ওমর ইবনে মুখতার ইবনে ওমর আল মানফী (রহ.) ১৮৫৮ ঈসায়ী “বারকার” অন্তর্বতী জাবালে আখাদ্বারে” অবস্থিত বুত্বনান এলাকায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পরিপূর্ণ ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে উঠেন । তিনি ছিলেন খুবই আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি এবং কোরআন সুন্নাহর আদর্শে আদর্শবান।
শৈশবেই তিনি পিতৃহারা হন। হজ্জের সফরে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়েছিল। পিতার মৃত্যুর পর শাইখ হুসাইন আল গারইয়ানীর তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হন তিনি। নিজ মেধা ও বিচক্ষণতায় শৈশবেই সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। তাঁর মেধার কারণে জাগবুব কলেজের শিক্ষক মণ্ডলী তাকে বেশ গুরুত্ব দিতেন। তিনি জাগবুব কলেজে আট বছর পড়াশোনা করে উস্তাদদের কাছ থেকে শরিয়তের বিভিন্ন ইলম অর্জনে নিজেকে সিক্ত ও পরিতৃপ্ত করেন।
তিনি ছিলেন মাঝারী উচ্চতা ও ঘন দাড়ি বিশিষ্ট। তাঁর ঠোটে সর্বদা মুচকি হাঁসি লেগে থাকতো। চেহারায় ছিল গাম্ভীর্যের ছাপ। তাঁর কথা ছিল খুবই ভারসাম্যপূর্ণ-আবেগময় যা শুনতে মানুষ কখনো বিরক্তিবোধ করতো না। তাঁর কথায় আঞ্চলিক টান ছিল। আওয়াজ ছিল খুব উঁচু ও স্পষ্ট।
২৯ সেপ্টেম্বর ১৯১১ ঈসায়ী ইতালি লিবিয়া দখল করতে তাদের নৌবাহিনী প্রেরণ করে। শহীদ ওমর মুখতার (রহ.) তাদের প্রতিরোধ করতে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেন। একের পর এক গেরিলা হামলা চালিয়ে তাদেরকে নাজেহাল করে ছাড়েন। ফলে তিনি ইতালির মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। তাদের পত্রিকাগুলোতে জোরেশোরে তাঁকে নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়। ইতিমধ্যে ওমর মুখতার ও তাঁর সহযোদ্ধাদের হাতে ধারাবাহিক পরাজয়ের ফলে চারজন ইতালীয় শাসকের ক্ষমতার পালাবদল হয়। ফলে ওমর মুখতার (রহ.) ইতালিয়ানদের দুঃস্বপ্নে পরিণত হন।
এদিকে ওমর মুখতারের একের পর এক বিজয়ে ইউরোপে ইতালীয়দের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। তাই, ওমর মুখতার ও তাঁর সঙ্গীদের রুখতে ফ্যাসিস্ট মসোলিনী নিজেই এগিয়ে আসে।
সে যুদ্ধাপরাধী গ্ৰাজিয়ানিকে লিবিয়া অভিমুখে প্রেরণ করে। সে সেখানে এমন সব ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে যার নজির তৎকালীন বিশ্বে ছিল না। সে মিসর-লিবিয়া সীমান্তে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করে, যেন মিশর থেকে লিবিয়ার মুজাহিদদের কাছে কোন সাহায্য আসতে না পারে। এমন পরিস্থিতিতে শহীদ ওমর মুখতার (রহ.) বাকী মুজাহিদগণকে নিয়ে লিবিয়ার উত্তপ্ত মরুভূমিতে ঘাঁটি স্থাপন করেন । তাঁদেরকে ধাওয়া করতে আসা আগ্ৰাসী বাহিনীর জন্য মরুভূমিকে মরণ ফাঁদে পরিণত করা হয়। ফলে লিবিয়া ভূখণ্ড ইতালীয়দের জন্য অগ্নিশিখার রূপ ধারণ করে।
শহীদ ওমর মুখতার (রহ.) নিজের জীবনের সময়টাকে দুইভাগে ভাগ করে নিয়েছিলেন। তিনি দিনের বেলা জিহাদ করতেন আর রাতের বেলা ইবাদত বন্দেগীতে কাটিয়ে দিতেন। প্রচণ্ড যুদ্ধের দিনগুলোতেও প্রতি সপ্তাহে তিনি একবার কোরআন শরীফ খতম করতেন। সাধারণত দৈনিক মাত্র দুই বা তিন ঘন্টা ঘুমাতেন।
একদিন হযরত ওমর মুখতার ঘোড়ায় চড়ে মরুভূমিতে পথ চলছিলেন। এমতাবস্থায় তাঁর উপর আক্রমণ করা হয়। তাঁর ঘোড়া আহত হয়। তিনি মরুভূমির উত্তপ্ত বালির উপর ছিটকে পড়েন এবং গুরুতরভাবে আহত হন। হামাগুড়ি দিয়ে একটু একটু করে সামনে অগ্ৰসর হতে থাকেন। এবং এক জনবসতিতে পৌঁছাতে সক্ষম হন।
