৭১১ খৃস্টাব্দের ৩০ এপ্রিল। এদিন স্পেন বিজয়ের মহানায়ক মুসলিম সেনাপতি তারেক বিন জিয়াদের অপ্রতিরোধ্য আক্রমণের মুখে স্পেনে কুফুরী শাসনের অবসান ঘটে। সূচনা হয় মুসলিম শাসনের সোনালী অধ্যায়ের। শতসহস্র বছর ধরে অধিকার-বঞ্চিত মানবতা ফিরে পায় সুশাসন। জালিম শাসকদের অকথ্য জুলুম-নির্যাতনের পট পরিবর্তন হয়ে স্পেনের দিগন্তে প্রস্ফুটিত হয় এক আলো-ঝলমলে সুহাসিনী ভোর৷ সে থেকে স্পেন আমাদের। স্পেনের মাটিতে নির্মিত হতে থাকে ইসলামী সভ্যতা। সভ্যতার সবক নিতে কাঙ্গালসদৃশ বর্বর ইউরোপীয়রা ভিড় জমাতে থাকে স্পেনের গলি-ঘুপচিতে।
কিন্তু আফসোস, গর্বের ও ঐতিহ্যের এই অধ্যায় মাত্র কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই স্বার্থান্ধ কিছু অসৎ-চরিত্রের শাসকদের স্বার্থের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। স্পেন ছোটবড় ২০ টি খণ্ডরাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ইহাইয়া, আব্দুল্লাহ, রশিদ আর মুতামিদরা ভোগ-বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয়। নারী আর মদের নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে আড়ম্বরপূর্ণ বিলাসবহুল রাজপ্রাসাদে। কবিতার আসর, গানের আসর আর অশ্লীল নৃত্যের আসর তৎকালীন স্পেনের রাজপ্রাসাদগুলোর প্রতিদিনকার স্বাভাবিক চিত্র ছিল। এসবের খরচ জোগাড় করতে জনসাধারণের উপর চাপানো হয় অনৈতিক করের বোঝা৷ করের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ে খেটে-খাওয়া মানুষগুলো। খণ্ডরাজ্যের শাসকদের এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যেসব সম্মানিত আলেম মুখ খুলতেন তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হতো। অপরাধের মাত্রা অনুপাতে কতককে জনসম্মুখে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হতো। ভেতরগত এসব কোন্দলের সুযোগ নিয়ে ইউরোপের খৃস্টীয় জগত স্পেন দখলের স্বপ্ন বুনতে শুরু করে। ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী এই মুসলিম দেশটিকে যেন সমগ্র ইউরোপ মিলে সমুদ্রেই ফেলে দেবে! খৃস্টানদের পক্ষ হয়ে সরাসরি যুদ্ধে আসে ক্যাস্টিলের রাজা ষষ্ঠ আলফানসু। স্পেনের খণ্ডরাজ্যের শাসকরা কেউ কেউ তার সাথে হাত মিলায়৷ একজনকে সঙ্গে নিয়ে অন্যজনকে পরাজিত করার মূলনীতি অবলম্বন করে আলফানসু স্পেন বিজয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে থাকে। একাদশ শতাব্দীর সেই ভেতর ও বাহিরের শত্রু কবলিত স্পেনকে মুক্ত করতে যে মহামানব সুদূর আফ্রীকা থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে স্পেনে এসেছিলেন, তিনিই হলেন আমিরুল মুরাবিতীন ইউসুফ বিন তাশফীন।
তাঁর সফল নেতৃত্ব, পাহাড়সম ঈমান, আল্লাহ্ তাআলার প্রতি অগাধ আস্থা আর মানবতার জন্য নিষ্কলুষ মমতার সামনে বালুর প্রাসাদের মতোই ধ্বসে পড়ে স্পেনের জালিম শাসকদের অট্টালিকা। ইউরোপীয়দের মুখপাত্র আলফানসুর দীর্ঘদিনের অর্জিত প্রভাব-প্রতিপত্তি, ক্ষমতা আর দাপট নিছক ফানুসের মতোই উড়ে গিয়ে পড়ে ভূমধ্যসাগরে। কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায় স্পেনের মাটি ছেড়ে। বর্শার আঘাতে খেয়ে পায়ে এমন মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি হয় যে, বাকি জীবন তাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে হয়। ইউসুফ বিন তাশফীনের কাছে পরাজিত হয়ে আরো আড়াই শতাব্দির জন্য স্পেনকে ঘিরে ইউরোপের স্বপ্ন দেখার সাধ মিটে যায়।
