ সালে ইরাকে আগ্রাসন শুরু করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। ২০০৮ সালে সেখানকার শিশু অধিকার পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ শুরু করে ইউনিসেফ। প্রতিষ্ঠানটির দেয়া তথ্যমতে, তখন থেকে ২০২২ পর্যন্ত ১৪ বছরের ইরাক যুদ্ধে শিশু নিহতের সংখ্যা ৩ হাজার ১১৯ জন। যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি।

এরপর আসা হয়েছে সিরিয়া যুদ্ধে শিশুদের দুর্দশার চিত্রে। জাতিসংঘের হিসাবে ২০১১ সাল থেকে শুরু করে এই বছরের মার্চ পর্যন্ত সিরিয়া যুদ্ধে নিহত শিশুর সংখ্যা ১২ হাজার, অর্থাৎ দিনে তিন শিশু।

মধ্যপ্রাচ্যের আরেক যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ ইয়েমেন ২০১৫ সাল থেকে ভয়াবহ যুদ্ধে বিপর্যস্ত। ইউনিসেফের হিসাবে তখন থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭ বছর ৬ মাসের যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে ৩ হাজার ৭৭৪ শিশু। অর্থাৎ প্রতি চার দিনে প্রাণ গেছে তিন শিশুর।

এরপর আফগানিস্তানের দীর্ঘ সময় ধরে চলাকালীন যুদ্ধের মধ্যে কেবল ২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়ে এই যুদ্ধে ৮ হাজার ৯৯ জন শিশুর প্রাণহানির তথ্য দেখানো হয়েছে। তবে অন্যান্য কিছু নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যমের জরিপে দেখা গেছে যে, সেখানে নিহত শিশুর সংখ্যা দৈনিক গড়ে ৫ জন।

সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, দীর্ঘকালীন এসব যুদ্ধে শিশুহত্যার তুলনায় বর্তমান সময়ে মাত্র এক মাসে গাজায় শিশুহত্যা যেন সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। গাজা যেন হয়ে উঠেছে শিশুদের মৃত্যুপুরী। এক মাস ধরে খাবার, পানি ও সব রকমের মানবিক প্রয়োজনীয় সামগ্রী বন্ধ করে দিয়ে বোমা হামলা ও গণহত্যা চালানোর এমন ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।



 

তথ্যসূত্র:
——–
1. Is Israel’s Gaza war the deadliest conflict for children in modern times?
https://tinyurl.com/3p7e7ee7

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধসেনা কনভয়ে টিটিপির এম্বুশ, অফিসার সহ ৩ সেনা নিহত
পরবর্তী নিবন্ধরাজস্থানে বিধানসভা নির্বাচনকে ঘিরে মুসলিমদের উপর হামলা ও কটূক্তি