‘৬৯-এ ডাকসুর দেয়া ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জাতির পিতা’ উপাধি ‘৭৩-এই ডাকসু কর্তৃক প্রত্যাহার

0
17

দুই ছাত্রনেতাকে গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে শেখ মুজিবুর রহমানকে দেওয়া ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ১৯৭৩ সালেই প্রত্যাহার করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। ওই বছরের ২ জানুয়ারি মুজিবের ওই উপাধি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় ডাকসুর তৎকালীন ভিপি সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ প্রধানকে দেওয়া ‘জাতির পিতা’ তকমাও প্রত্যাহার করে নেয় দেশের দ্বিতীয় সংসদখ্যাত ডাকসু। পাশাপাশি সংগঠনের পক্ষ থেকে দেওয়া সম্মানসূচক আজীবন সদস্যপদও বাতিল করা হয়। এছাড়া ডাকসুর পক্ষ থেকে মুজিবের নামের আগে ‘বঙ্গবন্ধু’ বিশেষণ ব্যবহার না করার জন্য দেশের জনগণ ও গণমাধ্যমের প্রতিও আহ্বান জানানো হয়।

সেই সময়ের দৈনিক বাংলা, ইত্তেফাক, সংবাদসহ পত্রপত্রিকার খবর ও পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজনীতিবিদদের বক্তব্যে এই তথ্য উঠে আসে। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোর আলোচনাকে কেন্দ্র করে বিষয়টি আবার সামনে আসে। ওই অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবের অতীত ইতিহাস উল্লেখ করে মুজিবকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ অ্যাখ্যা দেন অনুষ্ঠানটির অতিথি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এএসএম শাহরিয়ার কবির।

জানা গেছে, ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ভিয়েতনামের জনগণের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে মিছিল বের করে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। মিছিলটি তৎকালীন আমেরিকান দূতাবাসের সামনে গেলে ‘বিনা উস্কানিতে’ পুলিশ আকস্মিকভাবে গুলি চালায়। এতে নিহত হয় ছাত্রনেতা মির্জা কাদেরুল ইসলাম ও মতিউল ইসলাম। আহত হয় অন্তত সাত নেতাকর্মী। এটিকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ছাত্রহত্যার ঘটনা হিসেবে ধরা হয়।

পত্রপত্রিকার খবর বিশ্লেষণে জানা যায়, ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে পরদিন ফুঁসে ওঠে সারা দেশ। বিক্ষোভের নগরীতে পরিণত হয় রাজধানী ঢাকা। ওই দিন ঢাকার সর্বত্র স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন করা হয়। দুই ছাত্রনেতাকে হত্যার প্রতিবাদে পরদিন পল্টন ময়দানে তাদের লাশ সামনে রেখে ঘোষণাপত্র পাঠ করে ডাকসুর তৎকালীন ভিপি ও ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। পরদিন দৈনিক সংবাদ সেটিকে ‘পল্টনের ঘোষণা’ শিরোনামে পত্রিকার প্রথম পাতায় স্থান দেয়।

১৯৭৩ সালের ৩ জানুয়ারি সংবাদে ‘নিজস্ব বার্তা পরিবেশক’-এর বরাত দিয়ে প্রথম পাতায় খবরটি ছাপানো হয়। খবরে বলা হয়, ‘‘গতকাল (মঙ্গলবার) পল্টন ময়দানের জনসমাবেশে শহীদ(!) মতিউল ইসলাম ও শহীদ(!) মির্জা কাদিরুল ইসলামের লাশকে সামনে রেখে ডাকসু ভিপি ও ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম নিম্নোক্ত ঘোষণ পাঠ করে : এই সমাবেশের সামনে ডাকসুর পক্ষ থেকে আমরা ঘোষণা করছি যে, বিগত ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেরুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানকে ডাকসুর পক্ষ থেকে আমরা যে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়েছিলাম, ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে আজ হতে সেই ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রত্যাহার করে নিলাম। আমরা বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ, সংবাদপত্র, রেডিও এবং টেলিভিশনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি যে, আজ হতে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের পূর্বে তার বঙ্গবন্ধু বিশেষণ ব্যবহার করবেন না।’’

খবরে ডাকসুর তৎকালীন ভিপি সেলিম বলেছে, ‘‘একদিন ডাকসুর পক্ষ থেকে আমরা শেখ মুজিবকে ‘জাতির পিতা’ আখ্যা দিয়েছিলাম। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে আবার ছাত্রের রক্তে তার হাত কলঙ্কিত করায় আমরা ছাত্রসমাজের পক্ষে হতে ঘোষণা করছি, আজ হতে কেউ আর জাতির পিতা বলবেন না।”