জন্ম, বংশ ও শৈশব
আমীর ইউসুফ বিন তাশফীন ১০০৯ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ৪০০ হিজরীতে বর্তমান মৌরিতানিয়াতে জন্মগ্রহণ করেছেন। তার বংশের নাম ছিল লামতুনা। উপনাম আবু ইয়াকুব আর উপাধি ছিল আমিরুল মুসলিমীন ওয়া নাসিরুদ্দীন। তাঁর পূর্ণ নাম এরকম: আবূ ইয়াকূব ইউসুফ বিন তাশফীন বিন ইবরাহীম লামতুনী সানহাজী।
তিনি গাঢ় রঙ, মাঝারি উচ্চতা, পাতলা শরীর, হালকা চেহারা, নরম কণ্ঠ, কালো চোখ, বাঁকা নাক এবং কোঁকড়ানো চুলের অধিকারী ছিলেন। শৈশবে তিনি বেড়ে ওঠেন মরুভূমিতে এবং সেখানকার মানুষদের রীতিনীতি ও ঐতিহ্য গ্রহণ করেন। মরুভূমিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তেমন না থাকায় তিনি মুহাদ্দিস এবং ওয়ায়েজদের থেকে শোনে শোনেই দীনী জ্ঞান লাভ করেন। ধর্মের গভীর জ্ঞান লাভ করার সুযোগ তাঁর হয়নি। দীনের গভীর জ্ঞানার্জন মূলত ফকীহদের কাজ ছিল আর সেসময় মরুভূমি ফকীহদের আগমন ও দরস প্রদানের উপযোগী ছিল না। তবে শায়েখ আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াসিনের বিপ্লবী শিক্ষার একটি অংশ তিনিও লাভ করেছিলেন।
মুরাবিত সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন:
মুরাবিত সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয় শায়েখ আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াসিনের হাত ধরে। তিনি মালেকি মাযহাবের একজন ফকীহ ছিলেন। পঞ্চম শতাব্দীতে তিনি উত্তর সেনেগালে মুরাবিত নামে একটি ইসলামী সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। তবে মুরাবিত সাম্রাজ্যের আমীর তিনি ছিলেন না। তিনি ছিলেন সকলের শায়েখ। এই সাম্রাজ্যের সর্বপ্রথম আমীর ছিলেন ইয়াহয়া ইবনে ইবরাহীম জুদালী। ৪৪৫ হিজরী মোতাবেক ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দের এক যুদ্ধে তিনি শাহাদাতবরণ করলে শায়েখ আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াসিন মুরাবিত সাম্রাজ্যের পরবর্তী আমীর হিসেবে ইয়াহয়া ইবনে উমর লামতুনীকে নির্বাচন করেন। মাত্র দুই বছর সাম্রাজ্য পরিচালনা করে ৪৪৭ হিজরী মোতাবেক ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনিও শাহাদাতবরণ করেন। তখন শায়েখ আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াসিন ইয়াহয়া ইবনে উমরের ভাই আবু বকর ইবনে উমর লামতুনীকে এই সাম্রাজ্যের আমীর নির্বাচন করেন। ৪৫১ হিজরীতে শায়েখ আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াসীন বারগাওয়াতার যুদ্ধে শাহাদাতবরণ করেন। এদিকে আবু বকর ইবনে উমর লামতুনী ৪৫৩ হিজরীতে নিজের ভাইপো ইউসুফ বিন তাশফীনকে মুরাবিত সাম্রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত আমীর নিযুক্ত করে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিতে বর্তমান সুদান চলে যান। দীর্ঘ সময় তাঁর অনুপস্থিতির কারণে অগত্যা ইউসুফ বিন তাশফীনকেই এই সাম্রাজ্যের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিতে হয়।
