বৈশ্বিক নানা ঘটনা প্রবাহের আড়ালেই সুদানে ঘটে যাচ্ছে জাতিগত সহিংসতার নজিরবিহীন অপরাধ। পরাশক্তিগুলোর কুটচালে সেখানে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও জাতিগত সহিংসতার বলি হচ্ছেন সাধারণ মুসলিমরা। পশ্চিমা ষড়যন্ত্রে নিজেদের দক্ষিণ ভূখণ্ডকে খ্রিস্টান রাষ্ট্র হিসেবে আলাদা হয়ে যেতে দেখা সুদানিজ মুসলিমরা এখন পড়েছেন নিজ দেশেরই বিবাদমান পক্ষগুলোর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর জাতিগত সংঘাতের মাঝে; ১৫ এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত যার বলি হয়ে সেখানে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১০ হাজার মুসলিম।
সুদানের মুসলিমদের বেদনা ও বঞ্চনার ইতিহাস বেশ পুরনো। যুগের পর যুগ ধরে গৃহযুদ্ধ ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর নির্দয় প্রতিযোগিতা ও ষড়যন্ত্র আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে সম্ভাবনাময় এই মুসলিম ভূখণ্ডটিকে।
সুদানের দারফুর অঞ্চলের বিদ্রোহ দমনে করতে স্থানীয় আরব মিলিশিয়াদের নিয়ে ২০০৩ সালে জানজাবিদ ফোর্স গঠন করেছিল সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির। জানজাবিদের সদস্যদের নিয়েই পরবর্তীতে রেপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ) গঠন করা হয়; এই ফোর্সের কমান্ডার হামদান দাগোলো সহ অধিকাংশ সদস্যই ছিল জানজাবিদের সদস্য। আর তারাই আরব বসন্ত পরবর্তী প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে উৎখাত করে বশিরকে।
তবে সুদানের ক্ষমতাসীন সেনাবাহিনী এবছর আরএসএফকে সেনাবাহিনীর সাথে যুক্ত করে একক ক্ষমতা বাস্তবায়ন করার ঘোষণা দিলে, দেশজুড়ে নতুন করে শুরু হয় উভয় বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ। এই আরএসএফের পেছনে জায়নবাদী ইসরায়েলের প্রত্যক্ষ মদদ থাকার জোরালো গুঞ্জনও রয়েছে।
দুই বাহিনীর সংঘর্ষের মাঝে চরম আতংকে দিনাতিপাত করছেন রাজধানী খারতুম সহ গোটা সুদানের অধিবাসীরা। বিশেষ করে দারফুর অঞ্চলে অনারব এবং কৃষ্ণাঙ্গ গোত্রগুলি আরএসএফ ও সহযোগী আরব মিলিশিয়াদের প্রধান টার্গেট।
মাসালিত গোত্র আরএসএফের বিশেষ টার্গেট; এই গোত্রের অনেকেই সেখানে আল-কায়েদা যোদ্ধাদের সাথে মিলে যুদ্ধ করছিলেন। অতীতে ওমর আল বশিরের আমলে সংঘটিত গণহত্যার সময়ও মাসালিতরাই ছিল জানজাবিদ ফোর্সের অন্যতম টার্গেট। সেসময় দারফুর অঞ্চলে প্রায় ৩ লাখ মুসলিম নিহত হয়েছিলেন, যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল জানজাবিদদের গণহত্যার শিকার।
এবছর মধ্য এপ্রিলে সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলে, জুন মাস নাগাদ তা দারফুর অঞ্চলেও ছড়িয়ে পরে। আর জুন মাস থেকেই মাসালিত সহ অন্যান্য অনারব গোত্রগুলোকে আল-জেনিন অঞ্চলে টার্গেট করতে শুরু করে আরএসএফ ও তাদের সহযোগী স্থানীয় আরব উপজাতিদের নিয়ে গঠিত মিলিশিয়ারা।