এতে আরো উল্লেখ করা হয়, ‘শেখ মুজিবকে একদিন ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ দেওয়া হয়েছিল। আজকের এই সমাবেশ থেকে ডাকসুর পক্ষ থেকে আমরা ঘোষণা করছি যে, আজ থেকে শেখ মুজিবের ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ বাতিল করে দেওয়া হলো।’

এ সময় মঞ্চে থাকা ডাকসুর তৎকালীন জিএস মাহবুব জামান উত্তেজিত হয়ে ডাকসু সভার সিদ্ধান্তের বই থেকে সংশ্লিষ্ট পাতা ছিঁড়ে সবার সামনে টুকরো টুকরো করে ফেলে। তবে পরে আর মুজিবের সদস্যপদ ফেরানো হয়নি। পল্টনের ওই ঘোষণা থেকে শোক ও মশাল মিছিলসহ পরবর্তী ৬ দিনের কর্মসূচিও দেওয়া হয়।

উল্লেখ্য, গণঅভ্যুত্থানের সময় ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ডাকসুর তৎকালীন ভিপি ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে তোফায়েল আহমেদ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েলের দেওয়া সেই উপাধির ৪ বছর না পেরোতেই সেটি আবার প্রত্যাহার করে নেয় ডাকসু। সেই সঙ্গে ডাকসুর দেওয়া অন্যান্য সম্মানসূচক উপাধিও বাতিল করা হয়। সে সময় এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানায় মওলানা ভাসানী, আ স ম রব, মুজাফফর আহমদসহ আরো অনেকে। ন্যাপের (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) তৎকালীন নেত্রী মতিয়া চৌধুরী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রতিবাদ সভায় শেখ মুজিবের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে বলেছিল, ‘তুমি আর বঙ্গবন্ধু নও, আজ থেকে তুমি বঙ্গশত্রু।’ যদিও পরে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় যোগ দেয় মতিয়া।

গণবিস্ফোরণ ঠেকাতে ছাত্রলীগ-আ.লীগের ত্রাস

এদিকে ছাত্রজনতার গণবিস্ফোরণ থামাতে ত্রাস সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। সেই সময়ে আওয়ামী লীগ কর্মীরা প্রেস ক্লাবের পেছনে ন্যাপের কেন্দ্রীয় কার্যালয়টি জ্বালিয়ে দেয়। এমনকি আন্দোলন থামাতে হীন কৌশলের আশ্রয় নেয়। ফ্যাসিবাদী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলেও পরে সেই অপকৌশলের প্রতিফলন দেখা যায়। আন্দোলনের পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ ও তাদের অন্যান্য সংগঠন। সে সব কর্মসূচি থেকে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দেওয়া হয়। এছাড়া চলে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ।

সে সময় ‘ছাত্রলীগের গণজমায়েত : বঙ্গবন্ধুর প্রতি ঔদ্ধত্যপূর্ণ উক্তি সহ্য করা হবে না’ শিরোনামে দৈনিক বাংলার ৩ জানুয়ারির পত্রিকায় বলা হয়, “বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (সিদ্দিকী-মাখন) গতকাল বুধবার আরো ঘোষণা করে যেসব সংবাদপত্র ও প্রচারপত্রে বঙ্গন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ‘জাতির পিতা’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে না লেখা হবে সেসব পত্রিকা ও প্রচারপত্রের অস্তিত্ব, বিলোপ করা হবে। তারা আরো ঘোষণা করে যে, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্যপূর্ণ উক্তি ও মঙ্গলবার ছাত্রলীগের মিছিলের ওপর হামলার জন্যে বাংলাদেশ ন্যাপ (মোজাফফর) ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন যদি আগামী ৭ জানুয়ারির মধ্যে ক্ষমা ভিক্ষা না করে তবে বাংলাদেশে এই দুই প্রতিষ্ঠানের কোনো সভা করতে দেওয়া হবে না।”

হত্যার প্রতিবাদে ছাত্রজনতার আন্দোলন চলাকালে মুজিবের ছবি ছেঁড়ার চেষ্টার অভিযোগ এনে এস ইসলাম নামের এক ব্যক্তির কান কেটে নেয় আওয়ামী লীগ। এ নিয়ে ৩ জানুয়ারি প্রকাশিত দৈনিক বাংলার শিরোনাম ছিল ‘বঙ্গবন্ধুর ছবির অসম্মান করায় জনতা তার কান কেটে নিয়েছে’।