আমীরুল মুরাবিতীন ইউসুফ বিন তাশফীন ও মুরাবিত সাম্রাজ্যের অবিশ্বাস্য বিস্তার
মুরাবিত সাম্রাজ্যের আমীর হয়েই তিনি এক মহান দায়িত্ব আপনা থেকেই নিজ কাঁধে তুলে নেন। সেনেগাল থেকে সূদূর মরক্কো ও তিউনিসিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে মুরাবিত সাম্রাজ্যের অধীন করার দায়িত্ব তুলে নেন নিজ কাঁধে এবং এলক্ষ্যে বিশাল এক সেনাবাহীনি গড়ে তোলেন। একের পর এক অঞ্চল জয় করতে করতে তিনি নিজ লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলেন দুর্বার গতিতে। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর বাহিনী ৪০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ইউসুফ বিন তাশফীনের সাহসী আক্রমণের সামনে টিকতে না পেরে আঞ্চলিক কুফুরী শক্তিগুলো একে একে মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে। অপর দিকে তাঁর অমায়িক ও কোমল আচরণে মুগ্ধ হয়ে দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে থাকে আফ্রিকার মরু অঞ্চলের মানুষগুলো।
এদিকে তাঁর চাচা আবু বকর ইবনে উমর লামতুনী (যিনি এই সাম্রাজ্যের মূল আমীর ছিলেন এবং নিজ ভাইপোকে ভারপ্রাপ্ত আমীর বানিয়ে সুদান চলে গিয়েছিলেন) দীর্ঘ ১৫ বছর পর ৪৬৮ হিজরী মোতাবেক ১০৭৬ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় মুরাবিত সাম্রাজ্যে ফিরে আসেন। মাত্র ১৫ বছরের ব্যবধানে ইউসুফ বিন তাশফীনের অবিশ্বাস্য অর্জন দেখে তিনি যথারীতি হতবাক হয়ে যান। কারণ, তিনি তো ইউসুফ বিন তাশফীনের হাতে শুধু উত্তর সেনেগাল আর দক্ষিণ মৌরিতানিয়ার রাজত্ব ছেড়ে গিয়েছিলেন। অথচ মাত্র ১৫ বছরের মাথায় তিনি পূর্ণ সেনেগাল ও মৌরিতানিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়াকে মুরাবিত সাম্রাজ্যের শাসনাধীন করে ফেলেছেন এবং এ অঞ্চলের মানুষগুলোকে ইসলামে দীক্ষিত করে ফেলেছেন। বিরাট এক সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছেন। যে বাহিনীতে শুধু অশ্বারোহী সৈন্যের সংখ্যাই ছিল এক লাখের বেশি। এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য পদাতিক সৈন্য। এই সময়ের মধ্যে ইউসুফ বিন তাশফীন মরক্কোতে মারাকেশ নামে একটি শহর নির্মাণ করেছেন। যেটিকে তৎকালীন বিশ্বে উন্নত শহরগুলোর মধ্যে গণ্য করা হতো।
এছাড়াও আমীর আবু বকর ইবনে উমর লামতুনি ইউসুফ বিন তাশফীনকে একজন খোদাভীরু, মুত্তাকী, বিনয়ী, প্রজাদের প্রতি রহমদিল ও দীন সম্পর্কে বিপুল প্রজ্ঞার অধিকারী একজন আমীর হিসেবে আবিষ্কার করেছেন। এসবকিছু পর্যবেক্ষণ করে তিনি যে পদক্ষেপটি গ্রহণ করেছিলেন সেটি কেবল মুসলিম শাসকদের ইতিহাসেই পাওয়া যায়। তিনি ইউসুফ বিন তাশফীনকে লক্ষ করে বললেন: “নিশ্চয়ই শাসনকার্যে তুমি আমার চেয়ে অধিকতর যোগ্য। প্রকৃত আমীর তো তুমিই। আমি তো অল্প সময়ের জন্য তোমাকে খলিফা নিযুক্ত করেছিলাম, কিন্তু তুমি তো নিজেকে আমীর হওয়ার উপযুক্ত প্রমাণ করে ফেলেছো। তুমি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে, রাষ্ট্র শাসন করতে এবং ইসলাম প্রচার করতে আমার চেয়ে বেশি যোগ্য, তাই তুমিই এই রাজ্যের আমীর। আর আমি শুধু মানুষের ইসলামে প্রবেশ করার প্রশান্তিকর দৃশ্য দেখে দেখে আনন্দ লাভ করব। আমি পুনরায় ইসলামের দাওয়াত দিতে চলে যাচ্ছি”।