১১ সেপ্টেম্বর ১৯৩১ ঈসায়ী, শহীদ ওমর মুখতার (রহ.) লিবিয়ার উপকূলে একটি এলাকায় অবস্থা করছিলেন। সে সময় ইতালীয়রা তাঁকে অবরোধ করে ফেলে এবং বন্দী করে।
১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৩১ ঈসায়ী, সন্ধ্যা পাঁচটার সময় মিথ্যা অভিযোগের উপর ভিত্তি করে তড়িঘড়ি করে তাঁর ফাঁসির রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ের পূর্বেই ইতালীয় সৈন্যরা ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করে রেখেছিল। রায় ঘোষণার পরের দিন ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩১ ঈসায়ী, বুধবার সকালের মধ্যে ফাঁসির রায় কার্যকর করার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা হয়। এই লক্ষ্যে সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর সকল সদস্য এবং দেশের সকল কয়েদি ও হাজতির পাশাপাশি আরো বিশ হাজার অধিবাসীকে ফাঁসির মঞ্চের চারপাশে জড়ো করা হয়।
১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩১ ঈসায়ী, সকাল ৯টার সময় হাতে বেড়ি পড়া অবস্থায় ওমর ইবনে মুখতারকে জল্লাদের হাতে সোপর্দ করা হয়। ফাঁসির মঞ্চে উঠানোর পর আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে জঙ্গি বিমান মহড়া দিতে থাকে। শহীদ ওমর মুখতার (রহ.) এর কাছাকাছি যারা ছিলেন তাদের অনেকে বলেছেন,
ফাঁসির মঞ্চে উঠানোর পর তিনি মৃদু আওয়াজে নামাজের আযানের মতো আযান দিচ্ছিলেন।” আবার অনেকে বলেছেন, তিনি বিড়বিড় করে কোরআনের সূরা ফজরের শেষ আয়াতগুলো পড়তেছিলেন-
يا أليتها النفس المطلمئنة. ارجعى الى ربك راضية مرضية. فادخلى في عبادى. وادخلى جنتى.
“হে পবিত্র আত্মা! তুমি তোমার রবের নিকট ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তুর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং প্রবেশ কর আমার জান্নাতে। (সূরা আল ফজর)
সর্বশেষ , কালিমা শাহাদাত পড়তে পড়তে শাহাদাত বরণ করেন।
اشهد أن لا اله الا الله و اشهد ان محمدا عبده و رسوله
তাঁর জীবনের কিছু দিক
শহীদ ওমর মুখতার (রহ.) সম্পর্কে বর্ণিত আছে- তিনি এক কাফেলার সাথে বনের মধ্য দিয়ে সুদান যাচ্ছিলেন। কাফেলার একজন কাছাকাছি একটি ক্ষুধার্ত সিংহ থাকার বিষয় নিশ্চিত করে। কাফেলার লোকজন প্রস্তাব করল যে, এটির হামলা থেকে বাঁচতে এর সামনে একটি উট ছেড়ে দেয়া হোক। এতেই সিংহ সন্তুষ্ট হয়ে যাবে। ওমর মুখতার তাদের এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বললেন- দুর্বলের পক্ষ থেকে সবলকে ঘোষ দেয়ার প্রথা মানবসমাজে বাতিল করা হয়েছে। সুতরাং একটি হিংস্র প্রাণীর ক্ষেত্রে এটি কী করে বৈধ হতে পারে!!
ওমর মুখতার বললেন, আল্লাহর কসম! এতে লাঞ্চনা ও অপমানের গন্ধ রয়েছে। আল্লাহর কসম! এটি যদি আমাদের উপর আক্রমণ করতে আসে, তাহলে তলোয়ারের আঘাতে একে দ্বিখণ্ডিত করা হবে। এর সামান্য পর আচমকা সিংহটি সামনে এসে আক্রমণ করতে উদ্যত হল। ওমর বিন মুখতারও প্রস্তুত ছিলেন। তিনি তরবারি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সুকৌশলে তিনি এটিকে হত্যা করলেন। অন্যান্য কাফেলাকে দেখানোর জন্য এর চামড়া উঁচুতে ঝুলিয়ে তারপর আবার যাত্রা শুরু করলেন।
পরবর্তীতে যখনই এ ঘটনাটি তাকে বলা হতো, তখন তিনি বলতেন-
وما رميت اذ رميت ولكن الله رمى…
যখন তুমি নিক্ষেপ করতে চেয়েছিলে, তখন কিন্তু তুমি নিক্ষেপ করনি। বরং আল্লাহ তা’আলাই নিক্ষেপ করেছেন। (সূরা আনফাল)
তাঁর উপাধী:
শহীদ ওমর মুখতারের উপাধী ছিল-
শাইখুল মুজাহিদীন ,শাইখুশ শুহাদা এবং
আসাদুস সাহরা বা মরুর সিংহ।