তিনি ছিলেন এলোকেশ বিশিষ্ট। বদন ছিল ধূলায় ধূসরিত, হালকা-পাতলা, জীর্ণশীর্ণ। তা সত্ত্বেও কেবল মল্লযুদ্ধে তিনি হত্যা করেছেন একশত মুশরিককে। আর যুদ্ধের ময়দানে যে কত মুশরিক তাঁর হাতে প্রাণ হারিয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই।
রিদ্দাহ এর যুদ্ধে (মুরতাদ বিরোধী যুদ্ধে) নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদার মুসায়লামার নিজ গোত্র বনু হানীফা ছিল মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ।
মুসাইলামাকে সাহায্য করতে তার নিজ গোত্র ও মিত্রদের থেকে চল্লিশ হাজার সৈনিক সংঘবদ্ধ হয়। যুদ্ধে এরা ছিল সিদ্ধহস্ত।
তাদের অধিকাংশই তাকে সমর্থন করতো সাম্প্রদায়িক বা বংশীয় টানে। কিন্তু তারা তাকে নবী বলে বিশ্বাস করত না। তাদের অনেকে বলতো, আমি একথা স্বীকার করি যে, মুসায়লামাহ মিথ্যাবাদী ও ভণ্ড আর মুহাম্মদ সত্যবাদী। তবে সত্যবাদী মুহাম্মদ থেকে স্বগোত্রীয় মিথ্যাবাদী মুসাইলামা আমাদের কাছে অধিক প্রিয়!
হযরত ইকরামা বিন আবু জাহেল রাদিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে মিথ্যুক মুসাইলামার উপর মুসলিম মুজাহিদগণ আক্রমণ করেন। কিন্তু মুসায়লামার কাছে তাঁরা পরাজিত হন।
অতঃপর, আমিরুল মুমিনিন হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু খালেদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে দ্বিতীয় আরেকটি দল প্রেরণ করলেন। যে দলে আনসার ও মুহাজিরিনের অনেক বড় বড় সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুম অংশ নিয়েছিলেন।
উভয় দল ‘নজদের ইয়ামামা’তে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। অল্পতেই জয়ের পাল্লা মুসায়লামার দিকে ঝুঁকে পড়ে। ময়দানে মুসলিমদের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তারা খালেদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর তাবুতে আক্রমণ করে বসে। তারা তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদেরকে হত্যা করেই বসেছিলো যদি না তাদেরই (শত্রুদের)একজন তাঁদেরকে আশ্রয় না দিত।
মুসলিমগণ পরিস্থিতির নাজুকতা অনুধাবন করতে বিলম্ব করলেন না। তাঁরা গভীরভাবে অনুধাবন করলেন, আজ মুসলিমরা মুসায়লামার কাছে পরাজিত হলে ইসলামের ভিত চিরতরে নড়বড়ে হয়ে পড়বে। আমীরুল মুজাহিদিন হযরত খালেদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু গাঁ ঝাড়া দিয়ে উঠলেন। ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া মুসলিমদেরকে সুবিন্যস্ত ও সারিবদ্ধ করলেন। মুহাজির ও আনসারগণকে ভিন্ন ভিন্ন সারিতে বিন্যস্ত করলেন, যেন প্রতিযোগিতামূলকভাবে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়।
তারপর শুরু হয় এমন প্রচণ্ড লড়াই, ইতিহাসে যার নজির মেলা ভার। মুসায়লামার বাহিনীতে হতাহতের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলছিল। কিন্তু এতে তারা বিচলিত না হয়ে বীর বিক্রমে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। মুসলিমগণ এই যুদ্ধে এমন বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন যা কল্পনাকেও হার মানায়। কিন্তু বারা ইবনে মালিকের রাদিয়াল্লাহু আনহুর বীরত্বের সামনে তাঁদের সকলের বীরত্ব ম্লান হয়ে যায়।
বারা ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু এমন একজন বাহাদুর, যাঁর ব্যাপারে হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন , সাবধান! তাঁকে কোন মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি বানাবে না। তাহলে ভয় হয়,সে নির্দ্বিধায় সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোটা বাহিনীকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিবে।
খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধের ভয়াবহতা ও তীব্রতা দেখে বারা ইবনে মালিকের দিকে ফিরে বললেন, হে আনসার যুবক! ঐ তাঁদের দিকে যাও।
তখন তিনি নিজ গোত্রের লোকদের কাছে গেলেন এবং বললেন,হে আনসারগণ! তোমাদের কেউ যেন মদীনায় ফিরে যাওয়ার চিন্তা না করে, এমনটি করলে আজকের পর তোমাদের কোন মদীনা থাকবে না। সামনে রয়েছে এক আল্লাহ, তারপর জান্নাত।
বারা ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু আনসারদের প্রতি অগ্নিঝড়া বক্তৃতা দিয়ে সিংহের মতো মুসাইলামার বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। আল্লাহর শত্রুর গর্দানে বিদ্যুৎ গতিতে তলোয়ার চালালেন। এবার মুসলিমদের তীব্রু আক্রমণের ফলে মুসাইলামা ও তার বাহিনীর পায়ের তলার মাটি খসে পড়ে। দিশেহারা হয়ে একটি বাগিচায়(বাগানে) তারা আশ্রয় নেয়। ইতিহাসে যার নাম হলো ‘মৃত্যু বাগিচা’। ঐ দিন মুসাইলামার বিপুল সংখ্যক সৈন্য সেই বাগিচায় নিহত হয়েছিল। তাই এর নাম হয়ে যায় “মৃত্যু বাগিচা”।
এই মৃত্যু বাগিচাটি ছিল সুবিস্তৃত ও উঁচু প্রাচীর বেষ্টিত। মুসায়লামাহ ও তার সাথে থাকা হাজার হাজার যোদ্ধা বাগিচার ফটক বন্ধ করে দিল এবং সুউচ্চ প্রাচীরের বদৌলতে বাগিচাটিকে তারা দুর্গরূপে ব্যবহার করল। প্রাচীরের উপর থেকে তারা অনবরত তীর নিক্ষেপ করছিল। মুসলিমদের উপর তা বর্ষিত হচ্ছিল বৃষ্টির ন্যায়।
ঠিক তখন এগিয়ে এলেন অসম সাহসী বারা ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং বললেন, হে আমার গোত্রের লোকেরা! আমাকে একটি ঢালের উপর রাখ ; সেই ঢালকে কয়েকটি নেজা দিয়ে উর্ধ্বে উত্তোলন কর, তারপর আমাকে নিক্ষেপ কর বাগিচার ভেতরে; ফটকের সন্নিকটে। এতে হয়ত আমি শাহাদাত বরণ করব নয়ত তোমাদের জন্য ফটক খুলে দেব।
চোখের পলকে হযরত বারা ইবনে মালিক (রাঃ) একটি ঢালের উপর গিয়ে বসলেন। তিনি ছিলেন একেবারে হালকা পাতলা। কয়েকটি নেজা অনায়াসে তাকে উর্ধ্বে উত্তোলন করল এবং মুসায়লামার হাজার হাজার সৈন্যের মাঝে মৃত্যু বাগিচায় নিক্ষেপ করল। বজ্রের ন্যায় তিনি তাদের উপর আপতিত হলেন। ফটকের সামনে বেশ কিছু সময় তাদের সাথে লড়াই করলেন এবং অনবরত তরবারি চালিয়ে অন্তত তাদের দশ ব্যক্তিকে হত্যা করার পর ফটক খুলে দিতে সক্ষম হন। তবে এটি করতে তরবারি ও বর্শার আশির অধিক আঘাতে তাকে ক্ষতবিক্ষত হতে হয়েছে। তখন প্রাচীর টপকে এবং ফটক দিয়ে মুসলিমগণ মৃত্যু বাগিচায় স্রোতের ন্যায় প্রবেশ করতে থাকেন এবং প্রাচীরের আড়ালে আশ্রয় গ্রহণকারী মুরতাদদেরকে তরবারির আঘাতে জাহান্নামে পাঠাতে থাকেন। প্রায় বিশ হাজার মুরতাদ প্রাণ হারায়। অবশেষে মুসলিম মুজাহিদগণ মুসায়লামার নাগাল পান এবং তার ইহলীলা সাঙ্গ করেন।
যুদ্ধ শেষে হযরত বারা ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু কে চিকিৎসার জন্য তাঁর কাযওয়ায় বয়ে নেয়া হয়। তাঁর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু সেখানে দীর্ঘ একমাস অবস্থান করেন। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা তাকে সুস্থতা দান করেন।
আল্লাহ তায়ালা তার মাধ্যমে মুসলিমদের বিজয় নিশ্চিত করেছিলেন।
আল্লাহ জান্নাতে বারা ইবনে মালিকের রাদিয়াল্লাহু আনহুর চেহারাকে উজ্জ্বল ও সজীব করে দিন এবং নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যে তার আঁখিযুগল শীতল করুন। আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হউন এবং তাঁকে সন্তুষ্ট করুন।