আমীর ইউসুফ বিন তাশফীন ও তৎকালীন স্পেন
ইউসুফ বিন তাশফীন যখন আফ্রিকার মাটিতে কুফরির বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে ইসলামের সুবাসিত উদ্যান তৈরিতে মগ্ন ছিলেন তখন স্পেনের মাটিতে ইসলামী শাসন এক চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল। উমাইয়াহ খিলাফাহর পতনের কারণে এমনিতেই স্পেনে মুসলিম শাসকদের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তার উপর আবার মুসলিম শাসকদের সীমাহীন ভোগ-বিলাসিতা; এসবের সুযোগ নিয়ে ক্যাস্টিলের রাজা ষষ্ঠ আলফানস স্পেন বিজয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে এবং শক্তিশালী আক্রমণ করে একের পর এক শহর দখলে নিতে থাকে। ১০৮৫ সালে মুসলমানদের অন্যতম বড় কেন্দ্র এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক শহর টলেডো দখল করে নেয়। এরপর এই টলেডো আর কখনোই ইসলামী শাসনের অধীনে আসেনি।
টলেডো দখল করার পর তার প্রধান টার্গেট হয় বাতালইয়ুস (বাদাজোজ) ও সেভিল। প্রথমে সে সেভিল অবরোধ করে। এছাড়াও ছোটবড় অনেক শহর সে ইতোমধ্যে দখল করে নিয়েছে। স্পেনের শাসকদের টনক তখনো নড়েনি। কিন্তু বিচক্ষণ উলামায়ে কেরাম ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে, অদূর ভবিষ্যতে স্পেনের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে? তাই এর উত্তম সমাধান হিসেবে তাদের দৃষ্টিতে মুরাবিত সাম্রাজ্যের আমীর ইউসুফ বিন তাশফীন ছাড়া আর কোনোকিছুই ধরা দিচ্ছিল না। ফলে আলেমদের পক্ষ থেকে ইউসুফ বিন তাশফীনের কাছে চিঠি আসতে শুরু হয়ে যায় অনেক আগেই। কিন্তু ইউসুফ বিন তাশফীন এই আহ্ববানে সাড়া দিতে পারছিলেন না কারণ, তখনো পর্যন্ত স্পেনের শাসকদের পক্ষ থেকে কোনো চিঠি তিনি পাননি।
স্পেনের শাসকদের পক্ষ থেকে ইউসুফ বিন তাশফীনের কাছে চিঠি
১০৮৫ সালে যখন টলেডো পদানত হয় এবং সেভিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহর অবরোধের শিকার হয় তখন সীমাহীন ভোগ-বিলাসে বুঁদ হয়ে থাকা শাসকদের কারো কারো টনক নড়ে ওঠে। যাদের সর্বাগ্রে আসে মুতামিদ ইবনে আব্বাদের নাম, তিনি সেভিলের শাসক ছিলেন। সেভিল তখন আলফানসোর অবরোধের শিকার। মুতামিদের সামনে ইউসুফ বিন তাশফীন ছাড়া দ্বিতীয় কোনো রাস্তা খোলা ছিল না। হায়, টলেডো যেদিন আলফানসোর নাপাক হস্তক্ষেপের শিকার হয়েছিল, সেদিনই যদি মুতামিদের এই শুভ বুদ্ধির উদয় ঘটত তাহলে টলেডোকে আমরা হারাতাম না। কিন্তু নিজের রাজ্য আক্রান্ত হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সবাই ভেবেছিল, এটা তো অন্য শহরের সমস্যা, আমার শহর তো নিরাপদ! আজ প্রায় এক হাজার বছর পর আমরা যখন টলেডো হারানোর ইতিহাস পড়ি আর লিখি তখন আমাদের অন্তর যেভাবে ব্যথিত হয়, তার কিছুটাও যদি তখনকার শাসকদের অন্তর অনুভব করত তাহলে হয়তো টলেডো আরো কিছুদিন আমাদের থাকত।