মর্গে থাকা ছিনতাইকারীর লাশ এনে ছাত্রলীগকর্মী দাবি

২০১০ সালের ১ জানুয়ারি ‘সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংহতি দিবস’ স্মরণে সাপ্তাহিক একতায় প্রকাশিত সেলিমের লেখা থেকে জানা যায়, আন্দোলন ঠেকাতে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অনেক কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। শুরু হয় সরকারি দলের হুমকি-হামলা। ডাকসু কার্যালয় তছনছ ও ন্যাপ অফিসেও হামলা করে তারা। ৫ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়নের মশাল মিছিলে হামলা চালায় ‘আওয়ামী গুণ্ডারা’ (সেলিমের ভাষায়)। সন্ধ্যার আগে আগে ছাত্র ইউনিয়ন অফিস ও ন্যাপ অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর আগে ৪ জানুয়ারি মেডিকেলের মর্গ থেকে মিরজাহান আলী নামের একজনের লাশ উঠিয়ে এনে সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়, ‘ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা ১ জানুয়ারির পরে ছাত্রলীগ কর্মীকে হত্যা করেছে’। পরদিন প্রমাণ হয়, লাশটি পুলিশের গুলিতে নিহত একজন হাইজ্যাকারের। ঘটনার ৭ দিন আগে, ২৭ ডিসেম্বরে এটি মর্গে রাখা হয়।

পরে তীব্র বিক্ষোভের মুখে হত্যার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে শেখ মুজিব। সেই সঙ্গে সাত দফা দাবির কয়েকটি মেনেও নেয়। তবে এর আগেই দেশব্যাপী একটা ঝড় বয়ে যায়। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া ও সরকারের পক্ষ থেকে ছাত্রদের ওপর দায় চাপানোর কারণে মুজিবের উপাধি বাতিল করা হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডাকসুর তৎকালীন ভিপি সেলিম শনিবার (৬ ডিসেম্বর, ২০২৫) দৈনিক আমার দেশের প্রতিবেদককে বলে, ‘স্বাধীন দেশে আমরা ভিয়েতনামের সংগ্রামে সংহতি জানিয়ে মিছিল বের করেছিলাম। যেই মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি বর্ষণ করে। সেই গুলি বর্ষণের ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করা; দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া এবং তাদের অপসারণ করা; আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার দাবি জানাই। কিন্তু আমাদের দাবিগুলো না মানায় আমি এই ঘোষণা দিই। এটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে পুলিশের গুলিতে প্রথম হত্যাকাণ্ড। পয়লা জানুয়ারি ’৭৩ সালে এটি সংঘটিত হয়।’

ওইদিন ছাত্রনেতারা কোনো পিকেটিং করেছিলেন কি না জানতে চাইলে সেলিম বলেন, ‘পিকেটিং-টিকেটিং এ রকম কিছু করেনি। একটা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ছিল। আমরা শুধু স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য যাই। বটতলায় প্রতিবাদ সমাবেশ ও বক্তৃতা শেষে মিছিল নিয়ে রওনা হই মতিঝিলের আদমজী কোর্টের আমেরিকান দূতাবাস অভিমুখে। দোয়েল চত্বর, শিক্ষা ভবন, হাইকোর্ট মোড়, এখনকার কদম ফোয়ারা পার হয়ে মিছিল ডানদিকে মোড় নেয়। সে সময় ইউএসআইএসের বিল্ডিংয়ের সামনে যেটা বর্তমান প্রেস ক্লাবের উল্টো দিকে ছিল। আমরা কদম ফোয়ারা ঘুরে প্রেস ক্লাবের কাছাকাছি আসতেই কোনো ধরনের পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই পুলিশ গুলি করে। সে সময় দুজন মারা যয়ন, অনেকে আহত হয়। কিছু সাংবাদিকও গুরুতর আহত হয়েছিল।’


তথ্যসূত্র
১. মুজিবের ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জাতির পিতা’ উপাধি প্রত্যাহার করেছিল ডাকসু
– https://tinyurl.com/mupszpwu

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধআফগানিস্তানের আল-বিরুনি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমন্ডিত সবুজ অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ
পরবর্তী নিবন্ধআফগানিস্তানের নিমরুজ প্রদেশে পুলিশ বিভাগের প্রচেষ্টায় ১২ বছর গৃহবন্দি থাকা এক ব্যক্তিকে উদ্ধার