যুদ্ধ শুরুর প্রথম সপ্তাহেই আরএসএফ পশ্চিম দারফুরের অধিকাংশ এলাকা দখল করে নেয়, সুদানিজ আর্মি তখন ১৫ তম পদাতিক ডিভিশনের এলাকাতেই নিজেদের সীমিত করে ফেলে। মালাসিত গোত্রের স্থানীয় যোদ্ধারা তখন আল-কায়েদার অধীনে সেসকল অঞ্চলে যুদ্ধ করতে থাকে। অক্টোবরের শেষ নাগাদ আরএসএফ ও উপজাতিয় আরব মিলিশিয়ারা দক্ষিণ ও মধ্য দারফুর থেকে সুদানিজ আর্মিকে বিতাড়িত করে দিতে সক্ষম হয়। আর নভেম্বরের ৪ তারিখে সেনাবাহিনীর ১৫ তম পদাতিক ডিভিশন দখল করে নেয়। এর পরের ৩ দিনে পশ্চিম দারফুরের আল-জেনিনা অঞ্চলে মাসালিত গোত্রের উপর জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালায় আরএসএফ।
বিগত জুন মাস থেকে দারফুরে প্রায় ৫০০ জন সাধারণ নাগরিককে হত্যা করে তারা, অক্টোবর মাসে হত্যা করে আরও প্রায় ১ হাজার জনকে। আর সেনাক্যাম্প দখলের পরবর্তী তিন দিনেই মাসালিত সম্প্রদায়ের অন্তত ১,৩০০ মুসলিমকে গণহারে হত্যা করেছে আরএসএফ ও আরব মিলিশিয়ারা। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, এই সংখ্যা ২ হাজারের বেশি। আরএসএফের অত্যাচারে সুদান থেকে পার্শ্ববর্তী দেশ চাদে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন প্রায় ৫ লাখ মুসলিম, যাদের অধিকাংশই গিয়েছেন পশ্চিম দারফুর থেকে। আর এপর্যন্ত অনেক নারীকেই সেখানে যৌনদাসি হিসেবে ব্যবহার করার অসংখ্য অভিযোগও সামনে এসেছে। চাদে আশ্রয় গ্রহণ করা অনেকেই মিডল ইস্ট আইকে বলেছেন যে, তারা স্বচক্ষে দেখেছেন যে উপজাতিয় আরব মিলিশিয়ারা সেখানে শত শত মুসলিমকে হত্যা করেছে এবং নারীদেরকে ধর্ষণ করেছে। রাস্তায় শত শত মানুষের লাশ পরে থাকতে দেখার কথাও জানিয়েছেন তারা।
দারফুরের কোলবোস, সেরবাস, আজুরনি, আদরা এবং সিদান ও চাদ-সুদান সংযোগ সড়কের চেকপয়েন্টগুলোতে এসকল অপরাধ সংঘটিত করেছে আরএসএফ ও স্থানীয় আরব মিলিশিয়ারা।
‘দা রুটস ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড মনিটরিং ভায়োলেশন’ নামক একটি সংস্থা পার্শ্ববর্তী চাদে আশ্রয় নেওয়া সুদানিজদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে নিহত এই ১,৩০০ ব্যক্তির নাম-পরিচয় নিশ্চিত করেছে। মিডল ইস্ট আই এবং অন্যান্য সূত্রের বরাত দিয়ে এই সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছে শাহাদাহ্ নিউজ এজেন্সি।
বিশ্বের অন্যান্য ঘটনাপ্রবাহের আড়ালে পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা অঞ্চলের মুসলিমদের করুণ অবস্থা এভাবেই হয়তো থেকে যাচ্ছে সকলের চোখের আড়ালে। আরব-অনারব কে শ্রেষ্ঠ, মুসলিমদের মধ্যে এই জাতিগত বিভেদ চাঙ্গা করে দিয়ে সেখানে অমুসলিমদের প্রেসক্রিপশনে এভাবেই চলছে হত্যাযজ্ঞ।