সেভিল অবরোধ হওয়ার পর মুতামিদের আত্মমর্যাদাবোধ জেগে ওঠে। যেকোনো মূল্যেই তিনি সেভিলকে আলফানসোর হাত থেকে রক্ষা করতে চান। অবরোধ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। আলফানসো উপহাস করে চিঠি পাঠায় মুতামিদের কাছে। চিঠিতে লেখে, “এখানে আমার খুব গরম লাগছে। মাছির উপদ্রবও খুব বেশি। তুমি আমার জন্য পাখা পাঠাও।” সে বোঝাতে চায়, অবরোধ দীর্ঘ করতে আমার কোনো সমস্যা নেই। তোমাদের বাহিনী নিয়েও আমি চিন্তিত নই; তোমাদের চেয়েও আমার বরং বেশি চিন্তার বিষয় হলো, মাছির উপদ্রব। অর্থাৎ, আমার কাছে মুসলিম বাহিনী মাছির চেয়ে কম গুরুত্ব রাখে। চিঠির উলটো পিঠে মুতামিদ লিখে দিলেন, “তোমার চিঠি পেয়েছি, শীঘ্রই তোমার জন্য আমি লামতি চামড়ার পাখা পাঠাব। এ পাখা থাকবে মুরাবিতিন সেনাদের হাতে। এ পাখার বাতাস আমাদেরকে তোমার হাত থেকে স্বস্তি দেবে; কিন্তু তোমাকে কোনো স্বস্তি দেবে না।”
মুতামিদ ইবনে আব্বাদ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যে, তিনি ইউসুফ বিন তাশফীনকে স্পেনে আসার জন্য চিঠি পাঠাবেন। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়াল অন্য প্রদেশের শাসকেরা। তারা এটা মানতে নারাজ। তাদের কথা হলো, আফ্রিকান বর্বরদের আমরা এই সুন্দর স্পেনে টেনে আনতে পারি না। তারা স্পেনের সৌন্দর্যে পাগল হয়ে যাবে। তখন স্পেন দখল করে আমাদেরকে তাড়িয়ে দেবে। তাদের এসব কথার উত্তরে মুতামিদ যে কথাটি বলেছিলেন, সেটি স্বর্ণের হরফে লিখে রাখার মতো। তিনি বলেছিলেন, “শূকর চড়ানোর চেয়ে উট চড়ানোকে আমি নিজের জন্য উত্তম মনে করি।” অর্থাৎ, আলফানসুর কাছে পরাজিত হয়ে ক্যাস্টিলে গিয়ে শূকর চড়ানোর চেয়ে ইউসুফ বিন তাশফীনের হাতে বন্দী হয়ে আফ্রিকায় গিয়ে উট চড়ানো আমার কাছে বেশি উত্তম।
সবশেষে নিজেদের মুক্তির কথা চিন্তা করে গ্রানাডার শাসক আব্দুল্লাহ বিন বুলুক্কিন ও বাতালইয়ুসের শাসক মুতাওয়াক্কিল বিন আফতাস মুতামিদের সাথে একমত হন। ফলে সেভিল, গ্রানাডা আর বাতালইয়ুসের শাসকদের পক্ষ থেকে ইউসুফ বিন তাশফীনের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। স্পেনের শাসকদের চিঠি পেয়ে ইউসুফ বিন তাশফীন খুব দ্রুত স্পেন রওনা হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করেন।
দাম্ভিক আলফানসর কাছে ইউসুফ বিন তাশফীনের স্পেন আসার এই প্রস্তুতির সংবাদ চলে যায়। সে উপহাস করে ইউসুফ বিন তাশফীনের কাছে চিঠি লেখে, “শুনলাম তুমি নাকি সমুদ্র পাড়ি দিতে পারছো না! এক কাজ করো, আমার জন্য কিছু নৌকা পাঠিয়ে দাও, আমিই বরং সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তোমার কাছে চলে আসি! তখন তোমার পছন্দসই কোনো জায়গায় আমরা যুদ্ধ করব।” ইউসুফ বিন তাশফীন তৎক্ষণাৎ তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ চিঠির কোনো উত্তর দেননি; বরং নিজ কাজে মনোযোগ বাড়িয়ে দেন। তার চিঠির উত্তর তিনি দিয়েছেন স্পেনের মাটিতে প্রবেশ করার পর।
চলবে ইনশাআল্লাহ্…
তথ্যসূত্র:
১। কিসসাতুল আন্দালুস, মিনাল ফাতহি ইলাস সুকুত। ডক্টর রাগিব সারজানি।
২। http://tinyurl.com/bdh3v7jw
৩। http://tinyurl.com/e67f4wxf
জাযাকাল্লাহু খাইরান